রহমতে আলম (সাঃ) : ইসরা ও মি’রাজ (পর্ব এক)
আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নাবী রাসূলদের বিভিন্ন মু’জিযা দিয়ে এই দুনিয়ার জমিনে প্রেরণ করেছিলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও বড় বড় মু’জিযা ছিল রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর। এ সমস্ত মু’জিযার মধ্যে অন্যতম একটি মু’জিযা হচ্ছে ইসরা ও মি’রাজ। উক্ত ঘটনা রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সু-মহান মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করে বিশ্ব বাসিকে জানিয়ে দিয়েছেন। উক্ত ঘটনা যেভাবে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাতের সাথে সম্পর্কিত ঠিক সেভাবে ইসলামী আক্বীদাহ ও বিশ্বাসের সাথে সংযুক্ত। কারণ সেখানে লুকিয়ে রয়েছে অসংখ্য ইলাহী হিকমত ও রহস্য। যেগুলো কোন জ্ঞান বিজ্ঞান ছাড়াই বিশ্বাস করতে হবে।
এতে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও নির্দেশনা। কুরআন-হাদীস ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের আলোকে ইসরা ও মি’রাজের সঠিক ঘটনা জানা একজন মুসলমানের জন্য একান্ত কর্তব্য। কারণ বর্তমান সময়ে অনির্ভরযোগ্য কিছু বুক থেকে অনেক কমেডিয়ান বক্তা বিভিন্ন বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনী বলে থাকেন। যেগুলো বিশ্বাস করার কারণে আপনার আমার ঈমানের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই বিষয়টি অনেক লম্বা হলেও খুব সংক্ষিপত পরিসরে কুরআন-হাদীস ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের আলোকে “রহমতে আলম (সাঃ) : ইসরা ও মি’রাজ” শিরোনামে কয়েকটি পর্বে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। যেহেতু উক্ত সফরের দুটি পার্ট রয়েছে ইসরা ও মি’রাজ। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে ইসরা নিয়ে আলোকপাত করার পর মি’রাজ নিয়ে আলোকপাত হবে ইনশা-আল্লাহ।
ইসরা এর পরিচিতি
মুফাস্সীরগনের ভাষায় ইসরা বলা হয় রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মি’রাজ রাজনীতে মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত সফর বা পরিভ্রমণ করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “পবিত্রতা ও মহিমা সেই মহান সত্তার, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (জেরুজালেমের) মাসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত”।
ইসরা ও মি’রাজ সংঘটিত হওয়ার সময়।
ইসরা ও মি’রাজের তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়াত পাওয়া যায়। মুসাদ্দীসগণ কোন সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেননি। যদিও সাধারণভাবে প্রসিদ্ধ যে, রজব মাসের ২৭ তারিখ ইসরা ও মি’রাজের রাত।
হযরত ইমাম কুরতুবী (রহঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বিভিন্ন রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন- মূসা ইবনে উকবার মত হচ্ছে, হিজরতের ছয় মাস পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন, হযরত খাদীজা (রাঃ) এর ওফাত নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্বেই হয়েছিল। ইমাম যুহুরী বলেন, হযরত খাদীজা (রাঃ) এর ওফাত নবুওয়াতের সাত বছর পরে হয়েছিল। হরবী (রহঃ) বলেন, ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা রবিউস-সানী মাসের ২৭ তারিখ হিজরতের এক বছর পূর্বে ঘটেছিল। ইবনে কাসেম সাহাবী বলেন, নবুওয়াত প্রাপ্তির আঠার মাস পর ঘটেছিল। ইবনে ইসহাক বলেন, ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রসমুহে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এসব রেওয়ায়েতর সারমর্ম হলো ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা হিজরতের কয়েক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল।
ইসরা ও মি’রাজ সংঘটিত হওয়ার কারণ।
ইসরা ও মি‘রাজের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতের বিভিন্ন নিদর্শন সমূহ তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখানো। সূরা বনী ইসরাঈলের প্রথমেই ইরশাদ হচ্ছে- “পবিত্রতা ও মহিমা সেই মহান সত্তার, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (জেরুজালেমের) মাসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত। যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন”।
রাহীকুল মাখতুমে এসেছে- বিভিন্ন ঐতিহাসিকগনের মতে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতী কাজ শুরু করেন তখন কাফির-মুশরিকদের থেকে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি আসে এবং নানা নির্যাতনের শিকার হন। এতদসত্ত্বেও তিনি দাওয়াতী কাজ করেই যেতেন। এই সময় নিজের দুঃখ-কষ্ট প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজা (রাঃ) এর সাথে ভাগ করে নিতেন। এবং দাওয়াতী কাজের বাধা-বিপত্তিতে সাহায্য করতেন চাচা আবূ তালেব। কিন্তু নবুওয়াতের দশম বছরের চাচা আবূ তালেব মারা যান, চাচা আবূ তালেবের মৃত্যুর তিন দিন, মতান্তরে দুমাস পর প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজাও মারা যান। এখন মক্কাতে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আশ্রয়স্থল বলতে কোন জায়গা রইল না। তাই তাঁর সমস্ত মনবেদনাকে দূর করে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা ইসরা ও মি‘রাজের ব্যবস্থা করেন।
ইসরা ও মি’রাজের হুকুম।
তাফসীরে আহমদীর মধ্যে এসেছে- হযরত শায়খ আহমদ মোল্লা জিয়ূন (রহঃ) বলেছেন- মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত মি’রাজ কুরআন শরীফ দ্বারা সাব্যস্ত। তাই এটা অস্বীকারকারী কাফির। মাসজিদুল আক্বসা হতে প্রথম আসমান পর্যন্ত মি’রাজ হাদীসে মাশহুর দ্বারা প্রমাণিত। তাই এটা অস্বীকারকারী বেদায়াতী। প্রথম আসমান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত হাদীসে আহাদ দ্বারা প্রমাণিত। তাই এটা অস্বীকারকারী ফাসিক।
ইসরা ও মি’রাজ শুরুর আগে বক্ষবিদীর্ণ ।
ফাতহুল বারী ও উমদাতুল ক্বারীতে এসেছে- বক্ষবিদীর্ণের ঘটনা মোট চারবার হয়েছে। প্রথমত:- রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশবে যখন হযরত হালীমা সা’দীয়া (রাঃ) এর ঘরে ছিলেন তখন। এই সময় রক্তের পিন্ড বের করে দেওয়া হয়। এটা ছিল ঐ সমস্ত নাপাক রক্ত যা মানুষের ভিতরে নাফরমানীর মূল এবং মৌলিক বস্তু। এটা রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল ইহা শয়তানের অংশ ছিল। অতএব রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয়তানী প্ররোচনা থেকে হেফাজত থাকবেন। দ্বিতীয়ত:- রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দশ বছরে পদার্পণ করেন তখন আবার বক্ষবিদীর্ণ করা হয়। তৃতীয়ত:- নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় চল্লিশ বছর বয়সে যখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) হেরা গুহায় ওহী তথা কুরআন শরীফের বানী নিয়ে এসেছিলেন। চতুর্থত:- ইসরা ও মি’রাজের রাতে হয়েছিল। যেন রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভিতরে এই রাতের সফরের সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ এবং আল্লাহর নিভৃত আলাপের জন্য যোগ্যতা হাসিল করতে পারেন।
—— চলবে ইনশা-আল্লাহ
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান