অভিযোগের পাহাড় তবুও তিনি কি ভাবে স্বপদে?
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে নিজ দপ্তরের নারী কর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে প্রকল্পে দূর্নীতি ও প্রকল্প শেষ হলেও একাই চারটি গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, তার দপ্তরের নারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে তিনি অনৈতিক প্রস্তাব দিতেন। এমনই অডিও রেকর্ডসহ প্রায় এক মিনিটি ৫০ সেকেন্টর অডিওটিতে একজন নারীকে বারংবার কুপ্রস্তাব দিতে শোনা যায়। ফোনের একপ্রান্তে পুরুষকণ্ঠে একজন‘কোন একটা জায়গায় বসে কিছু কথা বলতে পারলে ভালো লাগত’ এমন উক্তির পর তা প্রত্যাখ্যান করেন নারী। এরপর পুনরায় তিনি বলেন ‘আমি যদি তোমাকে জড়িয়ে ধরি তুমি যদি অন্যকিছু মনে করো, সে জন্য কথা বলতে পারলে ভালো হতো’।
এসময় ফোনের অন্যপ্রান্তে নারীকে ‘স্যার বাসায় আপনার বউ আছে, আপনি তাকে গিয়ে ধরেন’ বলতে শোনা যায়। অডিও রেকর্ডটিতে পুরুষকে পুনরায় ‘আমি একটু ধরতাম বুকের মধ্যে’ বলতে শোনা যায় । এসময় অন্যপ্রান্তে নারী ‘স্যার আপনি যা করছেন আমার সাথে তাতো খুবই অন্যায় স্যার। আমার সংসারটা শেষ হয়ে যাবে স্যার, আমার সাথে কখনো এরকম করবেন না স্যার, দয়া করে প্লিজ স্যার’ বলে অনুরোধ করলে ‘ভবিষ্যতে আরো বেশি হবে’ বলে হুমকি দেন পুরুষ।
অডিওর কিছু অংশের কথোপকথন প্রকাশের অযোগ্য হওয়ায় তা তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। এছাড়া এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অধিনস্থ একাধিক নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যৌন হয়রানি, কু-প্রাস্তাব দিয়েছেন। এতে সারা না দেওয়া তার হাতে নানা ভাবে হয়রানি ও দূর্গম এলাকায় বদলির অভিযোগ রয়েছে। তবে ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তারা চাকরি হারানো ও সামাজিকভাবে হেনস্থার শিকার হওয়ার ভয়ে মুখ খুলছেন না।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি সূত্রের ভাষ্যমতে অডিওর পুরুষ কণ্ঠের ব্যক্তি হচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী মোঃ সাইফুর রহমান। অপর প্রান্তের নারী কণ্ঠটি তার অধীনস্ত একজন কর্মীর বলে নিশ্চিত করে সূত্রটি। এ বিষয়ে জানতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান মুটোফোনে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে জানান, ‘আমি সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত। আপনি রবিবার অফিসে এসে দেখা করেন।’ অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে গেলে তিনি এখন মন্তব্য করবেন না বলে পুনরায় রবিবার অফিসে এসে দেখা করতে বলেন।
এ দিকে দীর্ঘদিন ধরে একই চেয়ার আকড়ে থাকা সাইফুরের বিরুদ্ধে রয়েছে দূর্নীতির বহু অভিযোগ। তেমনই একটি পাবনার সুজানগর পৌরসভা এলাকায় পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন প্রকল্প। এই প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছে পাবনার সুজানগরের বাসিন্দারা। পাশাপাশি প্রধান প্রকৌশলীকে পৌরসভার পক্ষ থেকে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হলেও বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন অভিযুক্ত সেই প্রকৌশলী। আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে ও দুদকে অভিযোগ করে হুমকির মুখে পড়েছেন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হারুন অর রশিদ। সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, পানি প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করার পর থেকে তাকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। এমনকি একদল সন্ত্রাসী তার বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানের সামনে হুমকি দিয়ে যায়।
প্রকৌশলীর গাড়ি বিলাস
সরকারি প্রকল্পের জন্য কেনা গাড়ি প্রকল্পের মেয়াদ শেষে পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার নিয়ম; অথচ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের জন্য কেনা দেড় কোটি টাকার তিনটি গাড়ি জমা হয়নি।
নিয়ম না মেনে এসব গাড়ি ব্যবহার করছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান।
শেষ হয়ে যাওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার বিষয়ে ২০০৬ সালে একটি পরিপত্র জারি করে তৎকালীন সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়।
ওই পরিপত্রে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকল্প শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে সব যানবাহন পরিবহন পুলে জমা দেবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা না হলে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে।
সেই পরিপত্র মেনে চলতে গত বছরের ৫ জানুয়ারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাগিদ দিয়ে একটি চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানেও ২০০৬ সালে জারি করা পরিপত্র অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রকল্প’র জন্য এই তিনটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার প্রাডো টিএক্স গাড়ি কেনা হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, শেষ হয়েছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। ৪৫৩ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ।
জানা গেছে, প্রকল্পের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে গাড়ি তিনটি কেনা হয়। ২০২০ সালে গাড়িগুলো জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভাণ্ডার শাখার নির্বাহী প্রকৌশলীর নামে নিবন্ধন করা হয়। তিনটি গাড়ির নম্বর যথাক্রমে ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৫৮৪৫, ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৫৮৪৬ এবং ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৫৮৪৭। ২০১৯ সালে তৈরি গাড়িগুলো তিন হাজার সিসির, প্রতিটির দাম ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তবে জনস্বাস্থ্যের ওই প্রকল্পের তিনটি গাড়ির কোনোটিই পরিবহন পুলে আসেনি বলে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জমা না দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর গণমাধ্যমকে বলেন, গাড়িগুলো কেনা হয়েছে ইউনিসেফের টাকা। ইউনিসেফের গাড়ি পুলে জমা দিতে হয় না।