গালিবের জন্য এলিজি

গালিব। পুরো নাম আব্দুল্লাহ আল গালিব। জন্ম ২০০২ সালের শেষদিকে। টীনএজ পাস করেনি এখনও। করোনা না হলে দ্বাদশশ্রেণিতে উঠার কথা তার। অথচ ২৬ রামাদান দিবাগত রাত লাইলাতুল কদরের ঠিক শেষ প্রহরে সে পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে। মা’বুদের ডাকে সাড়া দেওয়ার কী আচনক একটা সময় সে বেছে নিয়েছে! এই নাতিদীর্ঘ জীবনে সে যা অর্জন করে গেছে তাও সবার তকদিরে নসিব হয় না। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের অতি প্রত্যুষেই বিদায় নেওয়া গালিবের রেখে যাওয়া আখলাকের মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য অপরিহার্য শিক্ষা।

এই পৃথিবীতে মানুষ মুসাফিরি জিন্দেগী যাপন করতে এসে কেউ উষালগ্নেই চলে যায়। আবার কেউ শতায়ুও লাভ করে। গালিব তার জীবনের আলোকিত মিনার মাত্র গড়তে শুরু করেছিলো। আল্লাহ তাকে নিয়ে গেলেন। আমি তার নগণ্য শিক্ষক হিসেবে খবরটি শুনেই হৃদয়ে একটি ঝড় বয়ে যায়। যা আমার জন্য বহন করে যাওয়া নিদারুণ দুঃখ, কষ্ট ও অনুতাপের।

২০১৫ সালের ১ জানুয়ারী আমি ঘোড়াডুম্বুর হাফিজিয়া দাখিল মাদরাসায় সুপার পদে জয়েন করে কাজ শুরু করলে গালিব ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়। প্রাথমিকভাবে আমিই তার বেশির ভাগ সাবজেক্টের টিচার ছিলাম। অল্প ক’দিনেই আমি তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভার সন্ধানে সমর্থ হই। বার্ষিক পরীক্ষায় সে অভাবনীয় ফলাফল করে সবাইকে চমকে দেয়। আমি তাকে প্রমোশন দিয়ে ক্লাস এইটে দিয়ে দিই। সেখানেও ভালো ফলাফলের পাশাপাশি সরকারী স্কলারশীপ লাভ করে উঠে যায় দাখিল পর্যায়ে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত দাখিল পরীক্ষায় সে অল্পের জন্য জিপিএ ফাইভ পায়নি। কিন্তু নাইস হ্যান্ডরাইটিং, বক্তৃতা, বিতর্ক, ক্রিড়া ও পড়াশোনায় এক অকল্পনীয় নজির দেখাতে সক্ষম হয়।

দাখিল পাশের পর আমি তাকে বিদায় দিতে চাই কিন্তু সে যেতে চায় না। আজও আমার মনে গেঁথে রয়েছে তার সেদিনের কথা। সে বলেছিলো, “আমি আজীবন আপনার কাছাকাছি থাকতে চাই। আপনি আমার একমাত্র অভিভাবক। আপনি স্বপ্ন দেখান বলেই আমি গরীবের সন্তান জীবনের এই কঠিন পথে মাড়িয়ে আসতে পেরেছি” —এরকম আরো অনেক কথা। তাই আমিও তাকে ছেড়ে দেইনি। নিজ তত্বাবধানে ভর্তি করে দিলাম দক্ষিণ সুরমার জালালপুর সিনিয়র মাদরাসায়।

সেখানে তার নিরিবিলি পড়াশোনা চলছিল বেশ ভালোই। কখন যে তার শরীরে কিডনীরোগ বাসা বাধে, সে টেরই পায়নি। অত্যন্ত লাজুক ছেলেটি তার পরিবারকেও জানায়নি তার এই অসুস্থতার কথা। করোনার কারণে শুরু হয়ে যায় লকডাউন ও খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনসংগ্রামের নির্মম ইতিহাস। তার গরীব বাবা পারেননি হয়তো তাকে উন্নত কোনো ডায়াগনোসিস সেন্টারে নিয়ে যেতে। আমি যখন জেনেছি, তখন তার বিশাল ক্ষতি হয়ে গেছে। সিলেট নগরীর মাউন্ট এডোরা হসপিটালে করেন বিকাল ৪টার দিকে। আমাকে খবর দেন রাত ৯টার সময়। আমি পরেরদিন তার খোঁজ নিতে যাব মনস্থ করেছি। ফান্ডরাইজিং শুরু হয়েছে। যেকোনো মূল্যে তাকে বাঁচাতে হবে মর্মে সবাই অঙ্গিকারাবদ্ধ। রাত ১১টার দিকে খবর আসে তাকে আইসিইউ-র ভেতরে নেওয়া হয়েছে। সাহরীর সময় যে খবর আসে তা শোনার জন্য আমার মন–প্রাণ কিছুতেই প্রস্তুত ছিলো না। আমার হাত–পা, চোখ–মুখ যেনো দুঃখের বরফে জমে গলিত পানির মতো চোখ দিয়ে বের হচ্ছে।

গালিব তো চলে গেলো। ফেসবুক ভরে গেলো গালিবময় পোস্টে। সবাই আক্ষেপ করলেন। সে যে কতটা প্রিয় ছিলো তার শিক্ষকগণের তা প্রকাশ পেয়েছে মৃত্যুর পর। কত মানুষের চোখের দু’পাশ ভিজে গেছে নোনা জলে। কত মানুষ আসে যায়। বলেন তো কতজন বেঁচে থাকে তার কর্মে? কার জন্য মানুষ হাহাকার করে। কার এলিজি লিখে মানুষ? গালিবের জন্য লিখা হয়েছে, হচ্ছে।

এই দেখুন আমি একটি এলিজি লিখে গালিবকে উৎসর্গ করেছি। আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলি হে গালিব! বাবা তোমার জন্য মাবুদের নিকট জান্নাতুল ফিরদাউস কামনা করি। তুমি এই সংক্ষিপ্ত জীবন দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করে গেছো। আজ আমি অঙ্গিকার করছি—তোমার জীবনকে আমি বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেব না।

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক, মাদরাসার সুপারিন্টেনডেন্ট।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 

আরও সংবাদ