কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকিরের ফজিলত
আল্লাহর যিকির হচ্ছে যাবতীয় ইবাদতের মূল। কারণ বান্দা যখন আল্লাহর যিকির করে তখন আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন। সূরা বাকারার ১৫২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, আমার অকৃতজ্ঞ হয়ো না”। সুতরাং আমরা যখন আল্লাহর যিকির করব তখন একথা মনে রাখা কর্তব্য যে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে স্মরণ করছেন। এতে যিকির করার স্বাদ বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। যিকিরের ফজিলত বর্ননায় কুরআন-হাদীসের অসংখ্য বর্ননা থেকে আমরা সংক্ষিপত পরিসরে কিছু জানব ইনশা আল্লাহ।
কখন যিকির করবেন?
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বক্ষণ (সর্বাবস্থায়) আল্লাহর যিকির করতেন”। সুনানে ইবনে মাজাহ ও তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য ইসলামের শারীয়াতের বিষয়াদি অতিরিক্ত হয়ে গেছে। সুতরাং আমাকে এমন একটি বিষয় জানান, যা আমি শক্তভাবে আঁকড়ে থাকতে পারি। তিনি বললেন, সর্বদা তোমার জিহ্বা যেন আল্লাহ তায়ালার যিকিরের দ্বারা সিক্ত থাকে”।
কিভাবে যিকির করবেন?
সূরা আরাফের ২০৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর আপন মনে বিনীতভাবে ও ভয়ের সাথে অনুচ্চ বাক্যে সকালে ও বিকালে স্বীয় মালিকের যিকির করো এবং অমনোযোগী হয়ো না”। মুসনাদে আহমদে এসেছে- “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহর যিকির এত বেশী করতে থাকো যে, লোকেরা পাগল বলে”।
আল্লাহর যিকির হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ।
সূরা আনকাবুতের ৪৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আপনার কাছে যে কিতাব (কুরআন শরীফ) নাযিল করা হয়েছে তা পাঠ করুন এবং নামাজ কায়েম করুন। নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর যিকিরই সবচেয়ে বড়। আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা জানেন”। সুনানে ইবনে মাজাহ ও তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিন বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি কি তোমাদের আমলসমূহের সর্বোত্তমটি সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করবো না, যা তোমাদের প্রভুর নিকট সরবাধিক প্রিয়, তোমাদের মর্যাদা অধিক উন্নীতকারী, তোমাদের সোনা-রুপা দান করার চেয়ে এবং যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তোমাদের শত্রুদের হত্যা করা এবং তোমাদের নিহত হওয়ার চেয়ে উত্তম? সাহাবীগণ বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ সেটি কি? তিনি বলেন আল্লাহর যিকির”। সুনানে ইবনে মাজাহ ও তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, সর্বোত্তম যিকির হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।
সফলতা অর্জন হয়।
সূরা আনফালের ৪৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোন বাহিনীর মুখোমুখি হবে তখন অবিচল থাকবে। এবং বেশি করে আল্লাহর যিকির করবে, যাতে তোমরা সফল হতে পারো”। সূরা জুমার ১০ নম্বর আয়াতে একই কথা ইরশাদ হচ্ছে- “অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান করবে। এবং বেশি করে আল্লাহর যিকির করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো”। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মুফার্রিদগণ অগ্রগামী হয়েছে (তথা সফলতা লাভ করেছে)। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, মুফার্রিদ কারা হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, অতিমাত্রায় আল্লাহকে স্মরণকারী পুরুষ ও মহিলা”।
অন্তরে প্রশান্তি আশে।
সূরা রা’দ এর ২৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “(আল্লাহর পথের সন্ধানপ্রাপ্ত তারাই) যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে প্রশান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়ে থাকে”।
অন্তরে ভীতি আশে।
সূরা আনফালের ২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “মুমিন তো তারাই, আল্লাহর কথা আলোচিত হলে যাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয় এবং তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হলে যাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তারা তাদের প্রভুর ওপরই ভরসা করে”। সূরা হজ্জের ৩৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “যাদের অন্তরসমূহ আল্লাহর কথা শুনলে ভীত হয়, যারা বিপদ এলে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ কায়েম করে এবং তাদেরকে যা কিছু দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে”।
ক্ষমা ও মহাপুরস্কার রয়েছে।
সূরা আহযাবের ৩৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “নিশ্চয় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও মহিলা, ঈমানদার পুরুষ ও মহিলা, আল্লাহর অনুগত পুরুষ ও মহিলা, সত্যবাদী পুরুষ ও মহিলা, ধৈর্যশীল পুরুষ ও মহিলা, বিনীত পুরুষ ও মহিলা, দানশীল পুরুষ ও মহিলা, রোযাদার পুরুষ ও মহিলা, যৌন পবিত্রতা রক্ষাকারী পুরুষ ও মহিলা, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও মহিলা। আল্লাহ এদের জন্য ক্ষমা ও এক মহান পুরস্কার (জান্নাত) প্রস্তুত রেখেছেন”।
জীবিত ও মৃতের পার্থক্য।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে তার প্রতিপালকের যিকির করে, আর যে যিকির করে না, তাদের উপমা হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তির ন্যায়”।
আরশের নীচে জায়গা পাবে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সাত প্রকার লোককে আল্লাহ আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। (তন্মধ্যে) এমন এক ব্যক্তি যে আল্লাহর যিকির করে অতঃপর তার দুটি চোখ অশ্রুসিক্ত হয়”।
আল্লাহর রহমত সাথে থাকে।
সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে হাদীসে কুদসীতে এসেছে- “হযরত হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন- আমার বান্দা যখন আমার যিকির করে এবং আমার যিকিরে তার দুই ঠোঁট নড়াচড়া করে তখন আমি তার সঙ্গে থাকি (তথা আমার রহমত তার সাথে থাকে)”।
যিকিরে শয়তান দূর হয়।
সহীহ বুখারী শরীফের তা‘লীক হিসেবে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- শয়তান আদম সন্তানের কলবের বা অন্তরের উপর জেঁকে বসে থাকে। যখন সে আল্লাহর যিকির করে তখন সরে যায়। আর যখন গাফিল বা অমনোযোগী হয় তখন শয়তান তার দিলে ওয়াস্ওয়াসা দিতে থাকে”।
যিকির হচ্ছে নাজাত দানকারী।
বুলুগুল মারাম ও ইমাম সুয়ূত্বীর গ্রন্থ আল-জামেউস সগীরে এসেছে- “হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কোন আদম সন্তান আল্লাহর যিকির থেকে এমন কোন বড় আমল করেনি যা আল্লাহর আযাব থেকে অধিক নাজাত দানকারী”।
জান্নাতীরা আফসোস করবেন।
সুনানে বায়হাকী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- জান্নাতে প্রবেশ করার পর জান্নাতবাসীরা দুনিয়ার কোনো জিনিসের জন্য আফসোস করবে না। শুধু ঐসময়ের জন্য আফসোস করবে, যা দুনিয়াতে আল্লাহর যিকির ছাড়া অতিবাহিত করেছে”।
অতএব আমাদের সবাইকে সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে নামাজসহ শরীয়তের সকল হুকুম আহকাম আদায় করার পাশাপাশি বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করতে হবে। কারণ বেশি যিকির করার নির্দেশ দিয়ে সূরা আহযাবের ৪১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা বেশি করে আল্লাহর যিকির করো”। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে যাকিরিনদের অন্তর্ভূক্ত করুন। (আমিন)
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান