“নিসফে শা’বান: করণীয় ও বর্জনীয়”
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তায়ালা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উসিলায় আমাদেরকে এমন কিছু দিন, রাত ও সময় দান করেছেন যা অন্য কোন নাবী রাসূলদের উম্মতের দেননি। সেই সমস্ত দিন, রাত বা সময়ে যদি আমরা তাঁর ইবাদতে মশগুল হয়ে তাঁকে ডেকে তাঁর কাছে আমাদের জীবনের গুনাহ মাফীর জন্য তাওবাহ করে ক্ষমা প্রার্থনা করি তাহলে তিঁনি আমাদের ডাক শুনেন ও ক্ষমা করেন। এরকম দিন, রাত ও সময়ের মধ্যে অন্যতম একটা রাত হচ্ছে নিসফে শা’বানের রাত। যেটা এশিয়া অঞ্চলে আবহমান কাল থেকে শবে বরাত হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমান অধুনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে এই রকতময় রাতকে বা রাতে ইবাদত করাকে কিছু সংখ্যক ভাই অস্বীকার করে থাকেন। যেটা সত্যিই দুঃখজনক। তারা বলতে চান ঐ রাতের সব গুলো হাদীস দুর্বল বা বানোয়াট। অথচ তারা যাকে মানেন সেই আলবানীও কমপক্ষে একটি হাদীসকে সহী বলেছেন!
আর মনে রাখবেন প্রায় সকল মুহাদ্দিসীগনের মতে আমলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়। আর নিসফে শা’বানের দূর্বল হাদীসগুলো কয়েকটি সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে তা হাসান হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কারণ দুর্বল হাদীস যে সমস্ত কারণে হাসান হতে পারে তার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে যদি হাদীসটি কয়েকজন বর্ননাকারী বর্ননা করেন। আর এই মত পাওয়া যায় মিরকাত, শামী ও মওদুআতে কবীরে। এবং আব্দুল হক মুসাদ্দীসে দেহলভী ও আল্লামা জুরজানীসহ অনেকেই উক্ত মত ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে ইমাম তিরমিজী (রহঃ) বলেছেন- এই কথার অর্থ এই নয় যে, এটা দুর্বল হাদীস তাই আমলের অযোগ্য। আর আলেমগন না জেনে আমল করেছেন এবং সকলেই ভ্রান্ত হয়ে গেছেন। বরং তার অর্থ হচ্ছে যে, হাদীসটি রেওয়ায়েতের দিক দিয়ে দুর্বল ছিলো। কিন্ত উলামায়ে কেরামদের আমলের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে গেছে।
সুতরাং আমাদের ভাইদের বলব এই রাতের ইবাদত করা যদিও ওয়াজীব বা ফরজ না কিন্ত ইবাদত করাটা নাজায়েজ না। তাই একটি জায়েজ কাজকে নাজায়েজ বলা থেকে বিরত থাকুন। কারণ ঐ রাতে যে আমলগুলো করা হয় তা কুরআন-সুন্নাহের আলোকেই করা হয়। এবং কুরআন-সুন্নাহের ভিত্তিতে সলফে সালেহীনদের আমল অনুযায়ী এই রাতে ইবাদত করা জায়েজ বা মুস্তাহাব। তাই আমরা খুব সংক্ষিপত পরিসরে উক্ত রাতে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো জানব ইনশা-আল্লাহ।
গোসল করা।
এই মোবারক রাত যেহেতু আপনি আল্লাহর ইবাদতে কাটানোর ইচ্ছা করেছেন সুতরাং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জন করার নিয়তে বুজুরগানে কেরাম বলেছেন মাগরিবের পরে চাইলে আপনি মুস্তাহাব গোসল করতে পারেন। কারণ পবিত্রতা অর্জনকারীদের আল্লাহ ভালোবাসেন। সূরা আল-বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন”।
ক্ববর যিয়ারাত করা।
এই বরকতময় রাতে আপনার মা-বাবা দাদা-দাদী, নানা-নানীসহ যেকোন মুসলিম নর-নারীর ক্ববর যিয়ারাত করতে পারেন। কারণ এটা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ করেছেন। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত বুরায়দাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি তোমাদেরকে ক্ববর যিয়ারাত করতে নিষেধ করতাম। (এখন অনুমুতি দিচ্ছি) তোমরা ক্ববর যিয়ারাত করতে পারো”।
