বন্ধু হারানোর কাতরতা
জীবনের যাত্রা অথবা ভিন্ন সবার সাথে মিশে নিজেকে জেনে নেওয়া অথবা ভবিষ্যতের জন্য একজন ভালো মানুষ হওয়া। সবকিছু-ই স্কুল লাইফ থেকে শুরু। পরিবারের পর প্রথম শিক্ষা আর অন্য কিছু মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার যাত্রাটাও এখান থেকে শুরু। কতোশত মুখের সাথে কতো চরিত্রের সাথে দেখা হয় কথা হয় কারো সাথে মনের মিল হয় এবং এক পর্যায়ে একটা ভালো বন্ধু হয়৷ আর অনেক গোপনীয়, অগোপনীয়, জানা অজানা অনেক গল্পের শেয়ার কেয়ারও এখান থেকে শুরু হয়। বন্ধু নামের ব্যখ্যাটা বা বন্ধুত্বের গল্পটা পৃথিবীর কেউ কোন লিখার মাঝে তুলে ধরতে পারেনি। পারবেও বলে মনে হয়না। পৃথিবীর সব গল্পের একটা শেষ শব্দ থাকে সেটা হলো সমাপ্ত। কিন্তু বন্ধুত্বের গল্পের কোন শেষ শব্দ থাকতে চায় না।
আচ্চা এখন মূল বিষয়ে আসি। স্কুল লাইফের শুরুতেই যারা আমার বন্ধু হয়েছিলো তাদের মধ্যে `কামরুল’ অন্যতম একজন। ধরাযায় ছাত্র জীবনের শুরু থেকেই তার সাথে আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়। যখন আমরা ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন টিফিন টাইমে স্কুলের বারান্দায় কাবাডি খেলতাম। প্রায় সময়ই `কামরুল’ আমার টিমে থাকতো। টেস্ট ক্রিকেট খেলার সময় সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী; কারণ উভয়েই ভালো টেস্ট খেলতাম। অনেক ঝগড়া রাগারাগি অনেক সময় হতো। ছোটবেলার বন্ধুত্বে শেয়ার কেয়ারের এগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। তবে সেগুলো আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে একটুও বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি।
ছোট বেলা থেকেই আমি একটু বদমেজাজি টাইপের। মাঝে মাঝে কোন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা গরম করে বন্ধুকে উল্টা-পাল্টা বকাঝকা করতাম। কিন্তু সে এগুলা একটুও সিরিয়াস নিতো না। বন্ধু ভেবে সেগুলো এড়িয়ে যেত। যাতে আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।
ক্লাস ফাইভ-এ থাকাকালীন সে পড়া লেখায় আমার সাথে প্রতিযোগিতা করতো। স্কুলের নির্মল স্যারের ক্লাসে সবার আগে কে অংক করে স্যারকে দেখাবে সেই প্রতিযোগিতা হতো দু’জনের মাঝে। কখনো আমি আবার কখনো সে আগে খাতা স্যারকে দেখাতো। অতঃপর ক্লাস সিক্স- এ উঠার পরেও আমরা দুইজন সেইম উচ্চ বিদ্যালয়ে (খলাগাঁও করিম্পুর উচ্চ বিদ্যালয়) ভর্তি হই। তখন থেকে খেলাধুলার প্রতি মনোযোগটা একটু বেশিই চলে যায়। টিফিন টাইমে ক্রিকেটে টেষ্ট খেলা আবার কখনো স্কুল ফাকি দিয়ে মৌলভী টিল্লায় ক্রিকেট ম্যাচ খেলা। তখনকার সময়ের বেশ আনন্দদায়ক দিন। এখনো করতে পারলে হয়তো এমন হতো।
প্রায় সময় সে আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে নিয়ে আসতো। আমার আপু, আম্মু তাকে খুব ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে আমার বাড়িতেও টেস্ট ক্রিকেট শুরু হয়ে যেত তার সাথে। বলে রাখা ভালো আমাদের ক্রিকেট কিন্তু খুব ফেভারিট ছিল। আর তার সাথে আমার খেলাটা বেশ জমে উঠতো।
ক্লাস সিক্স-এ থাকতে হঠাৎ একদিন আমার একটা মোবাইল আসলো দেশের বাহিরে থেকে। তখন আমি ওটাতেই ফেইসবুক খুলি। তখনকার সময়ে একটা মোবাইল আর ফেইসবুক একাউন্ট অনেক বড় ব্যাপার স্যাপার।
স্কুলে গিয়ে তার সামনে ফেইসবুক ইউজ করতাম। আমার বন্ধুটারও খুব আগ্রহ ফেইসবুকের প্রতি; সেও কৌতুহলী হয়ে দেখতো আর জিজ্ঞেস করতো বন্ধু এটা দিলে কি হয়? ওটা দিলে কি হয়?
