বিকৃত যৌনতার শহরের রক্ষিতা সাংঘাতিকতা
মূল্যবোধ বিবেক সব হয়ে গেছে বেঁচে খাবার পন্য। গভীর আদরের জায়গাগুলো ঢাকা পড়ে গেছে স্থুল যৌনতায়। লাভ, ডার্লিং থেকে বেবী। প্রেমিকা শুধুমাত্র যৌনতার খেলনা বা টয় হয়ে যাচ্ছে। আবার চেতনে বা অবচেতনে প্রেমিকাকে সল্প বয়সের দামে মাপবার অনুসঙ্গ থাকছে। প্রেমিকা খেলনা হবার মধ্য দিয়ে বন্ধনগুলো খেলো হচ্ছে, সম্পর্কগুলি পবিত্রতা আর পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ হারাচ্ছে। আমরা এখন কেবল সস্তার মধ্যে সুন্দরের উজ্জলতা উপভোগ করতে উৎগ্রীব।
মানিক বন্দ্যোপধ্যায় তাঁর এক লেখায় লিখেছিলেন,”কবিতার মজুরীতে কবি বাচেঁ না” । এখনও এখানকার শিল্পস্রষ্টাদের অনেককে শিল্পের মজুরী বাচাঁতে পারে না। বাচঁবার মজুরীর জন্য তাকেঁ অন্যত্র জীবিকা খুঁজতে হয়। এখানেই শিল্পবোধ সম্পন্ন অন্য পেশায় জীবিকা খুজঁতে যাওয়া জীবনের মূল ব্যর্থতা। আমার ব্যর্থতাও একই জায়গায়। ব্যর্থতা থেকে যায় সামাজিক অসঙ্গতির বেদনাবহ দৃশ্যপট একের পর এক দেখতে থাকায়।
সহজ চলা আর বলার দিন গেছে বাড়ি, এখন আমরা কেবল মিথ্যার সাথে স্বার্থের কু যুক্তি মিশিয়ে কাটা-কাটি খেলি।
নামাজের জন্য এসিওয়ালা মসজিদ, বাচ্চার লেখাপড়ার জন্য ফাইভ ষ্টার হোটেলের সুবিধাসম্পন্ন ক্লাসরুম দরকার এখনকার মধ্যবিত্তের। সন্তানকে রিসোর্টসম স্কুলে পাঠিয়ে শ্রেনীকক্ষে পড়ার চেয়েও ষ্টাটাস আর সোসাইটির ক্লাস সেন্সের শিক্ষা দিতে চাই এ সময়ের আধুনিক মানুষেরা। সংকটের শুরু এখানেই। অদ্ভুত সব বৈপরীত্য আমরা ধারন করি অবলীলায়।
আবার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আত্মিক গভীরতার জায়গার খাদঁগুলোতে ঢুকে যাচ্ছে স্বার্থপরতা। অথচ যেখানে থাকবার কথা নিটোল মমতার দায় আর প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। সম্পর্কগুলোর ভেতরের রসায়ন যাই থাক,কেমিষ্ট্রির ঝরে পড়বার বাহুল্য ঝরানোর সর্বাত্বক চেষ্টা থাকছে স্যোশাল মিডিয়ায়,ফেসবুকের ছবির গল্পে। প্রেমকে কর্পোরেট করে তোলবার চেষ্টা চলছে,নাকি হচ্ছে- সে বিতর্ক লেখার গন্তব্য নয় কোনভাবেই। বাস্তবের সম্পর্কগুলো আকাশচারী নয়,সম্পর্কগুলো ফুটপাতে হাত ধরে হাটবার ছন্দে বসবাস করে। সম্পর্কের চাষ করা আর সম্পর্কে বাস করার মাঝখানে দুরত্ব নিরন্তর।
আবার দেখছি, মৌনতার মাধুর্য হেরে শব্দের অপচয়ের হাটে।
সাফল্যের বৃত্তে নিজেকে আটকে রাখা, আসলে খুব কঠিন কাজ। একজন লেখককে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকা সমীচীন আমি মনে করি,তার পাঠকের মূল্যবান সময় যাতে অপচয় না হয় তার লেখাটি পড়ে,সেই ব্যাপারে।
দুই.
