মনে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে

এত ভদ্র, নম্র, অমায়িক ব্যবহার কারো হতে পারে তাঁকে না দেখলে অনুমান করা যেতো না। তিনি আমাদের সকলের প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন হযরত আল্লামা ছালিক আহমদ ছাহেব (র.) ভূরকীর মুহাদ্দিস ছাহেব।

দারুল কিরাতে ছাদিছ জামাতে পরীক্ষক হিসাবে তিনি ফুলতলীতে আসতেন এবং দু-চারদিন অবস্থান করতেন। সেই সুবাধে তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।

তিনি যখন হাটতেন কিছুটা ঝুকে হাটতেন এবং এত নম্র ও ধীর-স্থিরভাবে চলাফেরা করতেন দেখতে ভালো লাগত। বেশিরভাগ সময় হুজুরকে মাফলার পরতে দেখতাম। তাঁর দিকে তাকালে একজন আবিদ ও পরহেজগার মানুষের বাস্তব প্রতিচ্ছবি মনে হতো।

পরীক্ষার সময় ছাদিছ জামাতের বিদায়ী ছাত্রদের নিয়ে আয়োজিত দুআ মাহফিলে তিনি যে নসিহত করতেন তাতে অন্যরকম এক পরিবেশ সৃষ্টি হতো। বিদায়ী ছাত্রদের বিগলিত মন আর তাঁর ভরাট কন্ঠের নসিহত, রাতের নিস্তব্ধ ফুলতলী তখন গমগম করে উঠত এবং এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হতো। দুআ মাহফিলে মুরশিদে বরহক হযরত বড় ছাহেব কিবলাহ’র মোনাজাতের সময় তিনি এত রোনাজারি করতেন দেখে অনেকের হৃদয়ও বিগলিত হতো।

শেষবার তিনি ফুলতলীতে আসেন ২০২১ সনের ছাদিছ জামাতের বিশেষ কোর্সের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। পরীক্ষা শেষে বাড়ি যাওয়ার অল্পদিনের মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে ইন্তিকাল করেন।

ফুলতলী মাসলাকের আলিমদের মধ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য একজন দাঈ ছিলেন। এত তাড়াতাড়ি তিনি যে মাওলার ডাকে সাড়া দিবেন সেটা আমার মতো অনেকেই ভাবেননি। আহ, তিনি জীবিত থাকলে হয়তো এই মাসলাকের আরও অনেক ফায়দা হতো। মানুষের হিদায়াতে এবং দ্বীনী ইলিম ছড়িয়ে দিতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারতেন।

হুজুরের আরেকটি দিক উল্লেখ না করলেই নয় আমাদের ওয়ালিদ মুহতারামের প্রতি হুজুরের টান ও নিখাদ ভালোবাসা। বছর চারেক আগে যখন আমদের ওয়ালিদ মুহতারাম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন সেই সময় প্রায় প্রতিদিনই খবর নিতে ফোন করতেন। উস্তায ছাত্রের মধ্যে এরকম মুহাব্বাত সচরাচর চোখে পড়ে না। ওয়ালিদ মুহতারামেরও হুজুরের প্রতি মায়া কতটুকু তা আমরা তাঁর ইন্তিকালের সময় অনুভব করেছি।

ইন্তিকালের সময় হুজুরের বয়স খুব বেশি হয়নি, মাত্র ৫২ বছর। কিন্তু তার জানাযা প্রমাণ করে যে, তিনি একজন খাটি মানুষ ছিলেন, মানুষকে তিনি যেভাবে ভালোবেসে আল্লাহর পথে ডেকেছেন, মানুষও তাঁকে প্রতিদান দিয়েছে দোয়ায়, ভালোবাসায়।

তিনি চলে গেছেন কিন্ত তাঁর কথা ক্ষণে ক্ষণে আমাদের মনে পড়ে। ফুলতলীতে হুজুরের চলাফেরা চোখে ভাসে। দারুল কিরাতের শেষের দিকে তার জন্য মন বিষন্ন হয়, আহ তিনি যদি লম্বা হায়াত পেতেন কতইনা ভালো হতো!

হুজুরের ইন্তিকালে এই হাদিস বারবার মনে হয়-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا ‏”‏‏.
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে ইলিম উঠিয়ে নেন না, বরং আলিমদের মৃত্যুর মাধ্যমে ইলিম উঠিয়ে নিবেন। যখন কোন আলিম অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে। তাঁদের জিজ্ঞেসা করা হলে না জানলেও ফতোয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে, এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে। (সহিহ বুখারী)

লেখক:
সহকারী অধ্যাপক
বাদেদেওরাইল ফুলতলি কামিল মাদরাসা।
জকিগনজ, সিলেট

আরও সংবাদ