যিকির শব্দের ব্যবহারে আল-কুরআন (পর্ব এক)

যিকির তথা আল্লাহর স্মরণেই মানুষের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। সূরা আর-রাদের ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করছেন- “(আল্লাহর পথের সন্ধানপ্রাপ্ত তারাই) যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে প্রশান্ত হয়। জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়ে থাকে”।

এখন আমাদের জানতে হবে আল্লাহর যিকির বলতে কি? আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যিকির বলতে মনে করেন পীর মাশায়েখদের মাহফিলে, ওয়াজের মাহফিলে, শবে ক্বদর বা শবে বরাতের রাতে মসজিদে একত্র হয়ে অথবা কোন মিলাদ মাহফিলে বসে আল্লাহু আল্লাহু, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা ইল্লাল্লাহ ইল্লাল্লাহ করা। মূলত যিকির বলতে এগুলোই খাস নয়, কিংবা একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এগুলো ছাড়াও কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন জায়গায় যিকির শব্দটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব আমাদেরকে জানতে হবে যিকির শব্দের ব্যবহারে আল-কুরআন কি বলছে?

যিকির অর্থ হচ্ছে নামাজ।

সূরা জুমার ৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হে ঈমানদারগণ! যখন শুক্রবারের (জুমার) নামাজের জন্য ডাক (আযান) দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণপানে ছুটে আসবে। এবং বেচাকেনা বন্ধ করে দেবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে”। সূরা নিসার ১৪২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “বস্তুত মুনাফিকরা (ঈমানের ভান করে) আল্লাহর সাথে প্রতারণা করছে। তিনিও তাদের সাথে প্রতারণা করবেন (তাদের প্রতারণার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন)। আর তারা যখন নামাজের জন্য দাঁড়ায় তখন অলসভাবে লোক দেখানোর জন্য দাঁড়ায়। তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে”। সূরা সোয়াদের ৩২ নম্বর আয়াতে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর আসরের নামাজের সময় অতিবাহিত করার ঘটনা উল্লেখ করে আল্লাহ ইরশাদ করছেন- “তখন তিনি বললেন, আমি তো আমার প্রভুর স্মরণ (বিকেলের নামাজ) ভুলে সম্পদের (ঘোড়াগুলোর) মোহে আকৃষ্ট হয়েছি। যার ফলে সূর্য পর্দার আড়ালে লুকিয়ে গিয়েছে (এবং নামাজের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে)”।

 যিকির অর্থ হচ্ছে আল্লাহকে স্মরণ করা বা স্মরণ হওয়া।

সূরা বাকারার ১৫২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, আমার অকৃতজ্ঞ হয়ো না”। সূরা আনআমের ৬৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর যখন আপনি আমার আয়াতসমূহ নিয়ে বাজে আলোচনায় রত লোকদেরকে দেখবেন তখন আপনি তাদের থেকে সরে থাকবেন। যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়ের আলোচনায় ফিরে যায়। আর যদি শয়তান আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তাহলে স্মরণ হওয়ার পর আপনি কিছুতেই জালেম লোকদের সাথে বসবেন না”।

 যিকির অর্থ হচ্ছে কুরআন শরীফ।

সূরা আল-হিজরের ৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আমিই কুরআন শরীফ নাযিল করেছি এবং অবশ্যই আমি তা সংরক্ষণ করব”। সূরা জীনের ১৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর যে লোক তার প্রভুর অভিজ্ঞান (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তিনি তাকে কঠিন শাস্তির মধ্যে (জাহান্নামে) প্রবেশ করাবেন”। সূরা আম্বিয়ার ৫০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “এটা আমারই নাযিল-করা এক বরকতময় কুরআন। তবুও কি তোমরা তা অস্বীকার করবে”? সূরা আম্বিয়ার ২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “তাদের কাছে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে নতুন যে কুরআনের সূরা বা আয়াত আসে, তারা তা শোনে খেলার ছলে”। উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেছেন- অর্থাৎ কুরআনের যে নতুন সূরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয় এবং তাদেরকে শুনানো হয় তারা এটাকে কোন গুরুত্বের সাথে শুনে না”।

তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে- যারা আখেরাত ও কবরের আযাব থেকে গাফেল এবং তজ্জন্যে প্রস্তুতি গ্ৰহণ করে না, এটা তাদের অবস্থার অতিরিক্ত বৰ্ণনা। যখন তাদের সামনে কুরআনের কোন নতুন আয়াত আসে এবং পঠিত হয়, তখন তারা একে কৌতুক ও হাস্য উপহাসচ্ছলে শ্রবণ করে। তাদের অন্তর আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে। এর এ অর্থও হতে পারে যে, তারা খেলাধুলায় লিপ্ত থাকে, কুরআনের প্রতি মনোযোগ দেয় না এবং এরূপ অৰ্থও হতে পারে যে স্বয়ং কুরআনের আয়াতের সাথেই তারা রঙ-তামাশা করতে থাকে। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, এখানে খেলা মানে হচ্ছে এই জীবনের খেলা। আল্লাহ ও আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল লোকেরা এ খেলা খেলছে।

 যিকির অর্থ উপদেশ।

সূরা আয-যারিয়াতের ৫৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “তবে উপদেশ দিও, কারণ উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসে”। সূরা গাশিয়াহ এর ২১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “অতএব, উপদেশ দিও, বস্তুত আপনি একজন উপদেশদাতা”। কি দ্বারা উপদেশ দিবেন সেটা আল্লাহ তায়ালা নিজেই সূরা ক্বাফ এর ৪৫ নম্বর আয়াতে বলে দিয়েছেন- “তারা যা বলে আমি তা খুব ভাল করে জানি। আপনি তাদের ওপর বল প্রয়োগকারী নন। তাই যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কুরআনের মাধ্যমে উপদেশ দাও”। সূরা আল-কামারের ২২ ,নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আমি তো কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব, উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি”?

 যিকির অর্থ হচ্ছে আল্লাহর আইন কানুন।

সূরা ত্বাহা এর ১২৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তার জন্য রয়েছে কষ্টের জীবন। এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠাব”। উক্ত আয়াতের তাসফীরে ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেছেন- আর যে ব্যক্তি আমার উপদেশ থেকে বিমূখ হল বা মুখ ফিরিয়ে নিল (অর্থাৎ আমার আদেশ বিরুদ্ধাচরণ করল ও রাসূলের উপর আমি যা কিছু নাযিল করেছি তা থেকে বিমুখ হল এবং তা ভুলে যাওয়ার ভান করল, এমনকি রাসূলের উপর নাযিলকৃত বিষয়াবলী বাদে অন্য কারো থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করে, নিঃসন্দেহে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ জীবন। অর্থাৎ দুনিয়াবী জীবনে সে সংকীর্ণতায় পার করবে, ফলে জীবনপরিক্রমায় সে কোনপ্রকার প্রশান্তি লাভ করতে পারবেনা। আত্মিক প্রশস্ততার পরশ থেকে সে হবে বঞ্চিত। বরং বাহ্যিকভাবে যদিও সে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, খেয়াল খুশি মত পোশাকাদি পরিধান, যা মন চায় তাই খেতে পারে, যেখানে ইচ্ছা সেখানেই থাকতে পারে বা (আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে) যথেচ্ছা সফর করতে পারে কিন্তু বাস্তবতা হল ভ্রষ্টতার কারণে তার হৃদয়টা থাকে সর্বদাই সংকীর্ণ, জরাগ্রস্থ। কেননা, তার হৃদয়াকাশ যতক্ষণ পর্যন্ত (আল্লাহর প্রতি আস্থার) দৃঢ় বিশ্বাস ও হেদায়েতের ব্যাপারে একনিষ্ঠ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে একপ্রকার দ্বিধা-সংশয়, হশরান-পেরেশানীর মধ্যে থাকবে। ফলে সে সবসময়ই দ্বিধাসংশয়ের মাঝেই ঘূর্ণায়মান হতে থাকবে। আয়াতে উল্লেখিত সংকীর্ণ জাীবনধারা বলতে এটাই উদ্দেশ্য।

——– চলবে ইনশা আল্লাহ

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