রহমতে আলম (সাঃ) : ইসরা ও মি’রাজ (পর্ব তিন)


রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সু-মহান মর্যাদা শ্রবণ করার পর বুরাক্ব লজ্জিত হয়ে শান্ত হওয়ার পর রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুরাক্বে আরোহণ করলেন এবং সফর শুরু হয়ে গেল। সফর শুরুর পরে বুরাক্ব কয়েক জায়গায় যাত্রা বিরতী করে। বিশেষ করে যখন জিব্রাইল (আঃ) যেখানে থামতে বলেছেন সেখানে। আর ঐ সমস্ত স্থানে থামার কারণ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখানো ও নামাজ আদায় করা। মু’জামে কাবীর ও ফাতহুল বারীসহ বিভিন্ন কিতাবে এসেছে- বুরাক্ব যখন খেজুর বাগানসমৃদ্ধ এলাকায় পৌঁছলো, তখন জিব্রাইল (আঃ) নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন, এখানে দুরাকাত নামাজ আদায় করুন। জায়গাটির নাম ইয়াসরিব। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হবে মাদীনুল মুনাওয়ারা। আবার মাদায়েন বা বেথেলহেমে তথা হজরত ঈসা (আঃ) এর জন্মস্থানে পৌঁছলে জিব্রাইল তাঁকে আরো দুরাকাত নামাজ আদায় করার কথা জানালেন। এরপর সিনাই পর্বত তথা মূসা (আঃ) আল্লাহর সাথে কথা বলার স্থানে আরো দুরাকাত নামাজ আদায় করলেন। এভাবে সফরের মধ্যেই আল্লাহর বিভিন্ন নিদর্শনসমূহ রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখানো হলো। বিশেষ করে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের লম্বা একটি হাদীসে বে-নামাজী ও কুরআন অনুযায়ী আমল না করার শাস্তি, মিথ্যা কথা বলার শাস্তি, যিনা-ব্যভিচারের শাস্তি, সুদখোরদের শাস্তি ও জাহান্নামের দরজার দারোগা দেখার কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি কি হবে সেগুলো দেখানোর কথা এসেছে।

 বে-নামাজী ও কুরআন অনুযায়ী আমল না করার শাস্তি।

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের লম্বা একটি হাদীসে এসেছে- “হযরত সামুরাহ ইবনে জুনদাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সকালে আমাদেরকে বললেন- গত রাতে আমার কাছে দুজন আগন্তুক আসলেন। তারা আমাকে উঠালেন। আর আমাকে বললেন, চলুন। আমি তাদের সঙ্গে চললাম। আমরা কাত হয়ে শুয়ে থাকা এক লোকের কাছে আসলাম। দেখলাম, অন্য এক লোক তার নিকট পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আর পাথর নিচে গিয়ে পড়ছে। এরপর আবার সে পাথরটি অনুসরণ করে তা আবার নিয়ে আসছে। ফিরে আসতে না আসতেই লোকটির মাথা আগের মত আবার ভাল হয়ে যায়। ফিরে এসে আবার তেমনি আচরণ করে, যা পূর্বে প্রথমবার করেছিল। তিঁনি বলেন, আমি তাদের (সাথীদ্বয়কে) বললাম, সুবহানআল্লাহ! এরা কারা? তারা আমাকে বললেন, সে হলো ঐ ব্যক্তি যে কুরআন শরীফ গ্রহণ করে তা ছেড়ে দিয়েছে। (তথা কুরআন শরীফের হুকুম আহকাম পালন করে না)। আর ফরয নামাজ ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকে”।

 মিথ্যাবাদীদের শাস্তি দেখা।

“এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমরা চিৎ হয়ে শোয়া এক লোকের কাছে আসলাম। এখানেও দেখলাম, তার নিকট এক লোক লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সে তার চেহারার একদিকে এসে এটা দ্বারা ছোঁয়াল থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে নাসারন্ধ্র, চোখ ও মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। এরপর ঐ লোকটি শায়িত লোকটির অপরদিকে যায় এবং প্রথম দিকের সঙ্গে যেমন আচরণ করেছে তেমনি আচরণই অপরদিকের সঙ্গেও করে। ঐ দিক হতে অবসর হতে না হতেই প্রথম দিকটি আগের মত ভালো হয়ে যায়। তারপর আবার প্রথমবারের মত আচরণ করে। তিঁনি বলেন, আমি বললাম সুবহানআল্লাহ! এরা কারা? তারা আমাকে বললেন, সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে সকালে নিজ ঘর থেকে বের হয়ে এমন মিথ্যা বলে যা চারদিকে ছড়িয়ে পরে”।

 যিনা-ব্যভিচারকারীদের শাস্তি দেখা।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমরা চললাম এবং চুলার মত একটি গর্তের কাছে পৌঁছলাম। আমরা তাতে উঁকি মারলাম, দেখলাম তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী ও পুরুষ রয়েছে। আর নিচ থেকে বের হওয়া আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করছে। যখনই লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করে, তখনই তারা উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠে। তিঁনি বলেন, আমি তাদেরকে বললাম, এরা কারা? তারা আমাকে বললেন, তারা হল ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর দল”।

 সুদখোরদের শাস্তি দেখা।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমরা চললাম এবং একটা নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছলাম। এই নদীতে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। আর নদীর তীরে অন্য এক লোক আছে এবং সে তার কাছে অনেকগুলো পাথর একত্রিত করে রেখেছে। আর ঐ সাঁতারকারী লোকটি বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর সে লোক কাছে এসে পৌঁছে যে নিজের নিকট পাথর একত্রিত করে রেখেছে। সেখানে এসে সে তার মুখ খুলে দেয় আর ঐ লোক তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সে চলে যায়, সাঁতার কাটতে থাকে, আবার তার কাছে ফিরে আসে, যখনই সে তার কাছে ফিরে আসে তখনই সে তার মুখ খুলে দেয়, আর ঐ ব্যক্তি তার মুখে একটা পাথর ঢুকিয়ে দেয়। তিঁনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বললেন, সে হলো সুদখোর”।

 জাহান্নামের দারোগা দেখা।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমরা চললাম এবং এমন একজন কুশ্রী লোকের কাছে এসে পৌঁছলাম, যে তোমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে কুশ্রী বলে মনে হয়। আর দেখলাম, তার নিকট রয়েছে আগুন, যা সে জ্বালাচ্ছে ও তার চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছে। তিঁনি বলেন, আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ লোকটি কে? তারা বললেন, সে হলো জাহান্নামের দারোগা মালিক ফেরেশতা”।

গীবতকারীদের শাস্তি দেখা।

সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মি’রাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরী এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে আচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিব্রাইল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গোশত খেতো (তথা গীবত করতো) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানতো”।

যাক্কুম বৃক্ষ দেখানো হলো।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালার বাণী যা সূরা বনী ইসরাঈলের ৬০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর আমি যে দৃশ্য আপনাকে দেখিয়েছি তা কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য”। উক্ত আয়াতের তাফসীরে তিনি বলেন, এটি হলো প্রত্যক্ষভাবে চোখের দেখা যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সে রাতে দেখানো হয়েছে। যে রাতে তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়েছিল। ইবনে আব্বাস (রাঃ) আরো বলেন, কুরআনে যে অভিশপ্ত বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে, তা হলো যাক্কুম বৃক্ষ”। এই যাক্কুম বৃক্ষ সম্পর্কে সূরা স্বফফাতের ৬২-৬৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আপ্যায়নের জন্য কি এই জান্নাত ভালো, না জাহান্নামের যাক্কুম গাছ? (যাক্কুম তিক্ত ফলবিশিষ্ট একপ্রকার কাঁটাওয়ালা গাছ)। জালেমদেরকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি তা সৃষ্টি করেছি। এটা এমন একটা গাছ যা জাহান্নামের মূলে (তলদেশে) উদ্গত হয়। এর শীষ যেন শয়তানদের মাথা। জাহান্নামীরা ঐ গাছ থেকে খাদ্যগ্রহণ করে পেট ভরে ফেলবে। তার ওপরে তাদেরকে গরম পানির মিশ্রণ দেওয়া হবে। তারপর তাদের প্রত্যাবর্তন ঘটবে অবশ্যই জাহান্নামের দিকে”।

—– চলবে ইনশা-আল্লাহ

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।

আরও সংবাদ