সিলেট ওসমানী হাসপাতাল, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্নাম!
সিলেট বিভাগে চিকিৎসাক্ষেত্রে একসময়ের একমাত্র ভরসার নাম ছিল সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতাল। পুরো দেশজুড়ে সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এই চিকিৎসাকেন্দ্রটির সুনাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তবে এখন পুরো ভিন্ন পথে হাটছে দেশের অন্যতম ও সিলেট বিভাগের সর্বসাধারণের একমাত্র ভরসার চিকিৎসাকেন্দ্র এই সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতাল। নতুন নামও হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালটির। রোগীরা নতুন করে এর নাম রেখেছেন ‘দুর্নীতির আখড়া’। আর হবেই বা না কেন সিলেটের চিকিৎসা ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটি এখন দুর্নীতির মহোৎসব পালন করছে।
সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালটিতে রয়েছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। যেখানে দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবা ও ফ্রি ওষুধ পাওয়ার কথা সেখানে হাসপাতালের একটি সিন্ডিকেট চক্রের শরণাপন্ন হয়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। অন্য দিকে ওই চক্র দীর্ঘ দিন ধরে কোটি কোটি টাকার সরকারি ওষুধ রোগীদের ফ্রি না দিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ফার্মেসিতে দিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফ্রি ওষুধ না পেয়ে রোগীরা বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে সরকারি চিকিৎসাসেবা নিয়ে চলছে এসব লুটপাটের ব্যবসা। হাসপাতালে কর্তব্যরত কিছু তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ও বাইরের কিছু লোক মিলে সিন্ডিকেট করে প্রতিদিন বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এছাড়াও বিভিন্ন ওয়ার্ডে সিট খালি থাকার পরও রোগীদের নিচে রাখা হয়েছে। ওয়ার্ড কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের বলছেন, সিট খালি নেই। আবার ওয়ার্ডবয় ও দালালরা বলছেন, টাকাপয়সা খরচ করতে পারলে সিট ম্যানেজ করে দিতে পারবে। অথচ দেখা গেছে, খালি সিটে রোগীদের বদলে বিড়াল ঘুমাচ্ছে। রোগীদের পাশাপাশি স্বজনরা ওয়ার্ডের বারান্দায় রাত কাটাচ্ছেন। এমনকি ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা হাসপাতালে সময় মতো আসেন না। রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। জরুরী প্রয়োজনে পাওয়া যায় না সরকারি অ্যাম্বুলেন্স। নেবুলাইজার, অক্সিজেন সংকট, ব্যবস্থাপত্রে রোগ অনুযায়ী ওষুধ না লিখে দামী ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখা এই হাসপাতালের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়ার্ড থেকে শুরু করে হাসপাতালের প্রতিটি কক্ষে সিট-বাণিজ্য আর অনিয়ম-দুর্নীতি এখন নিত্যদিনের ব্যাপার।
তাছাড়া এখানে আছে গেইট পাশ বা নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের দাপুটের অর্থ বাণিজ্যের লড়াই । প্রতি রোগীদের অভিভাবকদের নিকঠ হতে প্রকাশ্যে দিবালোকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ৫০-১০০ টাকা করে চাঁদা । এ হিসেবে মেডিকেলের ফান্ডে গেইট পাশের চাঁদা’র টাকা প্রতিদিন অন্তত ৪/৫লাখ টাকা জমা হয় । আর মেডিকেল কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়লে দু’একজন গার্ডদের দোষারোপ দেখিয়ে তারা নিজেকে নিরাপদ করে নেয় ।
গত ২৪ নভেম্বর সিলেট-১ (সদর) আসনের এমপি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেন পরিচয় গোপন রেখে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। দুপুর ১টার দিকে ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে সেবা নিতে চান তিনি। জানানো হয়, জরুরি বিভাগে এই সেবা বন্ধ। এরপর ১০ টাকার টিকিট কেটে রোগীদের লাইনে দাঁড়ান। বাইরে রোগীর দীর্ঘ লাইন থাকলেও চিকিৎসকরা কক্ষে গল্প-আড্ডা দিচ্ছিলেন। পরে সেলিনা মোমেন হাসপাতালের গাইনিসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখেন এবং রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। বিভিন্ন পরীক্ষা ও এক্সরের জন্য রোগীদের বাইরে পাঠানোর চিত্রও দেখেন। তিনি জানতে চাইলে বলা হয়, দুপুর ১টার পরে হাসপাতালের ভেতরে কোনো পরীক্ষা করা হয় না। এ সময় সেলিনা মোমেন বলেন, একটি সরকারি হাসপাতাল এত নোংরা-অপরিচ্ছন্ন হতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে সরকার কেন এত টাকা খরচ করছে সরকারি হাসপাতালে? সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
রোগিদের প্রতি চিকিৎসকদের অবহেলা, নার্সিং পরীক্ষা পদে বিবাহিতদের স্থান দেওয়া, নিয়োগ বাণিজ্য ও গেইট আনসার-দারোয়ানদের রমরমা চাঁদা আদায় বাণিজ্য, রোগিদের সরকারী ঔষুধ না দিয়ে বাহির থেকে ক্রয় করানো, যথাসময়ে চিকিৎসক না পাওয়াসহ হাজারও অভিযোগ আছে এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে। তবুও নিরব হাসপাতালটির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা জনপ্রশাসন (জনস্বাস্থ্য) মন্ত্রনালয়।
এমন দুর্নীতি থেকে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই চিকিৎসাকেন্দ্রটিকে বাঁচাতে এবং সঠিক নিয়মে হাসপাতাল পরিচালনা করতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সিলেট অঞ্চলের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান