মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তিগাঁথা

বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ আজ স্বপ্নের মতো করে জীবন যাপন করছে। এখন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বেশী অবদান কার? খুব দ্রুত উত্তর আসবে পশ্চিমাদের! প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনে তাদের অবদান জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠছে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ যদি বলা হয় কম্পিউটার কে আবিষ্কার করেছে?বলা হবে বিখ্যাত গণিতবীদ চার্লস ব্যাবেজ। ফেসবুক প্রোগ্রামার মার্ক জুকারবার্গ।পুনরায় যদি বলা হয় বল তো বেতার যন্ত্রের আবিষ্কারক কে?নির্দ্বিধায় অবশ্যই বলে ফেলা যাবে ‘গুগলিয়েলমো মার্কনি। এভাবে জগদীশ চন্দ্র বসু,টিম বারনাস লি,বিল গেটস,ড্যাভিড হ্যানসেন,স্টিফেন হকিং প্রমুখ বিজ্ঞানীদের নাম ভেসে আসবে তাদের আবিষ্কৃত বস্তুতির নাম বলার সাথে সাথে।
কিন্তু মুসলমান বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার কোথায়? এতো বড় একটি ধর্মীয় প্লাটফর্ম, তাদের কোন আবিষ্কার নেই! নাস্তিকদের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা কী একবারের জন্য ভেবে দেখেছি ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে হঠাৎ করে কীভাবে বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক আবির্ভাব ঘটলো, তাদের এই অগ্রগতির রহস্য কী?
আমাদের এই রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাদেরকে অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে অতীতের ইতিহাস জানতে হবে। তাহলে সকলে একথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, বিজ্ঞানের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রতিটি পরতে পরতে মিশে আছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান! ২০১০ সালে CNN একটা রিপোর্ট বের করে, যার শিরোনাম ছিল –
“যে মুসলিম আবিষ্কারগুলি আধুনিক সভ্যতার আকৃতি প্রদান করেছে “। ইতিহাস বিকৃত করার মিছিলে হারিয়ে গেছে সকল মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম। তাদের রচিত প্রত্যেকটি বইয়ের ভাষান্তর করার সাথে মুসলিম বিজ্ঞানীদের নামও বদলে ফেলা হয়েছে, যার ফলে তাদের নাম দেখে বুঝার কোন উপায় নেই যে তারা মুসলান নাকি বিধর্মী। যেমন ধরুন ইবনে সিনার পূর্ণ নাম আবু আলি আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সীনা। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম ‘আভিসিনা'(Avicenna)। বীজগণিতের জনক খাওয়ারিজমি এর পূর্ণ নাম আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। ল্যাটিন ভাষায় তার নাম ‘এলগোরিজম'(Algorism)। ইবনে বাজ্জাহ এর পূর্ণ নাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইহাইয়া ইবনে আল সায়িগ,কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম ‘অ্যাভামপস'(avempace)। এভাবে সমস্ত বিজ্ঞানীদের নাম কে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। শুধু মাত্র তাদের নাম নয় খোদ পরিচয় নিয়েও করা হয়েছে ব্যাপক কারসাজি।
ইতিহাসের কালো অক্ষরগুলো বিধর্মীরা বিকৃত করে এমনভাবে সাগরের অতল তলদেশে নিক্ষেপ করেছে যেখান থেকে সেই গৌরবময় মুসলিমদের বিজ্ঞানে অবদানের ইতিহাস কুড়িয়ে আনা বেশ কষ্টসাধ্য। তাইতো মুসলিম শিশুদের জানার কোন উপায় নেই যে, এই বিজ্ঞানে আমরা মুসলমানদের অবদান ও অনস্বীকার্য। আজকে মিডিয়ার মিথ্যাচার আর ইতিহাস বিকৃতির খেলায় আমাদেরকে হারিয়ে আমাদের আবিষ্কৃত বস্তু দিয়ে আমাদের লজ্জা দেওয়া হয়। বিজ্ঞানের এই বৈপ্লবিক অগ্রগতিতে মুসলিম সম্প্রদায় পিছিয়ে পড়ার কারণে পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের ভাগ্য বিধাতা হয়েছে, আমাদের অবস্থা হয়েছে জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর! তারা যা বলছে কোনরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই মেনে নিচ্ছি। এই করুণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের জন্য বিজ্ঞানে মুসলমানদের সঠিক অবদান সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখতে হবে।
৭৫০-১২৫৮ ছিলো ইসলামী রেনেসাঁর স্বর্ণযুগ, এই সময়ে বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় শাখায় ছিলো মুসলমান বিজ্ঞানীদের জয়জয়কার! এখনো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদেরা শ্রদ্ধাভরে মুসলিম বিজ্ঞানীদের এসকল অমর কীর্তিগুলো স্মরণ করলেও কিছু পাতি নাস্তিক যারা মুসলমানদের এই অবদান স্বীকার করতে তাদের স্বর যেন স্তব্ধ হয়ে যায়, এরা মূলত নাস্তিক না বরং ইসলাম বিদ্ধেষী। তাদের শুধু মাথাব্যথা মুসলিম বিজ্ঞানীদের নিয়ে। বিজ্ঞনের অগ্রগতি নিয়ে অধ্যাপক জি সারটন তার গ্রন্থে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানের প্রতি অত্যন্ত বিনয় ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন:
এখানে মুষ্টিমেয় কিছু নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে।সাময়িককালে পাশ্চাত্যে তাদের সমতুল্য কেউ ছিলোনা। তারা হলেন:জাবির ইবনে হাইয়ান,আল কিন্দি,আল খাওয়ারিজমি,আল ফারগানি,আল রাজি,ছাবেত ইবনে কোররা,আল বাত্তানি, হুনায়ন ইবনে ইসহাক,আল ফারাবি,ইব্রাহীম ইবন সিনান,আল মাসুদী,আল তাবারীআবুল ওয়াফা,আল ইবনে আব্বাস, আবুল কাসিম, ইবনে আল জাযারি,আল বেরুনি,ইবনে সীনা,ইবনে ইউসুফ,আল কাশি,ইবনে আল হাইছাম,আলি ইবনে ঈশা, আল গাজ্জালি, আল জারকাব,এবং ওমর খৈয়াম।গৌরবোজ্জ্বল নামের তালিকা দীর্ঘ করা মোটেও কঠিন হবেনা।যদি কেউ আপনার সামনে উল্লেখ করে যে,মধ্যযুগ ছিলো অন্ধকার যুগ বৈজ্ঞানিক দিক থেকে অনুর্বর তাহলে তার নিকট এসব নাম উল্লেখ করুন,তাদের সবাই ৭৫০-১১০০সাল পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে সমৃদ্ধি করেছিলেন।
জ্ঞানবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ ছিলো মধ্যযুগ, এই যুগ ছিলো মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করার যুগ। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবেত্তাগন মধ্যযুগকে অসভ্য বর্বর বলে মুসলমানদের আবিষ্কার গুলোকে জনসম্মুখ থেকে লুকিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদেরকে অতীত ইতিহাস থেকে জানতে হবে, আমাদের কী গর্ব অহংকারের কোন আবিষ্কার নেই?