পেশাদার একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি পাঠকের কাছে এবং আমার নিজের কাছে দায়বদ্ধ। সাংবাদিকতার নাম ভাঙ্গিয়ে ঢাকা শহরে এবং বাইরে দেশজুড়ে অপেশাদার সুবিধাজীবি,ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী একটি দালাল শ্রেনী গড়ে উঠেছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তারা আমলে আমলে শুধুমাত্র সরকারকে দোষ দিয়ে মালিকপক্ষের শতভাগ স্বার্থরক্ষার অনুগত চাকরের কাজটি করেন সাংবাদিকতার নামে। কিছুমাত্র ব্যাতিক্রম ছাড়া উপরের দিকে শুধুমাত্র পুঁজির মোসাহেবরা সাংবাদিকতার মত মহান পেশাকে মালিকের মুহুরির ভুমিকায় পরিনত করার চেষ্টা করছেন। এর বিনিময়ে এসব ধান্দাবাজরা দেশের নব্য কোটিপতি, এলিট ক্লাবের সদস্য হয়েছেন। ঢাকা শহরে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, অদুরে বাগানবাড়ী, প্রাডো হ্যারিয়ার গাড়ি, বিদেশে সেকেন্ড হোমের মালিক হয়েছেন। তাদের সন্তানরা বিদেশে পড়ে। নিজেরা এমপির, মহিলা এমপির নমিনেশনের ঠিকাদারী করেন। আর টকশোতে,বক্তৃতায় কলামের নামে ক্ষমতার বানী বন্দনায় আদর্শ, নীতি নৈতিকতার বুলি কপচান, নসিহত দেন। অথচ তাদের পত্রিকায় মফস্বলের সংবাদকর্মীরা বেতন পান না। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য। আর মালিকের দালালরা সাংবাদিকতার নামে আমাদের শেখান, দালালী, দলাদলি এবং গালাগালি।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পরবর্তী সরকারগুলো তাদের ক্ষমতাকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে সব পেশাজীবিদের মধ্যে সুবিধার দামে একটি দালাল শ্রেনী সৃষ্টি করেছে। এই দালালরা সরকারের, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট চেটে পুটে খায়।
আমাদের আজকের সমাজে সব পেশাজীবি নেতৃত্বের একটি অংশ ব্যাক্তিস্বার্থের কাছে মাথা বেঁচে সুবিধা বাগানোতে মত্ত। সবগুলি প্রতিষ্টান পঁচে গলে একাকার। সেখানে গনমাধ্যম তো আর কোন বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র দ্বীপ নয়। আমাদের পঁচে যাওয়া সমাজ বাস্তবতায় শুধুমাত্র সাংবাদিকতা শতভাগ নীতি নৈতিকতা নিয়ে একেবারে ইথিক্সের স্তম্ভ হয়ে দাড়িয়ে থাকবে, সে ভাবনা আসলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।
আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতি হতাশা আছে। রাজনীতি জীবি দলান্ধ কীটদের প্রতি আমার সু-তীব্র ঘৃনা আছে।
শুধুমাত্র ক্ষমতার পৌঁছবার বা নামাবার জন্য রাজনীতি করা মানুষদের প্রতি ক্ষোভের কারন,তারা রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থে,জনগনের সাথে জোচ্চুরী,প্রবঞ্চনার হাতিয়ারে পরিনত করেছেন।
রাজনীতি আমাদের সমাজ, অর্থনীতি,শিক্ষাব্যবস্থা,প্রশাসন তথা পুরো প্রক্রিয়াকেই নিয়ন্ত্রন করে। তাই যতক্ষন পর্যন্ত রাজনীতিবিদরা অপেক্ষাকৃত ভালো হবেন না,আমাদের সমাজে অর্থবহ ইতিবাচক পরিবর্তনের কোন আশা জাগবে না।
কারন,সাংবাদিকতাও রাজনীতির বাইরের কোন বিষয় নয়। যখন রাজনীতি তার টিকে থাকবার স্বার্থে সমাজের সব পেশাজীবিদের ধংস্ব করে দিতে চায়, তখন শুধু সাংবাদিকতার পেশা একেবারে ন্যায়ের, সরকার বিরোধীতার স্তম্ভ হয়ে দাড়িয়ে যাবে, সে আশা করা নিতান্তই অর্থহীন।
মুনিয়ার ঘটনা নিয়ে বিকল্প গনমাধ্যমে আবাসন কোম্পানী রূপায়ন গ্রুপের দেশ রুপান্তর, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের সময়ের আলোর সাংবাদিকতার নামে চটি লেখার সমালোচনা চলছে। দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সাইটে লেখাটি এখনো রয়েছে। আমার সাবেক কর্মস্থল চ্যানেল আই তাদের খবরে ভিকটিমের ছবি প্রকাশ করে বসুন্ধরার এমডির ছবি আড়াল করেছে, তারপর ক্ষমা চেয়েছে। তারপরও ব্যাতিক্রম আছে। দৈনিক মানবকন্ঠ সম্পাদক শ্রদ্বেয় দুলাল আহমেদ চৌধুরী মানবকন্ঠের প্রথম পাতাটি প্রতিদিন হোয়াটসআপে পিডিএফফে পড়তে পাঠান। মুনিয়ার ঘটনার পর গত চার দিন দুটো লীড সহ মানবকন্ঠ প্রথম পাতায় কাভারেজ দিয়েছে। দৈনিক মানবকন্ঠ এ ঘটনায় দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে একটি ইতিবাচক উদাহরন সৃষ্টি করেছে। আর একটি দুটি ব্যাতিক্রম যাপিত বাস্তবতাকে অতিক্রম করতে পারে না। আমরা সংবাদকর্মীরা শুধুমাত্র ফেসবুকে আত্বসমালোচনা করে দায়িত্ব শেষ করতে পারি না। মুনিয়ার ঘটনা আমাদের সাংবাদিকতার অনৈতিকতা, অসঙ্গতিগুলিকে সামনে এনে পাঠকের বিচারের কাঠগড়ায় আমাদের দাড় করিয়ে দিয়েছে। মা বাবাহীন এতিম মৃত বোনটিকে যে চক্র রক্ষিতা আর বেশ্যা বানাতে চায়, আসলে সেই ক্ষুদ্র চক্রটিই বিকৃত বুদ্ধিবেশ্যা। মুনিয়ার ঘটনা এই দালালদের মুখোশ দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছে।
সাংবাদিকতাও যদি বেঁচে খাবার পন্য বানিয়ে ফেলে ওরা, তাহলে সাধারন মানুষের ভরসার কোন জায়গা আর অবশিষ্ট থাকবে না।
তারুন্য, জীবনের জয়রথ আমরা কলমে কন্ঠে গনমানুষের কথা বলবার যে গনমাধ্যমের সপ্ন বিনির্মানের মিছিলে কাটিয়েছি,সে আশাবাদ বৃথা যেতে পারে না, কখনোই।
লেখকঃ লন্ডন প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন
এশিয়াবিডি/কামরান/মুবিন