হযরত আল্লামা ছালিক আহমদ (র.): কিছু স্মৃতি কিছু কথা

হযরত আল্লামা ছালিক আহমদ (র.): কিছু স্মৃতি কিছু কথা

১৯৯৩ বা ৯৪ সাল। আমি তখন অনেক ছোট। ফুলতলী কামিল মাদরাসায় সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। সেসময় একদিন আমাদের নিজ উপজেলার বাল্লাহ গ্রামে এক আত্মীয়’র বাড়ি যাই। কোনো প্রয়োজনবশত সেখানে রাত্রিযাপন করি। সে ঘরে ইছামতি মাদরাসার একজন শিক্ষক লজিং থাকতেন। তিনি আমার নাম-পরিচয় ও পড়াশোনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। এক পর্যায়ে আমাকে তাহকীক-তারকীব সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেন। আমার উত্তর পেয়ে তিনি খুব খুশি হন। পরদিন মাদরাসায় গিয়ে তিনি তাঁর ক্লাসে আমার সপ্রশংস আলোচনা করেন। আমাদের কোনো এক উস্তাযের মাধ্যমে তাও আমার কানে আসে। স্বভাবতই সে শিক্ষকের প্রতি মনের গভীরে একটি স্থান তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, শৈশব-কৈশোরের লাজুকতাবশত সে শিক্ষকের নাম-পরিচয় তো আমার জানা হয়নি। ঐ আত্মীয়ের বাড়িতেও আর বহুকাল যাওয়া হয়নি। এই শিক্ষককে আমি মনে মনে খুঁজি। কিন্তু কোথাও পাই না। কিশোর স্মৃতিতে তাঁর চেহারার রং ছাড়া আর অন্য কিছু আমি ধরে রাখতে পারিনি। মাঝে মাঝে এ শিক্ষকের কথা মনে হলেও আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এভাবে দিন, মাস, বছর যায়। একে একে দুই যুগেরও অধিক সময় অতিবাহিত হয়। এরপর ২০২০ সালে একটি কিতাবের তাহকীকে উলামায়ে কিরামের একটি টিম বহুদিন একসাথে কাজ করেন। সেখানে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। কাজের শেষদিকে একদিন কথা প্রসঙ্গে হযরত আল্লামা ছালিক আহমদ সাহেব জানান যে, তিনি এক সময় ইছামতি মাদরাসায় ছিলেন। আমি তাঁকে সাল জিজ্ঞাসা করি। তাঁর উত্তরে সাথে সাথে আমার কিশোরস্মৃতি মনে উদ্ভাসিত হয়। জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি অমুকের ঘরে লজিং ছিলেন। তিনি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে বলেন, ঐ সময় একদিন আপনি সেখানে গিয়েছিলেন, আপনাকে কিছু তাহকীক-তারকীব জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যা ঐ বয়সে পারার কথা নয়। কিন্তু আপনি পেরেছিলেন। তাঁর এ জবাব আমাকে সন্ধান দিয়েছিলো এমন এক ব্যক্তির, যাকে আমি খুঁজছিলাম বহুদিন, বহু বছর ধরে। তাঁর সাথে ইতিপূর্বে আর পরিচয় হয়নি এমন নয়; কিন্তু তিনি যে আমার স্মৃতির সেই মানুষ তা আমি জানতাম না।

দাখিল-আলিম পর্যন্ত সিলেট শহরে গেলে সাধারণত শাহী ঈদগাহে খালার বাসায় থাকতাম। এমনি এক সময়ে একদিন পরিচিত এক ভাইয়ের সাথে আনসার কলোনী মসজিদে জুমআর নামাযে যাই। সেখানে হযরত মাওলানা ছালিক আহমদ সাহেব জুমআর নামায পড়াতেন। তখন ঐ ভাইয়ের মুখ থেকে তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সাথে দেখা হয়েছে। তালামীযে ইসলামিয়ার দায়িত্বে থাকাকালে সুবহে সাদিক ও অন্যান্য প্রকাশনার জন্য লেখা সংগ্রহ ছাড়াও বহু বিষয়ে তাঁর সাথে বহুবার যোগাযোগ হয়েছে। বিশেষ করে তিনি যখন দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, প্রধানকেন্দ্র ফুলতলী ছাহেববাড়ি’র ছাদিছ জামাতের পরীক্ষক নির্বাচিত হন তখন তাঁকে খুবই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আর সর্বশেষ তাঁর ইন্তিকালের মাস ছয়েক আগে বেশ কিছু দিন সকাল থেকে রাত, কখনো গভীর রাত পর্যন্ত একত্রে কাটিয়েছি। তাঁকে যখনই যে ক্ষেত্রে দেখেছি একজন বিনয়ী ও আদর্শ মানুষ হিসাবেই দেখেছি।

শিক্ষকতার মহান পেশায় তিনি কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন। বিশেষত ইলমে হাদীসের খিদমাতে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন। ‘ভূরকীর মুহাদ্দিস ছাহেব’ হিসাবে তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর ছাত্রদের নিকট থেকে ইলমে হাদীসের খিদমাতে তাঁর ইখলাস ও নিষ্ঠার কথা শুনেছি। আর হাদীসের কিতাবাদির উপর তাঁর যে কী দখল ছিলো তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা যখন আধুনিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে কিংবা মাকতাবায়ে শামেলা সার্চ করে কোনো হাদীস খুঁজেছি তখন তিনি কিতাবের পাতা ঘেটে সে হাদীস ও এ সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনে কিরামের বক্তব্য অতি সহজে বের করে এনেছেন। ইলমে হাদীসে গভীরতা ব্যতিরেকে কারো পক্ষে এটি সহজসাধ্য নয়। আরবী ভাষার উপর তাঁর ব্যাপক দখল ছিলো। আরবী শব্দের তাহকীক, বুৎপত্তিগত অর্থ ও বাক্যে এর বিবিধ ব্যবহার সম্পর্কে তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন। বাংলাভাষায়ও তাঁর দখল ছিলো ঈর্ষণীয়।

তিনি ছিলেন একজন আশিকে রাসূল। বিভিন্ন দ্বীনী মাহফিলে তাঁর বয়ানে হুব্বে রাসূলের আলোচনা প্রাধান্য পেতো। তিনি জীবনে একাধিকবার হজ্জ ও উমরাহ আদায় করেছেন। মদীনার মসজিদে নববীতে চল্লিশ ওয়াক্ত নামায জামাআতে পড়ার ফযীলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে একটি বর্ণনা রয়েছে। কেউ কেউ এ হাদীসকে দুর্বল বলেছেন। একবার মদীনা শরীফ থাকাকালে এ হাদীস নিয়ে তাঁর মনে প্রশ্ন আসে। তখন তিনি স্বপ্নে হাদীসটি দেয়ালে লিপিবদ্ধ দেখতে পান। ফলে তাঁর মনের সন্দেহ দূরীভূত হয়। এ বিষয়টি পূর্বে কারো নিকট থেকে শুনেছিলাম। পূর্বোক্ত কিতাবের তাহকীকের সময়ে তাঁকে এটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি তা সত্যায়ন করেন। উল্লেখ্য যে, স্বপ্ন বা কাশফ মুহাদ্দিসীনে কিরামের নীতি অনুযায়ী সিহ্হাত বা সবলতার দলীল না হলেও এটি ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করে। অন্যদের জন্যও এটি আত্মিক প্রশান্তির কারণ হয়। সূফী মুহাদ্দিসীন থেকে এধরনের অনেক বর্ণনা রয়েছে। হযরত শাহওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর ‘আদ দুররুস সামীন’ তাঁর ও তাঁর পিতা শাহ আব্দুর রহীম মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর স্বপ্ন, কাশফ ও এধরনের বর্ণনা নিয়েই সংকলিত।

তিনি শেষ কয়েক বছর দারুল কিরাতের ছাদিছ জামাতের পরীক্ষক ছিলেন। এমনকি ইন্তিকালের পূর্বের সপ্তাহে ছাদিছ জামাতের বিশেষ কোর্সের পরীক্ষা গ্রহণ করেছেন। পরীক্ষার আগে যখন তাঁর সাথে যোগাযোগ হতো তখন তিনি কখনো অপারগতা প্রকাশ করতেন না। এমনকি কোনো অসুবিধা বা কাজের চাপ থাকলে তা ফেলে রেখে ছুটে আসতেন। এ উপলক্ষ্যে ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থানের সুযোগকে তিনি হাতছাড়া করতে চাইতেন না। বরং এটিকে বরকতের কারণ মনে করতেন। পরীক্ষার ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণ আমানতদারিতা রক্ষা করতেন। পরীক্ষার্থী ছাহেব বাড়ি’র কেউ হলেও তিনি দয়া দেখাতেন না। একবার হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) এর একজন নাতি তাঁর কাছে পরীক্ষা দেন কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মার্কস পাননি। তখন আমাকে ডেকে মার্কস দেখিয়ে তিনি বলেন, উনাকে অন্য কারো কাছে পরীক্ষায় দিয়ে দিন। কিন্তু আমরা তা করিনি। কারণ, ছাদিছ জামাতের পরীক্ষায় যার যা প্রাপ্য তা-ই প্রদান করা হয়।

হযরত আল্লামা ছালিক আহমদ (র.) একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। তিনি সবসময় অনাড়ম্বর জীবন যাপন পছন্দ করতেন। কথা বলতেন কম, নিরব থাকতেন বেশী। কিন্তু কোনো বিষয়ে বয়ান শুরু করলে তাঁর কথা যেন সাগরের পানির মতো ঢেউ খেলতো। তাঁর দলীলভিত্তিক আলোচনা শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতো। তিনি অত্যন্ত সময়ানুবর্তী ছিলেন। বিনয় ছিলো তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। তিনি ছোট-বড় সকলের সাথে বিনীত আচরণ করতেন। বর্তমান সময়ে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। আল্লাহর হুকুম, তিনি তাঁর দুনিয়ার সময় পূর্ণ করে ২০২১ সালের ২৪ জুন পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁর খিদমাতসমূহ কবূল করুন, তাঁকে ক্ষমা করুন এবং জান্নাতে তাঁকে উচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।

আরও সংবাদ