এইচ এ সালমান তার রাইজ এন্ড ফল অব দি অ্যারাব ডেমিনেশন এ লিখেছেন : আরবরাই বিশ্বের কাছে প্রথম গ্রীক গ্রন্থাকারদের পরিচিত করে তোলেন।তারা জ্ঞানের বাতি প্রজ্বলিত করে যা ইতিহাসের অন্ধকার পৃষ্ঠাগুলোকে আলোকিত করেছে এবং খুব স্বাচ্ছন্দ্যে এ কথা বলতে হয় যে,আরবরাই জ্ঞানের এ মশাল প্রজ্বলিত না করলে আজকের সভ্যতা ও অগ্রগতির প্রাণকেন্দ্র ইউরোপকে জ্ঞানের শিখায় পৌছতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো।
বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান বিষয়ে ইতিহাসবিদদের বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে মধ্যযুগে বিজ্ঞানিদের অবদান যদি না থাকতো তাহলে আজকের বিজ্ঞান সমৃদ্ধি লাভ করতে আরো ব্যাপক সময় লেগে যেতো।
“বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান” বিষয়ে যদিও এতো প্রমাণ আর যুক্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই তবুও দিতে হচ্ছে কারণ ইতিহাসের উজ্জ্বল পাতাটির সাথে আমরা পরিচিত নই।
কোন প্রমাণ ছাড়া যদি বিজ্ঞানী আর বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয় তবে তা বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্টসাধ্য হবে।অপরিচিত মানুষকে চিনতে চিনতে যেমন কষ্ট হয়।
বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান আছে তা সম্পর্কে আমরা এতক্ষণ জানলাম কি বিষয়ে কে আবিষ্কার করেছেন তা আমরা জানার গভীর আগ্রহ রাখি।তা সম্পর্কে ইতিহাসের সোনালী অধ্যায় থেকে কালো কিছু অক্ষর তুলে ধরছি।
ওমর খৈয়াম : অ্যানলিক্যাল জ্যামিতির জনক বলা হয় ওমর খৈয়ামকে।সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি জন্মগ্রহন করেন। শৈশবের কিছু সময় কেটেছে আফগানিস্তানের বলখ শহরে। দিনের বেলায় তিনি জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়াতেন এবং রাতে ইমাম মোয়াফেফ্ক নিশাপুরির দরবারে পরামর্শ প্রদান করতেন। জীবদ্দশায় ওমর খৈয়ামের খ্যাতি ছিল গণিতবিদ হিসেবে। তিনি প্রথম উপবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরনের সমাধান করেন। ওমর খৈয়ামের বড় অবদান ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে তার পুস্তক ‘মাকালাত ফি’ আল জার্ব আল মুকাবিলা প্রকাশিত হয়। এ পুস্তকে তিনি দ্বিঘাত সমীকরনের সমাধানের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেন।
আল বিরুনি : বিশ্বের সেরা ভু-গোলবিদ আল বিরুনি পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি জ্ঞান অজর্নের জন্য সারাবিশ্ব ভ্রমন করেন। ৯৯৮ খৃষ্টাব্দে তিনি উত্তর ইরানের জুরজান নামক শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ শহরেই তিনি তার গবেষনা চালিয়ে যান বই লেখেন এবং জ্ঞান অর্জনে রত থাকেন। আল বিরুনি ভু-বিদ্যার একজন পথ প্রদর্শক। তিনি শতাধিক বিভিন্ন প্রকার ধাতু ও রত্নপাথর সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা করেন। একাদশ শতাব্দীতে পৃথিবী কীভাবে এর কক্ষপথে ঘূর্নায়মান এর প্রমাণ দেন। তিনি স্থিতি বিদ্যা ও গতিবিদ্যাকে একত্রিত করে বলবিদ্যা নামক গবেষনার নতুন ক্ষেত্রের প্রবর্তন করেন।
আল রাজি : গুটি বসন্ত আবিষ্কারক আবু বকর মুহাম্মদ ইবন জাকারিয়া আল রাজি ৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহন করেন। আল রাজি ছিলেন একজন দক্ষ পারশিয়ান চিকিৎসক ও দার্শনিক। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা, আলকেমি ও অন্যান্য বিষয়ের উপর ১৮৪ টিরও বেশী বই লিখেছেন। তিনি সালফিউরিক এসিড ( ঐ২ঝঙ৪ ) আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন, বিশোধন ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন।
আল ফারাবি : বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল আরাবির আসল নাম আবু নাসের মুহাম্মদ ইবনে ফারাখ আল ফারাবি। তার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফারাবায়। সেখানে শিক্ষাজীবনের কিছুদিন পর তিনি বোখরায়। তার পর উচ্চ শিক্ষা লাভেরে জন্য বাগদাদে চলে যান। সেখানে তিনি সুদীর্ঘ ৪০ বছর অধ্যয়ন ও গবেষনা করেন। পদার্থ বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তবে বিজ্ঞান ও দর্শনে তার অবদান ছিল সর্বাধিক। পদার্থ বিজ্ঞানে তিনিই ‘শূন্যতার’ অবস্থান প্রমান করেছিলেন।
আল বাত্তানি : ৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মোসোপটেমিয়ার অন্তর্গত বাত্তান নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ছিলেন একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ ও জোতির্বিদ। তিনি সর্বপ্রথম নির্ভুল পরিমাপ করে দেখিয়েছেন যে, এক সৌর বছর ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে হয়। তিনি প্রমান করে দেখিয়েছেন সূর্যের আপাত ব্যাসার্ধ বাড়ে ও কমে। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহন সম্পর্কেও তার বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। আল বাত্তানি তার নিজস্ব উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে প্রমান করেছিলেন যে, সূর্য তার নিজস্ব কক্ষপথে গতিশীল। আল বাত্তানি ছিলেন একজন মশহুর জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ। তিনি বহু বছর ধরে জ্যোতির্বিদ্যায় প্রচলিত ভূলগুলো সংশোধন করে এই শাখায় অনেক সংস্কার ও উন্নতি সাধন করেন। এই মহান মনীষী ৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ৭২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
ইবনে সিনা : ইবনে সিনা ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বোখারা শহরে জন্মগ্রহন করেন। ইবনে সিনা দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে যুক্তি বিদ্যা, হিসাব বিজ্ঞান, অঙ্ক ইত্যাদি বিষয়ে গবেষনা করেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে সমকালীন জ্ঞানী গুণী, চিকিৎসক ও মনীষীদের পড়িয়েছেন। ফলে বুঝা যায় তিনি ছিলেন সে সময়কার বড় চিকিৎসক। কথিত আছে ইবনে সিনা যখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর মাসসপটে স্বপ্নের মত ভাসত। তার জ্ঞানের দরজা খুলে যেত। বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে সর্বত্র তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি মুজমুয়া নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। ইবনে সিনা পদার্থ বিজ্ঞান দর্শন, ধর্মতত্ত¡, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তার সময়ের সেরা চিকিৎসক।
মুসা আল খাওয়ারিজমি : মুসা আল খাওয়ারিজমি পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। তিনি মধ্য এশিয়ার খাওযারিজম নামক শহরে ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূ-গোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতিতে প্রভূত ভূমিকা রাখেন। বীজগনিতে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার “আলজাবর ওয়াল মুকাবিলা” বই থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠ মুসলিম। তিনি ছিলেন একজন জগৎবিখ্যাত গণিতবিদ। তার সময়ে গণিতে অনেক উন্নতি হয়। ভূ-গোল বিষয়ে ছিল তার বিরাট অবদান। তিনি তার প্রথম একটি বইয়ে অ্যালজেবরার নাম উল্লেখ করেন। তার এ বইটির নাম হলো আল জাবর ওয়াল মুকাবিলা। পাটিগণিত বিষয়ে তিনি একটি বই রচনা করেন, যা পরে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। বতর্মান যুগ পর্যন্ত গণিতের যে উন্নতি তার মূলে রয়েছে আল খাওয়ারিজমির অবদান। তার রচিত বই আলজাবর ওয়াল মুকাবিলা থেকে বীজগথিতের ইংরেজী নাম অ্যাল জেবরা উৎপত্তি লাভ করে।
ইবনুন নাফিস : ইবনুন নাফিস একজন বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞাননী। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রে তার অবদান অবিস্মরনীয়। ইবনুন নাফিস মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি, শাশ্বনালি, হৃৎপিন্ড শরীরে শিরা উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। তিনি মানবদেহে রক্ত চলাচল সম্পর্কে গ্যালেনের মতবাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং এ সম্পর্কে নিজের মতবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন।
জাবির ইবনে হাইয়ান : বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান আল আজদি আস সুফি আল ওমাবি আরবের বাসিন্দা আজদি গোত্রের হাইয়ান ছিলেন তার পিতা। চিকিৎসক পিতার সন্তান হলেও সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে তার পিতাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করলে বাল্যকালে তিনি চরম দুঃখেকষ্টে পতিত হন। শৈশবে তিনি কুফায় বাস করে। তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি আরবে ফিরে আসেন। কুফায় থাকাকালীন অবস্থায় তিনি রসায়ন শাস্ত্রে গবেষনা করেন এবং তথায় একটি রসায়ন গবেষনা গার প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিক ইতিহাস বিদরা ইহাকে পৃথিবীর প্রথম রসায়নাগার বলে অভিহিত করেন। রাসায়নশাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি চিকিৎসা, খনিজ পদার্থ, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি অবদান রাখেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৫০০ সহ প্রায় ২ হাজার বই রচনা করেন এই মনীষী।
