সরওয়ার ফারুকীর ‘রুদ্ধ রুহের স্বর’

সরওয়ার ফারুকী একজন শেকড় সন্ধানি লেখক। ‘মরমী কবি ইবরাহিম তশনা ও অগ্নিকুণ্ড গানের সংকলন’ সম্পাদনা করে প্রকাশের পর মোড়ক উন্মোচন উৎসবকালে তার সাথে আমার পরিচয়। অতঃপর তিনি কোথায় ছিলেন—জানি না। ‘কেমুসাস বইমেলা ২০১৩’ উপলক্ষে তিনি আমাদের সামনে নিয়ে হাজির হলেন তাঁর ‘রুদ্ধ রুহের স্বর’ কবিতার বই। বইটির নাম ‘রুদ্ধ রুহের স্বর’ দেখে আমার মনে হলো— ‘খাচার ভেতর বন্ধি পাখি ছটফট ছটফট করে রে’ গানের কথা। যদি গীতল ভাষায় এই বইয়ের নামকরণ হতো তবে আমার মনে হয় এই রকমেরই কিছু হতো। ‘রুদ্ধ রুহের স্বর’-এ আবার পর্দার আড়াল থেকে নারীর উঁকি মারাও স্পষ্ট দেখা যায়। বইয়ের নামে কবিতা আছে। বইয়ের প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় কবি মুহিত চৌধুরী বলেই আমাকে কিছু সমালোচনা করতে হচ্ছে। কবি মুহিত চৌধুরী বয়সে আমার বেশ বড় এবং আমার আগ থেকে সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতে আছেন। তিনি যে প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করলেন তা কিসের ভিত্তিতে? যে ছবি বা আর্ট তিনি ব্যবহার করেছেন তা কোথায় পেলেন? শিল্পীর পরিচয় না বললে এই প্রশ্নগুলো এখানে থেকে যায়। কেমুসাসের বইমেলা উপলক্ষে ‘রুদ্ধ রুহের স্বর’ প্রকাশিত হলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ থাকায় বইমেলা স্থগিত করতে হয়েছে। কেমুসাসের সাথে সংশ্লিষ্ট হিসেবে আমি নিজেও দুঃখ প্রকাশ করছি।

‘রুদ্ধ রুহের স্বর’-এ ৪৩ টি কবিতার সবগুলোই আমার পড়া হয়েছে। অফুটন্ত ফুলকে ফুটাতে কবি কতটুক পথ অতিক্রম করেছেন তা পাঠক দেখতে পাবেন কবির ‘অধরা ফুলের লাগি’ কবিতায়। ‘আটাশে অক্টোবর’ একটি রাজনৈতিক কবিতা। আরো সহজে বললে লগি-বৈঠা সংশ্লিষ্ট স্মৃতিচারণ। তাঁর বেশিরভাগ কবিতাই বিষয়ের স্মৃতিচারণ। তাঁর বেশিরভাগ কবিতাই বিভিন্ন বিষয়ের স্মৃতিচারণমূলক। ‘রূপান্তর’-এ ফেলা আসা দিনকে যে কবি সাথে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন— সেই বর্ণনা। ‘কাল’ কবিতায় আমরা দেখি কখনও কবি কালের গলায়, আবার কখনও ‘কাল’ কবির গলায় ঝুলে আছে।

‘আলেয়া’ও ‘স্মৃতিময়’ কবিতা। ‘জয়’ কবিতায় অবশ্য কবি চুড়া ভেঙে নির্ভয়ে চাষ করে কিংবা দাঁড় বেয়ে অসীম আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করেন। ‘প্র্যাক্টিক্যাল’ কবিতা পড়তে পড়তে যখন আসি ‘অবলা বিধবারা—নেই গৃহকোণে/ উনারাই আজ বেশ পাওয়ারফুল’—এ, তখন স্পষ্ট মনে হয় বিষয়টি রাজনৈতিক—আমাদের শ্রদ্ধাভাজন দুই নেত্রী। ‘মালঞ্চ’ কবিতার ‘প্রেমের শরাবদানে চুমুকি চুমুকি/ খিলখিল ঢেউ তুলে চলে শাহজাদি/ অঝোরে জোছনা ঝরেÑঅঢেল পবন/ লায়লীর বন্দরে ইশরি কথন।’ কিংবা ‘আহত রাত’ কবিতার ‘রাত্রি কত দীর্ঘ হলে সোহাগ হবে পুরা/ গোলাপ জলের ঢেউ দেব সখি নেকাব উঠাও তুড়া/ বায়না পাতার ঢাকনাতে ঐ রক্তরাগী টোল/ লুকিও না গো লতির মাথায় গাঁথা পদ্মফুল।’—লাইনগুলো পড়লে সত্যই কবিতার খুশবু পাওয়া যায়। তবে কিছু কবিতার কিছু লাইনে মাত্রাতিরিক্ত আবেগের ফলে কানে লাগার মতো ছন্দপতন ঘটেছে। ‘আহত রাত’-এর দ্বিতীয় লাইনে ‘সখি’ শব্দ না লিখলেও এখানে ‘সখি’-ই বুঝাতো। এভাবে অনেক কবিতায় দেখা যায় অপ্রয়োজনে কিংবা গৌণ প্রয়োজনে শব্দ বা অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে— যা ছন্দ কিংবা মাত্রার দেহে কিছুটা হলেও ধাক্কা মারে। আবার তিনি অন্ত্যমিলের চেষ্টা করে কোথাও সফল, আবার কোথাও বিফল। আবার কোন কোন জায়গায় অপ্রয়োজনীয় অন্ত্যমিল দিয়ে কবিতার ভাব ও ওজনকে হালকা করে দিয়েছেন। যেমন ‘আহত কাকুতি’ তে ‘তোমায়’ ‘আমায়’ অন্ত্যমিল হলেও ‘বলো’ আর ‘ভালো’তে মিলছে না। তবে কবিকে স্মরণ রাখতে হবে, বর্তমান কবিতায় এখন আর অন্ত্যমিল গুরুত্বপূর্ণ না ।

