রহমতে আলম (সাঃ) : ইসরা ও মি’রাজ (পর্ব চার)


আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতের সব কিছুই দেখানোর জন্য যেহেতু ইসরা ও মি’রাজের আয়োজন করেছেন তাই তিঁনি মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বসায় পৌছার পূর্বেই সাত জমিনের নিচ থেকে দুনিয়ার জমিনের উপরে তাঁর সব নিদর্শনসমূহ দেখালেন। এগুলো বিক্ষিপ্তভাবে সিহা-সিত্তাসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাব, তাফসীর ও ইতিহাস গ্রন্থে এসেছে। যেগুলো থেকে আমাদের অনেক কিছুই শিখার আছে এবং আমাদের ঈমান বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। সেই সমস্ত নিদর্শন থেকে আমরা কয়েকটি উল্লেখ করলাম।

বায়তুল মুক্বাদ্দাসে পৌঁছলেন।

অতঃপর রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বুরাক্ব জেরুজালেম নগরীর বায়তুল মাক্বদিসে গিয়ে পৌঁছল। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুরাক্ব থেকে অবতরণ করার পর জিব্রাঈল (আঃ) একটি পাথর ছিদ্র করে বুরাক্বকে বেঁধে রাখলেন। তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত বুরাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমরা যখন বাইতুল মাক্বদিসে পৌঁছলাম, তখন জিব্রাইল (আঃ) তাঁর আঙ্গুল দিয়ে পাথর ফাটান এবং তার সাথে বুরাক্ব বাঁধেন”।

 বায়তুল মুকাদ্দাসে নামাজের ইমামতি।

শরহে যুরকানী, খাসায়েসূল কুবরা, তাফসীরে রুহুল মায়ানী ও ইবনে কাসীরসহ বহু কিতাবে এসেছে- “মাসজিদুল আক্বসায় রহমতে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য সকল নাবী রাসূলগন অপেক্ষায় ছিলেন। এবং আসমান থেকে বহু ফেরেশতাদের আগমনও হয়েছিল। সকল নাবী রাসূলগন ও ফেরেশতাগন নামাজের কাতারবন্ধি ছিলেন। তখন জিব্রাঈল (আঃ) রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ইমামতি করার জন্য আগে বাড়িয়ে দিলেন এবং রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল নাবী রাসূলগনের নামাজের ইমামতি করলেন। আর এজন্যই তাঁকে ইমামুল আম্বিয়া বা ইমামুল মুরসালীন বলা হয়”। এর পরেই শুরু হয় ইসরা ও মি’রাজের দ্বিতীয় অংশ মি’রাজ তথা ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ।

 মি’রাজের পরিচিতি।

ইসলামী পরিভাষায় মি’রাজের হচ্ছে- “আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় তাঁর সান্নিধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ করাকে মি’রাজ বলে”। শরহে আক্বিদাতুত্ব-ত্বাহাবীতে ইমাম ত্বাহাবী (রহঃ) বলেছেন- “মি’রাজ হলো নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে একটি সত্য ঘটনা। নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সে রাতে জাগ্রত অবস্থায় স্ব-শরীরে ভ্রমণ করানো হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যতদূর ইচ্ছা করেছেন আকাশের দিকে উত্তোলন করেছেন। এবং তিনি যা ইচ্ছা তা দিয়ে সম্মানীত করেছেন। যা প্রত্যাদেশ করার ইচ্ছা তাই করেছেন”।

 মি’রাজের বাহনের পরিচিতি।

রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসরা ও মি’রাজের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কয়কটি বাহন ছিলো। আল্লামা আলাঈ (রহঃ) উনার তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- মোট পাঁচটি বাহন ছিলো। প্রথম বাহন ছিলো বুরাক্ব। যেটাতে আরোহণ করে তিঁনি মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত সফর করেন। দ্বিতীয় বাহন ছিলো মি‘রাজ (তথা সিঁড়ি) যার মাধ্যমে তিঁনি মাসজিদুল আক্বসা হতে প্রথম আসমানে যান। তৃতীয় বাহন ছিলো ফেরেশতাদের পাখা যার উপর আরোহণ করে তিঁনি প্রথম আসমান হতে চতুর্থ আসমান পর্যন্ত সফর করেন। চতুর্থ বাহন ছিলো হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এর পাখা, যার মাধ্যমে তিঁনি তথা হতে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত সফর করেন। পঞ্চম বাহন ছিলো রফরফ, যার দ্বারা তিঁনি সেখান হতে সফরের শেষ সীমা আরশে আজীমে যান। (মূলত মহান আল্লাহ যতদূর নিতে চেয়েছেন তথদূর গিয়েছেন)।

সাত আসমান পাড়ি দেওয়া ও নাবী রাসূলদের সাথে সাক্ষাৎ।

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের লম্বা একটি হাদীসে সাত আসমান পাড়ি দেওয়া ও মোট আটজন নাবী রাসূলদের সাথে সাক্ষাৎ করার কথাগুলো এসেছে। পাঠকের সুবিধার্থে আমরা প্রতিটি আসমানে কোন নাবীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে আলাদা করে উপস্থাপন করব ইনশা-আল্লাহ।

 প্রথম আসমানে হযরত আদম (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর আমাকে নিয়ে জিব্রাঈল (আঃ) চললেন। প্রথম আসমানে নিয়ে এসে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হলো, উনি কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। তখন বলা হলো, মারহাবা, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হলো। আমি যখন পৌঁছলাম, তখন সেখানে হযরত আদম (আঃ) এর সাক্ষাৎ পেলাম জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, উনি আপনার আদি পিতা আদম (আঃ) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিঁনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার পুত্র ও নেক্কার নাবীর প্রতি খোশ আমদেদ”।

 দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর উপরের দিকে চলে দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হলো কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। তারপর বলা হলো মারহাবা! উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে। তারপর খুলে দেওয়া হলো। যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন সেখানে হযরত ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ) এর সাক্ষাৎ পেলাম। তাঁরা দুজন ছিলেন পরস্পরের খালাত ভাই। তিনি (জিব্রাঈল) বললেন, এরা হলেন, ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ)। তাদের প্রতি সালাম করুন। তখন আমি সালাম করলাম। তাঁহারা জবাব দিলেন, তারপর বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নাবীর প্রতি খোশ আমদেদ”।

 তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এরপর তিনি আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানের দিকে চললেন, আসমানে পৌঁছে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হলো কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। তারপর বলা হলো মারহাবা! উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে। তারপর খুলে দেওয়া হলো। আমি তথায় পৌঁছে হযরত ইউসুফ (আঃ) কে দেখতে পেলাম। জিব্রাঈল বললেন, উনি ইউসুফ (আঃ) আপনি তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম, তিঁনিও জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নাবীর প্রতি খোশ আমদেদ”।

চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রীস (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর জিব্রাঈল (আঃ) আমাকে নিয়ে উপর দিকে চললেন এবং চতুর্থ আসমানে পৌঁছলেন। আসমানে পৌঁছে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হলো কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। তারপর বলা হলো মারহাবা! উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে। তারপর খুলে দেওয়া হলো। আমি হযরত ইদ্রীস (আঃ) এর কাছে পৌঁছলে জিব্রাঈল বললেন, উনি ইদ্রীস (আঃ)। তাকেঁ সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিঁনিও জবাব দিলেন। তারপর বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নাবীর প্রতি মারহাবা”।

 পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপর তিনি আমাকে নিয়ে উপর দিকে গিয়ে পঞ্চম আসমানে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো আপনি কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। বলা হল, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তথায় পৌঁছে হযরত হারূন (আঃ) কে পেলাম। জিব্রাঈল বললেন, উনি হারূন (আঃ) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম তিঁনিও জবাব দিলেন, এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নাবীর প্রতি মারহাবা”।

 ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর আমাকে নিয়ে যাত্রা করে ষষ্ঠ আসমানে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কে? তিনি বললেন, জিব্রাঈল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? তিঁনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। প্রশ্ন করা হলো, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। ফেরেশতা বললেন, তার প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তথায় পৌঁছে আমি মূসা (আঃ) কে পেলাম। জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, উনি মূসা (আঃ)। তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিঁনি জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার ভাই ও নেক্কার নাবীর প্রতি মারহাবা। আমি যখন অগ্রসর হলাম তখন তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কিসের জন্য কাঁদছেন? তিঁনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি যে, আমার পর একজন যুবককে নাবী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, যাঁর উম্মত আমার উম্মত হতে অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে”।

 সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর জিব্রাঈল (আঃ) আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানের দিকে গেলেন এবং দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হলো এ কে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, হাঁ। বলা হলো, তাঁর প্রতি মারহাবা। উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। আমি সেখানে পৌঁছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে দেখতে পেলাম। জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, উনি আপনার পিতা তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিঁনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্কার পুত্র ও নেক্কার নাবীর প্রতি মারহাবা”।

——- চলবে ইনশা-আল্লাহ

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