বরকতময় রামাদ্বান: করণীয় কাজ


রাহমাত, বারাকাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাহিনা পবিত্র মাহে রামাদ্বানের ফরয রোজা রাখার পাশাপাশি
আমাদের আরো অনেকগুলো কাজ রয়েছে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক। যেগুলো করলে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হবে ইনশা-আল্লাহ।

 রামাদ্বান মাসকে সম্মান করা।

আল্লাহ তায়ালার গননায় বারটি মাসের মধ্যে অন্যতম সম্মানীত মাস হচ্ছে পবিত্র রামাদ্বান। আর সম্মানী কোন কিছুকে সম্মান করতেই হয়। এটা ইসলামী শরীয়তের অন্যতম নীতি। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা হজ্জের ৩২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “এটাই হলো আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই”।

সুতরাং এই মাসে যদি কেউ কোন কারণে রোজা নাও রাখতে পারেন তাহলে সম্মান প্রদর্শন করার জন্য রোজাদারের সামনে না খাওয়া উত্তম। আর বিশেষ করে এই মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাই হবে তাকওয়ার পরিচয়।

 রোজা রাখা।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে রামাদ্বান মাসের রোজা রাখা। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয করে দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো”।

রোজার অনেক ফজিলত রয়েছে। হাদিস শরীফের মধ্যে এসেছে রোজার বদলা আল্লাহ নিজ হাতে দিবেন। এমনকি রোজাদারের জন্য জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে যেটা দিয়ে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, রোজা পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে”।

আমরা অনেকেই মনে করি যে, দিনের বেলায় উপোস করার নাম রোজা। আসলে প্রকৃত পক্ষে শুধু উপোস থাকার নাম রোজা নয়। বরং উপোস থাকার পাশাপাশি আপনার সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গের রোজা আছে। যেমন, হাত, চোখ, কান, জবান ও পায়ের রোজা ইত্যাদি। এই সবকিছুকে আপনি খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। যেহেতু রোজার অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। এমনকি রামাদ্বান মাসে দিনের বেলায় অনেক হালাল কাজও হারাম হয়ে যায়।

 পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা।

একজন মানুষ ঈমান আনার পর ইসলামী শরীয়তে যে কাজটি তাকে প্রথম করার নির্দেশ দেয়, সেটা হচ্ছে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। এই বিষয়ে কুরআন শরীফে সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। এবং হাদীসের কিতাবে অসংখ্য হাদীস রয়েছে।

সুতরাং রামাদ্বান মাস যেহেতু একটা সম্মানিত মাস এবং এ মাসে একটা সাওয়াবের বদলা অন্য মাসের চাইতে সত্তর গুন বেশি তাই আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার চেষ্টা করবো।

 তাকওয়া অর্জন করা।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর রোজা কেন ফরয করেছেন সেটি সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো”। সুতরাং এই মাস হচ্ছে মুমিন মুসলমানের তাকওয়া অর্জন করার অন্যতম একটি সুযোগ।

 সাহরী ও ইফতার করা।

রামাদ্বান মাসের রোজা রাখার নিয়তে সাহরী খাওয়া ও সময়মতো ইফতার করা অন্যতম একটি সুন্নাত। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা সাহরী খাও, সাহরীতে বারাকাত রয়েছে”।

সহীহ মুসলিম শরীফের আরেক হাদীসে এসেছে- “হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমাদের ও কিতাবীদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া”।

সহীহ মুসলিম শরীফের অন্য আরেকটি হাদীসে এসেছে- “হযরত সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যতদিন মানুষ বিলম্ব না করে ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে”।

 তারাবীর নামাজ আদায় করা।

রামাদ্বান মাসে তারাবীর নামাজ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক হাদীস পাওয়া যায়। তাই যারা সুস্থ আছেন তারা সবাই প্রতিদিন বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করা উত্তম হবে। এর ফজিলত সম্পর্কে বুখারী শরীফে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রামাদ্বান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রামাদ্বানে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রামাদ্বান অর্থাৎ তারাবীর নামাজ আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে”।

কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করা।

রামাদ্বান মাস হচ্ছে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণের মাস। আর এই মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি তা তেলাওয়াত করতেন। সুতরাং আমরাও যেন সেটাই করি। সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “রামাদ্বান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে”।

কুরআনুল কারীম তেলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ উমামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ করো। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে”।

 তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া।

নফল নামাজ সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন। কুরআনুল কারীমের সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করুন আপনার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন”।

সূরা মুযাম্মিলের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “রাতে নামাজে দাঁড়ান কিছু অংশ ছাড়া। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম”।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- রামাদ্বানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা এবং ফরয নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হচ্ছে রাতের নামাজ”।

 দান-সাদাকাহ করা।

আল্লাহর রাস্তায় দান-সদাকাহ করার অনেক ফজিলত রয়েছে। আর সেটা যদি রামাদ্বান মাসে করা যায় তাহলে তার সাওয়াব সত্তর গুন বেশি পাওয়া যাবে ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহর রাস্তায় দানকরীদের সম্পর্কে সূরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”।

আল্লাহর রাস্তায় দান-সদাকাহ করলে পাহাড় পরিমান সাওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি (তার) বৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ থেকে একটি খেজুর পরিমাণও কিছু দান করে, আর আল্লাহ তো বৈধ অর্থ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণই করেন না, সে ব্যক্তির ঐ দানকে আল্লাহ ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তা ঐ ব্যক্তির জন্য লালন-পালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ তার অশ্ব-শাবককে লালন-পালন করে থাকে। পরিশেষে তা পাহাড়ের মত হয়ে যায়”।

 ইতিকাফ করা।

রামাদ্বান মাসে ইতিকাফ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম একটি আমল ছিলো। আর এটা আমাদের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। তাই সময় সুযোগ থাকলে এটা করা অনেক সাওয়াবের কাজ হবে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদ্বানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন”।

 লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করা।

এই রাত সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে সূরা ক্বদর নামে একটি সূরাই আল্লাহ নাযিল করেছেন। সেই সূরার ৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম”।

সুনানে ইবনে মাজাহ ও তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় যে লোক লাইলাতুল ক্বদরের (ইবাদাতের জন্য) রাতে জেগে থাকে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়”।

 সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা।

রামাদ্বানের রোজা পালন করার শেষে আমাদের মাঝে খুশির বার্তা নিয়ে আগমন করে ঈদুল ফিতর। এই আন্দদে সবাইকে সামিল রাখতে ঈদের নামাজের আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কড়া নির্দেশ রয়েছে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রত্যক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতের বের হবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন”।

সর্বোপরি এই মাস হচ্ছে তাওবাহ, ইস্তেগফার ও দোয়া ক্ববুলের মাস। তাই ফরয রোজা, ফরয নামাজ ও নফল ইবাদত করার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে জীবনের সব গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি চেয়ে জান্নাত কামনা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রামাদ্বানের রোজাগুলো রাখার পাশাপাশি সকল নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

আরও সংবাদ