রহমতে আলম (সাঃ) : ইসরা ও মি’রাজ (পর্ব দুই)


আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সৃষ্টি জগতের সব কিছু দেখানোর জন্য ইসরা ও মি’রাজের রাতে হযরত জিব্রাইল (আঃ) সহ আরো একদল ফেরেশতা পাঠালেন। হযরত জিব্রাইল (আঃ) এসে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জাগ্রত করলেন। অতঃপর তাঁকে নিয়ে গেলেন আবে যমযমের নিকটে। তাঁর বক্ষের অগ্রভাগ হতে চুল পর্যন্ত বিদীর্ণ করা হলো। বের করা হল তাঁর হৃৎপিন্ড এবং আবে যমযম দ্বারা ধৌত করা হলো। অতঃপর ঈমান ও প্রজ্ঞায় ভরপুর স্বর্ণের একটি পেয়ালা এনে তা দিয়ে ভরে দেওয়া হলো রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্ষ মুবারক। এরপর শুরু হলো মি’রাজের প্রথম অংশের সফর ইসরা।

ইসরা ও মি’রাজ কোথায় থেকে শুরু হয়েছে।

রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সফর কোথায় থেকে শুরু হয়েছিল এ ব্যাপারে অনেক মতামত পাওয়া যায়। তার মধ্য থেকে আমরা এখানে সহী সনদের তিনটি হাদীস উল্লেখ করে পরস্পর বিরোধী বর্ণনার সমাধান জানব। প্রথমত সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি মক্কায় অবস্থানকালে ঘরের ছাদ ফাঁক করা হলো। এবং জিব্রাঈল (আঃ) অবতরণ করলেন। এরপর তিনি আমার বক্ষবিদীর্ণ করলেন। এবং তা যমযমের পানি দ্বারা ধুলেন। এরপর ঈমান ও হিকমতে পরিপূর্ণ একটি সোনার পেয়ালা নিয়ে এলেন এবং তা আমার বুকে ঢেলে দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিলেন”।

দ্বিতীয়ত সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত মালিক ইবনে সা’সা’আহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- একদিন আমি কা’বা শরীফের নিকটে নিদ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি ছিলাম। তখন তিন ব্যক্তির মধ্যবর্তী একজনকে কথা বলতে শুনতে পেলাম। যা হোক তিনি আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। তারপর আমার নিকট একটি স্বর্ণের পাত্র আনা হলো, তাতে যমযমের পানি ছিল। এরপর তিনি আমার বক্ষদেশ এখান থেকে ওখান পর্যন্ত বিদীর্ণ করলেন। বর্ণনাকারী কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, আমি আমার পার্শ্বস্থ একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এখান থেকে ওখান পর্যন্ত বলে কি বুঝাতে চেয়েছেন? তিনি জবাব দিলেন, বুক থেকে পেটের নীচ পর্যন্ত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এরপর আমার হৃদপিণ্ডটি বের করা হলো এবং যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে পুনরায় যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হলো। ঈমান ও হিকমাতে আমার হৃদয় পূর্ণ করে দেয়া হলো”।

তৃতীয়ত তাফসীরে তাবরানীতে এসেছে- “হযরত উম্মে হানী (রাঃ) আবু তালেবের কন্যা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যখন ইসরা তথা নৈশ ভ্রমণ করানো হয় তখন ঐ রাতে তিঁনি আমার ঘরেই ঘুমে ছিলেন। প্রথমত তিঁনি এশার নামাজ আদায় করেন। অতঃপর ঘুমিয়ে যান। আমরাও ঘুমিয়ে গেলাম। ফজরের পূর্বে তিঁনি আমাদের ঘুম থেকে জাগালেন। তিঁনি তখন বললেন হে উম্মে হানী আমি তোমার সাথে এশার নামাজ আদায় করেছিলাম যে সময় তুমি আমাকে এখানে দেখতে পেয়েছিলে। অতঃপর আমি বাইতুল মুক্বাদ্দাসে গিয়ে সেখানে নামাজ আদায় করেছি। অতঃপর তোমাদের নিয়ে এখন ফজরের নামাজ আদায় করলাম যেমন তুমি দেখতে পাচ্ছ”।

উপরের উল্লেখিত পরস্পর বিরোধী বর্ণনার সমাধান খুব সুন্দর করে দিয়ে হযরত হাফেজ ইবনে হাজার আসকালী (রহঃ) তার লিখিত কিতাব ফাতহুল বারীতে বলেছেন যে, প্রকৃত পক্ষে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানীর ঘরেই রাত যাপন করছিলেন। আর এই ঘরটি শিয়াবে আবি তালেবে অবস্থিত ছিল। যেহেতু উম্মে হানীর ঐ ঘরটি রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘুমানোর জন্য নির্ধারিত ছিল বিধায় তিঁনি সেটাকে নিজের ঘর বলেছেন। ঐ ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে তাঁকে মাসজিদুল হারামে নিয়ে যান। ঐ সময় রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে তন্দ্রার ভাব ছিল তাই তিঁনি মাসজিদুল হারামে শুয়ে পড়েন। তখন জিব্রাঈল (আঃ) ও মিকাঈল (আঃ) সহ আরো একজন ফেরেশতা আগমন করেন। তাদের মধ্য থেকে একজন তাঁকে যমযমের নিকটে নিয়ে যান। আর সেখানেই জিব্রাইল (আঃ) বক্ষবিদীর্ণের কাজ সম্পন্ন করেন। এবং সেখান থেকেই সফর শুরু হয়। যেভাবে আল্লাহ তায়ালা নিজেই ইরশাদ করছেন- “যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (জেরুজালেমের) মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত”।

ইসরার বাহনের পরিচিতি।

রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সফর করানোর জন্য আল্লাহর হুকুমে হযরত জিব্রাইল (আঃ) সাদা বর্ণের একটি চতুষ্পদ বাহন নিয়ে আসেন। যেটার নাম হচ্ছে বুরাক্ব। বুরাক্ব এমন একটি সুন্দর প্রাণী যা খচ্চরের চেয়ে নীঁচু আর গাধার চেয়ে কিঞ্চিত উঁচু। সে পদবিক্ষেপ করতে পারে দৃষ্টির শেষ সীমানায়। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমার নিকট বুরাক্ব নামের একটি সাদা জন্তু উপস্থিত করা হয়। এটি গাধা থেকে কিছু বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট। যতদূর দৃষ্টি যায় একেক পদক্ষেপে সে ততদূর চলে”।

বুরাক্বের আচরণ কেমন ছিল?

রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বুরাক্ব নিয়ে এসেছিলেন হযরত জিব্রাইল (আঃ) সেটি প্রথমে ঔদ্ধত্য আচরণ দেখাল! তখন জিব্রাঈল তাকে থামিয়ে বললেন, হে বুরাক্ব! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছ? তুমি কি জানো, আল্লাহর কাছে তাঁর চেয়ে মহান ও প্রিয়তম কোনো ব্যক্তি কখনও তোমার উপর সাওয়ার হননি। একথা শুনতেই বুরাক্ব ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। সুনানে তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে রাতে নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মি’রাজে ভ্রমণ করানো হয় সে রাতে তাঁর সামনে জিনপোষ আঁটা ও লাগাম বাঁধা একটি বুরাক্ব আনা হয়। বুরাক্ব তার পিঠে সাওয়ার হওয়াটা তাঁর জন্য অসম্ভব করে তুললে জিব্রাঈল (আঃ) তাকে বললেন, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কেন এ রকম আচরণ করছ? অথচ আল্লাহ তায়ালার সমীপে তাঁর চেয়ে বেশি সম্মানীত কেউ তোমার পিঠে সাওয়ার হননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এতে বুরাক্ব ঘর্মাক্ত হয়ে যায়”।

———চলবে ইনশা-আল্লাহ

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