‘জীবনের ভাঁজ’ কবিতায় মির্জা গালিবের স্পর্শ পাঠক পেয়ে যাবেন। আমাদের স্বীকার করতে হবে কবিতাটি অনবদ্য। যারা জমি-জামাকে জীবনের চেয়ে দামী মনে করেন কিংবা নর্দমায় নাক গুজে নিয়েছেন ওদেরকে জীবিত বলা যাবে না, ‘ওরা মৃত’ কবিতাটি তাদের জন্য। ‘নর্তকী’র বক্তব্যে কবি একটা চিন্তাকে লালন করেছেন। এই চিন্তার কাছে আমাদের পাশ্চাত্যমুখি নারীবাদি চিন্তকরা আজও যেতে পারছেন না। এখানে কবি শৈল্পিকভাবে বলতে চেষ্টা করেছেন নর্তকীদের কারণে কিভাবে মানুষের দাম্পত্যে ভাঙ্গন আসে। ভাঙ্গন আসে যুবকদের মনে। ‘জাল’ কবিতায় কবি আমার আমিকে ডেকে হৃদয়ের দহন যন্ত্রণা থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছেন । ‘ঘুম’ কবিতার শুরুতে যদি কবি ‘হায় ঘুম’ বাক্য উচ্চারণ না-করতেন তবে এখানে একটা আলো-আঁধারি আবহ তৈরি হতো। সরওয়ার ফারুকীর একটি কবিতার নাম ‘অস্পরী’ ।

বাংলা সাহিত্যে নারীকে আমরা দেবী, মানবী, কাল্পনিক ইত্যাদি। বিভিন্ন রূপে দেখতে পাই। যারা নারীকে দেবী বা ঈশ্বরী বানিয়েছেন বা বানান তারা বড়ই চালাক। তারা এমনটি করেন নারীকে ভোগের জন্য। কোন কোন নারী লম্পটদের খপ্পরে পড়ে সব হারায়। কবি এখানে প্রিয়াকে অস্পরী বলেছেন—যা তাঁর বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কবির ‘ইক্ষন’ কবিতা পড়লে মনে হয় তাঁর স্বাদ-আহ্লাদ সবই শেষ। আমি আমাদের সরওয়ার ফারুককে বলবো; দেহ আর বছর দিয়ে কবিদের বয়স মাপা যায় না। কবিরা সর্বদাই তারুণ্যকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। কবি বৃদ্ধ হলেও স্বপ্ন-শূন্য নয় বলে তিনিই আবার আমাদেরকে জানান তাঁর ‘কষ্টের পুকুর’ কবিতায়। ‘প্রবাসী বাবা’ কিংবা ‘মা’ হলো আবেগি ছন্দবন্ধ কিছু কথা। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির আবেগে পরিপূর্ণ হয়েছে তাঁর ‘আমার কানাইঘাট’ কবিতা। ডিজিটাল বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বোমুখি ভাব আর ভুঁড়ি মোটা হওয়ার বিষয়টি কষ্টের। সাথে স্মরণ হয়েছে ‘ডিজিটাল হজম’ কবিতায়। বিচ্ছেদের সুরে ‘বন্ধন ছিঁড়ে যায়’ ভিক্ষুকের আকুতি বাড়ির মালিকের বিরক্তি শোনা যায় ‘ধাক্কা’ কবিতায়। সরওয়ার ফারুকী ‘শিকড়’ কবিতায় আবার প্রমাণ করলেন তিনি বৃদ্ধ নয়, কবিরা বৃদ্ধ হয় না। এই কবিতায় তিনি জোয়ানি পুড়াতে, অঝোরে চুমুতে, জোছনা মোলাতে, নিশান আঁকতে, মুক্তি আনতে, স্বপ্ন জাগাতে, সাইক্লোনে শিষ দিতে দিতে এগিয়ে যান। ‘আমি চাই’ কবিতায় কবি আলোর সন্ধানী। ‘গর্বিত মজলুম’-এ কবি আবেগপূর্ণ শ্লোগান দিয়েছেন। তবে একই পৃষ্ঠায় ‘বীজ’-এ কবিতার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ‘কামনা’ হলো অক্ষরবৃত্তের একটি ছড়া। মজলুম মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনায় ‘হাল হকিকত’ কবিতায় অনৈসলামিকদের শেষ পরিণতিতে ‘নিরপেক্ষ’ মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ‘উপলব্ধি’ আলো কিংবা মুক্তির প্রার্থনায় ‘অনন্ত আকুতি’ কবিতা লেখা হয়েছে।

আরও সংবাদ