আল বলখি : জাফর ইবনে মুহাম্মদ আবু মাশার বলখি ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। মুসলিম জ্যোতির্বিদদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তিনি ছিলেন একই সাথে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, গণিতবিদ। তার কাজ ও অবদান এখনো সর্বমহলে প্রশংসনীয়।
আল কিন্দি : আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কান্দি ছিলেন কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইতিহাস, দর্শন ভাষাতত্ত, রাজনীতি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে অবস্মরনীয় বিশারদ। আল কিন্দি ছিলেন গ্রিক, হিব্রু, ইরানি, সিরিয়াক ও আরবী ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। তার বহুল পঠিত নানা বিষয়ে ২৬৫ খানা গ্রন্থ রচনা করেন।
আল সাইগ : প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, পদার্থবিদ মনোবিজ্ঞানী কবি এবং বিজ্ঞানী আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে আল সাইগ। তিনি ইবনে বাজ্জাহ নামে বেশি পরিচিত। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভূতপূর্ন ভূমিকা রাখেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে তার যথেষ্ঠ সুনাম ছিল।
আ’লা হযরত ইমাম আহমেদ বেরলভী (রহঃ) : আ’লা হযরত ইমামে আহমেদ বেরলভী ১০ ই শাওয়াল ১২৭২ হিজরী ১৪ই জুন ১৮৫৬ সনে ভারতের বেরলভীতে জন্মগ্রহন করেন। আ’লা হযরত ইমাম বেরলভী যুক্তিবিদ্যা, গণিত, জ্যোর্তিবিদ্যা ও জ্যামিতিতে যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বীজ গনিতে, ত্রিকোনোমিতি ছাড়াও তিনি লগারিদমের ধারনাকে সুবিন্যস্ত করেন। ধর্মীয় বিষয়াবলীতে গভীর ব্যুৎপত্তি অজনের পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ সকল বিষয়ে তাঁর অবদান সমসাময়িক ভারত ও পশ্চিমা বিজ্ঞানের হতবাক করে দিয়েছে। তাই জ্ঞানীরা তাকে জ্ঞানী নয় জ্ঞান বলেই মেনে নিয়েছে। আ’লা হযরত শব্দতত্ত্বের উপর ১৩৩৬ হিজরীতে, আল-বারানু শাফিয়া সিফনোগ্রাফিয়া কিতাবটি রচনা করেন। আ’লা হযরত পদার্থ বিজ্ঞানে আলোক রশ্মিতত্ত্ব নিয়ে গবেষনা করে রিফ্লেকশন অব লাইট, টোটাল ইনটারনাল রিফ্লেকশন, থিত্তরিস অব লাইট, লস অব লাইট জিওমেট্রিক অবটিকস, অ্যাটমস্ফিয়ার রিফ্রেকশন, রিভারসাল রেইস অব লাইট এন্ড ফরমেশন ইমেজ ইত্যাদি বিষয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন।
এছাড়াও আরো অনেক বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা বিভিন্ন বিষয়ে আবিষ্কার করে অমর হয়ে আছেন। তারা হলেনঃ
ত্রিকোণমিতির জনক-আবুল ওয়াফা।
স্টাটিক্সের জনক-ছাবেত ইবনে কোরা
এলজাব্রার প্রথম উচ্চতর পাওয়ার ব্যাবহারকারী-আবু কামিল।
এভাবে অসংখ্য বিজ্ঞানী আর তাদের আবিষ্কারের নাম আসতে থাকবে।
সুতরাং এর থেকে স্পষ্ট হতে পারি,”বিজ্ঞানে মুসিলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অনস্বীকার্য।
শুধু মধ্যযুগে নয় বর্তমান বিশ্বেও মুসলমানগণ বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন, কিন্তু মিডিয়ার মিথ্যাচার আর সত্য গোপনের মিছিলে হারিয়ে যাচ্ছে এসব আবিষ্কারকের নাম। এসব আবিষ্কারের জনক হিসেবে পশ্চিমারা অবৈধভাবে দাবী করছে। এরকম কিছু আবিষ্কার হলোঃ
Bridge pavilion এবং দুবাইয়ের Dancing tower এর সৃষ্টিকর্তা ইরাকি আর্কিটেক্ট যাহা হাদিদকে নিশ্চয় চিনেন। প্রথমবারের মত Bridge pavilion সৃষ্টি করে যিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি আসলে মুসলিম হিসেবেই আর্কিটেকচারে অবদান রাখার জন্য pritzker prize পেয়েছেন।
২০১৩ সালে র্যাপিড ব্যাটারি চার্জার আবিষ্কার করে ১৮ বছর বয়সী মুসলিম তরুনী ঈশা খায়ের। যা দিয়ে ২০ সেকেন্ডের ভিতরেই মোবাইলের ব্যাটারী চার্জ করা সম্ভব। এটার প্রতি গুগলের মত প্রতিষ্ঠান হাত বাড়িয়েছে যাতে তারা নতুন ডাবল লেয়ার সুপারকন্ডাক্টর তৈরি করতে পারে।
২০১০ সালে মুক্তি পায় স্যামসাং গ্যালাক্সি ট্যাব। এর ডেভলাপার কে ছিল জানেন??
স্যামস্যাং এর চিফ টেকনোলজি অফিসার ওমর খান !!
বাংলাদেশী প্রোগ্রামার জাওয়াদ করিমকে নিশ্চয় চিনেন। যিনি ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তার আরেকটি পরিচয় রয়েছে, তিনি ২০০০ সালে paypal এর জন্য রিয়েল টাইম এন্টি ফ্রড সিস্টেম তৈরি করেন।
২০০১ সালে ইরানী তরুন হোসাইন এশাই বিশ্বকে Mobile GPU ও Power VRMVX এর সাথে পরিচিত করে তুলে। যা আ্যপল ও স্যামসাং এর মতো প্রতিষ্ঠান তাদের মোবাইলে 3D graphics এর জন্য ব্যাবহার করে থাকে।
১৯৮৭ জাপানী কোম্পানী squaresoft এর জন্য ইরানী প্রোগ্রামার নাসির গিবেলি তৈরি করেন Endless running game. এটাই ছিল বিশ্বের প্রথম sterioscopic 3D game. এর দেখানো পথ ধরেই ২০১১ সালে প্রকাশ পায় Endless মোবাইল গেম Temple Run.
আজারবাইজানের বিজ্ঞানী কারিম কেরিমভ ছিলেন সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রাম এর অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা এবং স্ফুটনিক-১ ও ভস্টক-১ এর প্রধান আর্কিটেক্টদের একজন।
১৯ বছর বয়সী মিসরী তরুনী আয়েশা মোস্তফা আবিষ্কার করে Quantum mechanics ব্যবহার করে spacecraft চালিত করার পদ্ধতি। যাতে করে দ্রুত ও সহজেই মহাকাশ ভ্রমন করা যায়।
ড. আহমেদ জেওয়েল কে চিনেন???
যিনি ক্যমিক্যাল রিয়েকশান পর্যবেক্ষনে আল্টা শর্ট লেজার ফ্লাশ ব্যবহার করে ১৯৯৯ সালে রসায়নে নোবেল প্রাইজ অর্জন করন।
উপমহাদেশের বিখ্যাত পরমানুবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম খান সম্পর্কে তো সবাই জানেন। যিনি পদার্থবিদ্যায় ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
প্রতিদিন মাথায় যে স্যাম্পু ব্যাবহার করেন তার আবিষ্কারক শেখ দীন মোহাম্মদ।
পরিশেষে একটি কথাই বলা যেতে পারে মধ্যযুগ ছিল মুসলমান বিজ্ঞানীদের স্বর্ণযুগ, আর বর্তমানেও মুসলমানগণ আবিষ্কার করে চলেছে। কিন্তু জনসম্মুখে তা প্রচার করা হচ্ছেনা, ফলে নাস্তিক্যবাদী সম্প্রদায় মুসলমানদের ক্ষ্যাত বলে আখ্যায়িত করছে। তাদের উপহাসের যথার্থ জবাব দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ইতিহাস সমম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করা। তাহলে তাদের কথার সঠিক জবাব আমরা কথার মাধ্যমে দিতে পারবো এবং পাশাপাশি মুসলমানগণ আবারো বিজ্ঞানের জগতে অতীতের মতো বিচরণ করবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