আর নিসফে শা’বানের রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ক্ববর যিয়ারাত করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য হাদীসের কিতাবে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হারিয়ে ফেললাম (বিছানায় পেলাম না)। আমি (তাঁর সন্ধানে) বের হলাম। এসে দেখলাম তিঁনি জান্নাতুল বাক্বী কবরস্তানে আছেন। তিঁনি বললেন, তুমি কি ভয় করছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি কোন অবিচার করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমান করলাম আপনি আপনার অন্য কোন বিবির নিকটে গিয়েছেন। তিঁনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা মধ্য শা’বানে (১৫ তারিখের রাতে) দুনিয়ার কাছের আসমানে অবতীর্ণ হন। তারপর বানী কালব গোত্রের বকরীর পালের লোমের চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে তিঁনি মাফ করে দেন”।
নফল নামাজ আদায় করা।
এই বরকতময় রাতে আমরা নফল নামাজ আদায় করতে পারি। বিশেষ করে সালাতুন তাসবীর নামাজ ও তাহাজ্জুদের নামাজ। উক্ত রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব লম্বা সময় সিজদা দিয়ে নামাজ আদায় করতেন। সুনানে বায়হাকীতে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন রাতে নামাজ আদায় করছিলেন। তিঁনি সিজদায় গিয়ে এত দীর্ঘ সময় থাকলেন যে, আমার মনে হলো তাঁর ওফাত হয়ে গেছে! আমি তখন শোয়া থেকে উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, ফলে তিনি নড়ে উঠলেন। তখন আমি (বিছানায়) ফিরে গেলাম। অতঃপর তিঁনি সিজদা থেকে মাথা উঠালেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে বললেন, হে আয়শা! তুমি কি মনে করেছিলে যে, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার সাথে প্রতারণা করছেন? আমি বললাম আল্লাহর কসম আমি এমনটি মনে করিনি। বরং আপনার দীর্ঘ সিজদার কারনে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার ওফাত হয়ে গেছে! তখন তিঁনি বললেন, তুমি কি জানো এটি কোন রাত? আমি বললাম আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো অবগত আছেন। তিঁনি বললেন এটি মধ্য শা’বানের রাত। আল্লাহ তায়ালা এ রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করেন৷ যারা দয়া প্রার্থনা করে তাদেরকে দয়া করেন৷ তবে যারা বিদ্বেষী তাদেরকে তাদের অবস্থাতেই রেখে দেন”।
দোয়া ও তাওবাহ-ইস্তেগফার করা।
উক্ত রাত যেহেতু দোয়া ক্ববুলের রাত তাই আমরা এই রাতে বেশি বেশি তাওবাহ ইস্তেগফার করে জীবনের গুনাহ মাফীর জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতে পারি। এ রাতে গুনাহ মাফী চাওয়ার পাশাপাশি জীবনের যে কোন বিষয়ে মালিকের কাছে চাইতে পারি। কারণ আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য তিঁনি নিজেই আমাদের উৎসাহ দিচ্ছেন। সূরা গাফির এর ৬০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আপনার রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিরত থাকে তারা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে”। সূরা আল-বাকারার ১৮৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “(হে রাসূল!) আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার (অবস্থান) সম্বন্ধে জানতে চায় (তখন তাদের জানিয়ে দিন), আমি তো কাছেই আছি। কেউ যখন আমাকে ডাকে আমি তখন তার ডাকে সাড়া দেই। অতএব, তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমাকে (যথার্থভাবে) বিশ্বাস করুক যাতে তারা ঠিক পথে থাকতে পারে”।
উপরের দুটি আয়াতে কারীমা থেকে আমরা সহজ কথায় যা বুঝলাম তা হচ্ছে, আল্লাহ তায়াল তাঁর বান্দাদের ডেকে বলছেন তাঁকে ডাকার জন্য। তাঁর কাছে জীবনে যা দরকার তা চাওয়ার জন্য। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মহামহিম আল্লাহ তায়ালা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবস্থান করে ঘোষণা করতে থাকেন, কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিবো। কে আছে এমন যে, আমার নিকট চাইবে। আমি তাকে তা দিবো। কে আছে এমন যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করবো”।
সুতরাং এখানে সহীহ হাদীসে যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে রাতের শেষ দিকে বান্দাকে ডেকে তাঁর কাছে চাওয়ার কথা এসেছে তাই আমরা নিসফে শা’বানের রাতেও চাইতে পারি যেহেতু সব রাতের ভিতরেই এই রাত। এরপরও নিসফে শা’বানের রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা রাতের প্রথম দিকে পৃথিবীর আসমানে অবস্থান করে আমাদের ডাকেন। সুনানে ইবনে মাজাহ এর হাদীসে এসেছে- “হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো এবং এর দিনে রোজা রাখো। কেননা এ দিন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর থেকেই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর নিকটতম আসমানে অবস্থান করেন এবং বলেন, কে আছো আমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করবো। কে আছো রিযিকপ্রার্থী আমি তাকে রিযিক দান করবো। কে আছো রোগমুক্তি প্রার্থনাকারী, আমি তাকে নিরাময় দান করবো। কে আছো এই প্রার্থনাকারী। ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (তিঁনি এভাবে আহবান করেন)”।
মহা বরকতময় এই রাতে মহান আল্লাহর কাছে আমরা আমাদের জীবনের সকল গুনাহের জন্য তাওবাহ করে ক্ষমা প্রার্থনা করতেই পারি। কারণ এই রাতে তিঁনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন। সহীহ তাবারানী ও ইবনে হিব্বানসহ বেশ কয়কটি হাদীসের কিতাবে সহী সনদে একটি হাদীস এসেছে। যেটাকে বর্তমান সময়ের লা-মাযহাবী বা আহলে হাদীসদের গুরু আলবানীও সহী বলেছেন। আর ইমাম তাবারানী (রহঃ) বলেন নিসফে শা’বানের রাতে নফল ইবাদত করার জন্য উক্ত হাদীসটিই যথেষ্ট। হাদীসটি হচ্ছে- “হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে সমস্ত মাখলুকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন”।
এই মোবারক রাত দোয়া ক্ববুলের রাত সমূহের মধ্য অন্যতম একটি রাত। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, পাঁচটি রাত এমন আছে, যেগুলোতে বান্দার দোয়া আল্লাহ তায়ালা ফিরিয়ে দেন না, অর্থাৎ অবশ্যই ক্ববুল করেন। রাতগুলো হলো, জুমার রাত, রজবের প্রথম রাত, শাবানের ১৫ তারিখের রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্বহার রাত”। সুতরাং আসুন চেষ্টা করি গুনাহের গন্ধে কলুষিত আত্মাকে তাওবাহ-ইস্তেগফারের মাধ্যমে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে পবিত্র রামাদ্বানের জন্য প্রস্তুতি গ্ৰহণ করি এই মোবারক রাতে। সূরা বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন”।
পনের শা’বান নফল রোজা রাখা।
পবিত্র শা’বান মাসের নফল রোজা সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় সারা মাস রোজা রাখতেন। সুতরাং পনের শা’বানে আমরা নফল রোজা রাখতে পারি যেহেতু সারা মাসের ভিতরে পনের তারিখও আছে। আবার প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার মধ্যে ও পনের তারিখ আছে। এবং এই দিনে রোজা রাখতে শরীয়তের কোন নিষেধ নেই। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা’বান মাসের চাইতে বেশী (নফল) রোজা কোন মাসে পালন করতেন না। তিঁনি (প্রায়) পুরো শা’বান মাসই রোজা রাখতেন এবং তিঁনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু (নফল) আমল করো, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) পরিশ্রান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা (সাওয়াব দান) বন্ধ করেন না”।
সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার বন্ধু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা পালন করা (১৩,১৪ ও ১৫) এবং দুই রাকাত স্বালাতুদ্ব-দ্বুহা (চাশত) এবং ঘুমানোর পূর্বে বিতর নামাজ আদায় করা”। “সুনানে ইবনে মাজাহ এর হাদীসে এসেছে- “হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো এবং এর দিনে রোজা রাখো”।
ইবাদত কোথায় করবেন?
গুনাহ মাফীর এই রাতে আল্লাহর ইবাদত কোথায় করবেন? অনেকেই বলেন যে যেহেতু নফল ইবাদত তাই নিজ ঘরে ইবাদত করবে। এটা সুন্দর একটি কথা হলেও মাসজিদে নফল ইবাদত করতে শরীয়তে কোন বাধা নেই। বরং একজন মুসলমানের জন্য ইবাদতের উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে দুনিয়ার জমীনে সবচেয়ে পবিত্র ঘর আল্লাহর মাসজিদ। তাই সলফে সালেহীনদের আমলের মধ্য অন্যতম একটি আমল হচ্ছে এই সমস্ত বরকতময় যত রজনী আছে সেই সমস্ত রজনীতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদত করা। কারণ কোন মানুষ একা ঘরে বসে থাকলে ইবাদত নাও করতে পারে বা ইবাদতে মন নাও বসতে পারে। কারণ ঘরে ছেলে মেয়েসহ পরিবারের অনেক সদস্য থাকেন। যাদের কারনে ইবাদতে মন না আসার কারণে এই রাত থেকে সে মহরূম হতে পারে। আবার সবাই একত্র হয়ে ইবাদত করলে আল্লাহ তায়ালা সবার মধ্য থেকে যে কোন একজন নেক্কার বান্দার উসিলায় বাকি সবাইকে ক্ষমা করে দেন। সুতরাং নিঃসন্দেহে আমরা আল্লাহর ইবাদত করার জন্য ঐ সমস্ত রজনীতে আল্লাহর ঘরে একত্র হতেই পারি। আর যারা বিভিন্ন কৌশলে আমাদের মাসজিদ বিমুখ করে রাখেন তাদের সম্পর্কে সূরা আল-বাকারার ১১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর ইরশাদ হচ্ছে- “যে ব্যক্তি আল্লাহর মাসজিদ সমূহে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং তা ধ্বংসের পাঁয়তারা করে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে? এ ধরনের লোকদের তো সেখানে নির্ভয়ে প্রবেশ করারই কথা নয়। তাদের জন্য দুনিয়াতে লাঞ্ছনা আর আখেরাতে বড় রকমের শাস্তি নির্ধারিত আছে”।
বরকতময় রাতে বর্জনীয় কাজ।
নিসফে শা’বানসহ যে সমস্ত বরকতময় রাত বা দিন আছে সেগুলোর জন্য আমরা যেন সারা বছরের ফরজ, ওয়াজীব ও সুন্নাত কাজগুলো ছেড়ে না দেই। অনেকেই আছেন সারা বছর ফরজ নামাজ আদায় না করে ঐ সমস্ত রাত বা দিনের জন্য অপেক্ষা করেন। যেটি অত্যন্ত খারাপ একটি অভ্যাস। আবার নিসফে শা’বানে অনেকেই রাতে ঘরের সব আলো নিবিয়ে সামনের দরজায় একটি মোমবাতি জালিয়ে রাখেন যা শরীয়ত বিরোধী কাজ। আবার অনেকেই ফটকা ফুটায় যা একটি শয়তানী কাজ। হালুয়া রুটি বা অন্য যেকোন ধরনের রুটির আয়োজন করা থেকে বিরত থাকবেন যেহেতু উক্ত রাত ইবাদতে মশগুল থাকার রাত। বিভিন্ন ধরনের আলোকসজ্জা দিয়ে বাড়ি-ঘর বা মাজার সাজানো মোটেই উচিত নয়। কারণ ঐ রাতটাতো আনন্দ প্রকাশ করার বা কারো বিয়ের রাত নয়। বরং ঐ রাত জীবনের সব গুনাহের জন্য মহান আল্লাহর কাছে তাওবাতুন নাসুহা করার রাত। আবার দলবদ্ধ হয়ে খুব হৈ হুল্লুড় করে ইবাদতকে আবশ্যক মনে করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
মনে রাখবেন ঐ সমস্ত মোবারক বা সম্মানীত রাতে বা দিনে কোন ধরনের অপচয় করবেন না। এটা হতে পারে বিভিন্ন ধরনের লাইটিং করে টাকার অপচয়, হতে পারে খাওয়ার অপচয় বা সময়ের অপচয়। কারণ অপচয়কারীদের আল্লাহ ভালোবাসেন না এবং তারা শয়তানের ভাই! সূরা ইসরা এর ২৭ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “অপব্যয়কারীরা শয়তানদের ভাই। আর শয়তান তার প্রভুর প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ”। সূরা আনআমের ১৪১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আর অপচয় করবেন না। নিশ্চয়ই তিঁনি অপচয়কারীদের ভালবাসেন না”। আবার এমন কোন কাজ করা যাবে না যেটা ইসলামী শরীয়ত সম্মত নয়। বরং বিধর্মীদের কাজের সাথে মিল থাকে। এরকম কাজ যারা করবে তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কঠিন হুঁশিয়ারি করেছেন। সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যাক্তি কোন বিধর্মীদের অনুসরণ করবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে”।
আল্লাহ তায়াল আমাদের সঠিক জানার, বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন। ঐ বরকতময় রাতের তামাম ফজিলত আমাদের দান করুন। ঐ রাতের উসিলায় আমাদের জীবনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিন। রামাদ্বানুল মোবারক পর্যন্ত আমাদের হায়াত বাড়িয়ে দিন। (আমিন)
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান