“যিকির শব্দের ব্যবহারে আল-কুরআন” (পর্ব দুই)

যিকির তথা আল্লাহর স্মরণেই মানুষের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। সূরা আর-রাদের ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করছেন- “(আল্লাহর পথের সন্ধানপ্রাপ্ত তারাই) যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে প্রশান্ত হয়। জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়ে থাকে”।

এখন আমাদের জানতে হবে আল্লাহর যিকির বলতে কি? আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যিকির বলতে মনে করেন পীর মাশায়েখদের মাহফিলে, ওয়াজের মাহফিলে, শবে ক্বদর বা শবে বরাতের রাতে মসজিদে একত্র হয়ে অথবা কোন মিলাদ মাহফিলে বসে আল্লাহু আল্লাহু, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা ইল্লাল্লাহ ইল্লাল্লাহ করা। মূলত যিকির বলতে এগুলোই খাস নয়, কিংবা একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এগুলো ছাড়াও কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন জায়গায় যিকির শব্দটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব আমাদেরকে জানতে হবে যিকির শব্দের ব্যবহারে আল-কুরআন কি বলছে?

বর্ণনা বা আলোচনা করা।

সূরা মারইয়ামের ১৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “কিতাবে (উল্লিখিত) মারিয়মের ঘটনা বর্ণনা করো। যখন সে তার পরিবার-পরিজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকের এক জায়গায় ঠাঁই নিল”। সূরা কাহ্ফ এর ৮৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর তারা আপনাকে যুল-কারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দাও, আমি তোমাদের নিকট তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা করব”। তাফসীরে ইবনে কাসীর ও ফাতহুল কাদীরে এসেছে- যুল-কারনাইন কে ছিলেন, কোন যুগে ও কোন দেশে ছিলেন এবং তার নাম যুল-কারনাইন হলো কেন এই সম্পর্কে বহু উক্তি ও তীব্ৰ মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। কেউ বলেন তার মাথার চুলে দুটি গুচ্ছ ছিলো। তাই যুল-কারনাইন (দুই গুচ্ছওয়ালা) আখ্যায়িত হয়েছেন। কেউ বলেন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করার কারণে যুল-কারনাইন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। কেউ এমনও বলেছেন যে, তার মাথায় শিং এর অনুরূপ দুটি চিহ্ন ছিলো। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তার মাথার দুই দিকে দুটি ক্ষতচিহ্ন ছিলো।

ফাতহুল বারীতে এসেছে- হযরত আলী (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বলেছেন, যুল-কারনাইন নাবী বা ফিরিশতা ছিলেন না, একজন নেক বান্দা ছিলেন। আল্লাহকে তিনি ভালবেসেছিলেন, আল্লাহও তাকে ভালবেসেছিলেন। আল্লাহর হকের ব্যাপারে অতিশয় সাবধানী ছিলেন, আল্লাহও তার কল্যাণ চেয়েছেন। তাকে তার জাতির কাছে পাঠানো হয়েছিল। তারা তার কপালে মারতে মারতে তাকে হত্যা করল। আল্লাহ তাকে আবার জীবিত করলেন, এজন্য তার নাম হলো যুল-কারনাইন।

 মর্যাদা বা সম্মান।

সূরা যুখরুফের ৪৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর এ কুরআন তো আপনার জন্য ও আপনার সমপ্রদায়ের জন্য একটি মর্যাদার বস্তু। এবং আপনাদেরকে (এ ব্যাপারে) জিজ্ঞাসা করা হবে”। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে তাবারীতে এসেছে- এক অর্থ হচ্ছে, এ কুরআন আপনার ও আপনার কাওমের জন্য স্মরনিকাস্বরূপ। অপর অর্থ হচ্ছে, এ কুরআন আপনার ও আপনার কাওমের জন্য খুবই সম্মানের বস্তু। অর্থাৎ, সুখ্যাতির বিষয়। উদ্দেশ্য এই যে, কুরআন পাক আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্য মহাসম্মান ও সুখ্যাতির কারণ।

সূরা আম্বিয়ার ১০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আমি তো তোমাদের কাছে একটি কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তোমাদের (জন্য) উপদেশ রয়েছে। তবুও কি তোমরা বুঝবে না”? তাফসীরে সা’দী এর মধ্য এসেছে- এখানে কিতাব অর্থ কুরআন এবং যিকির অর্থ সম্মান শ্রেষ্ঠত্ব, খ্যাতি, উল্লেখ্য, আলোচনা ও বর্ণনা। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, এটা তোমাদের জন্য সম্মান, প্রতিপত্তি ও স্থায়ী সুখ্যাতির বস্তু। যদি তোমরা এর উপর ঈমান আন এবং এটা অনুসারে আমল করো। বাস্তবিকই সাহাবায়ে কিরাম এর বড় নিদর্শন। তারা এর উপর ঈমান এনেছিল এবং আমল করেছিল বলেই তাদের সম্মান এত বেশী।

 কোন বিষয় মনে রাখা।

সূরা বাকারার ৬৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “(হে বনী ইসরাঈল! মনে করো) যখন আমি তোমাদের (মাথার) ওপর তূর পাহাড় তুলে ধরে তোমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম, (আর বলেছিলাম) তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা শক্ত করে ধরে রাখবে। এবং তার মধ্যে যা আছে তা মনে রাখবে, যাতে তোমরা ধর্মপরায়ণ হতে পারো”।

 ডাকা বা আহ্বান করা।

সূরা কাহ্ফ এর ২৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আল্লাহ চাইলে বলা ব্যতীত। যখন ভুলে যাও তখন তোমার প্রভুকে আহবান করবে আর বলবে, আশা করি, আমার প্রভু আমাকে এর চেয়েও সত্যের নিকটতর পথ দেখাবেন”। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে কাসীরে এসেছে- কোন কোন মুফাসসির বলেন, আয়াতের অর্থ হলো, যখনি আপনি কোন কিছু ভুলে যাবেন তখনই আল্লাহকে ডাকবেন। কারণ, ভুলে যাওয়াটা শয়তানের কারসাজির ফলে ঘটে। আর মহান আল্লাহকে ডাকলে শয়তান দূরে চলে যায়। এ অর্থটির সাথে পরবর্তী বাক্যের মিল বেশী। অপর কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে মিলিয়ে অর্থ করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি ইনশা আল্লাহ ভুলে যান। তবে যখনই মনে হবে তখনই ইনশা আল্লাহ বলে নেবেন।

 যিকির অর্থ হচ্ছে লাওহে মাহফুজ

সূরা আম্বিয়ার ১০৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আমি সংরক্ষিত ফলকের (লাওহে মাহফুজের) পর আসমানি কিতাবেও লিখে দিয়েছি যে, জমিনের উত্তরাধিকারী হবে আমার যোগ্য (অথবা সৎকর্মপরায়ণ) বান্দারা”।

 যিকির অর্থ হচ্ছে নামাজের পর যিকির বা তাসবীহ।

সূরা নিসার ১০৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “এভাবে যখন নামাজ সম্পন্ন করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহর যিকির করবে। তারপর যখন নিশ্চিন্ত (শঙ্কামুক্ত) হবে তখন ঠিকভাবে নামাজ পড়বে। নামাজ তো মুমিনদের জন্য এক সময়-নির্ধারিত ফরয”। আল্লাহ তায়ালা সালাতুল খাওফের পর বেশি বেশি যিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও তাঁর যিকিরের নির্দেশ ও গুরুত্ব অন্য নামাজের পরেও রয়েছে। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে এজন্য বলা হয়েছে যে, এ নামাজের রুকন আরকান হালকাভাবে আদায় করা হয়। এখানে নামাজরত অবস্থায় সামনে ও পিছনে আসা এবং অন্যান্য কাজ বৈধ ছিল যা সাধারণ অবস্থার নামাজে বৈধ নয়। সূরা আহযাবের ৪১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে – “হে ঈমানদারগণ! তোমরা বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করো”। এখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে বেশি বেশি তাঁর যিকির করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। উক্ত সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করছেন- “এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারিণী মহিলাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও বিরাট প্রতিদান”।

সুতরাং আমরা যিকিরের আসল বা মৌলিক অর্থ যা পেলাম তা হলো- নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, আল্লাহর আইন-কানুন, আল্লাহর স্মরণ করা, আল্লাহকে ডাকা, তাসবীহ, তাহলীল, তাকবির, কুরআন তেলাওয়াত ও সকল সুন্নাত ও মুসনুন দোয়া সমূহসহ এভাবে আরো অনেক অর্থে যিকির শব্দের ব্যবহার এসেছে পবিত্র কুরআনুল কারীমে। তবে হাদীস শরীফে “লাইলাহা ইল্লালাহ” বলে যিকির করাকে উত্তম যিকির বলা হয়েছে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর যিকির বেশি বেশি করার তৌফিক দান করুন।

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