তারপর যখন আমরা ক্লাস এইট/নাইন এ পড়ি তখন তার বাড়ির একটা ফোনে সে ইন্টারনেট চালু করে। অতঃপর আমি তাকে একটা ফেইসবুক একাউন্ট খুলে দেই। তারপর প্রতিদিন স্কুলে আসলে ওর ফেইসবুক নিয়ে একটা না একটা প্রশ্ন থাকত-ই। ফেইসবুক নিয়ে প্রতিদিনই তার সাথে প্রায় ঘন্টা খানিক আলাপ হত।
এভাবেই ৪ বছরের সমাপ্তি। সময়ের অনেক তাড়া। কারো জন্য থামতে ইচ্ছে হয় না। একসময় চলে আসে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষার পর অনেক শিক্ষার্থীদের জীবন পাল্টে যায়। পাল্টে যায় বন্ধুত্বের সঙ্গা। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমরা একেকজন একেক কলেজে ভর্তি হই।
আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পলিটেকনিকে ভর্তি হই। সেখানে আমার কোন স্কুল ফ্রেন্ড ছিলনা। নতুন এক পরিবেশ। নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয়। তবুও `কামরুল’ আর আমার বন্ধুত্বে কোন বাধার সৃষ্টি হয়নি।
পাশাপাশি গ্রাম। একটা বাজার। প্রায় সময় বাজারে দেখা হতো তার আমার। তাছাড়া মাঝে মাঝে সে আমাদের বাড়িতে আসতো- তার ফোন বা ফেইসবুকের কোন সমস্যা হলে। কাগজের মধ্যে সে তার সব প্রশ্ন লিখে নিয়ে আসতো আমার কাছে। আমি একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিতাম। একটা অদ্ভুত মানুষ ছিল।
হঠাৎ একদিন তার আইডির পাসওয়ার্ড সে ভুলে যায়; এমন কী ইমেইল টাও ভুলে যায়। আমার কাছে আসার পর আমি কয়দিনের চেষ্টায় আইডি ব্যাক করে দেই। তখন সে বলেছিলো বন্ধু টাকা পাইলে তোরে রাজমহলে ট্রিট দিব।
ব্যস্ততায় আমাদের অনেক দিন অনেক সময় চলে গেল সেই ট্রিটটা আর তার দেয়া হলনা। আমি মেসে চলে যাই। কারণ আমার পরিক্ষা ছিল।
তারপর আর দেখা হয়নি। হঠাৎ একদিন গ্রামের একটা বন্ধুর কাছে থেকে শুনি তার নাকি ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের কোন ডাক্তারের দ্বারাই এর অপারেশন করা সম্ভব না। তখন আমি পরীক্ষার মধ্যে বিরতিতে বাড়িতে আসি। কিন্তু তখন সে হসপিটালের বেডে। আবার যেইদিন বাড়িতে আসি সেদিনও তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হসপিটালে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। তার সাথে আমার দেখা করার কোন সুযোগ-ই হচ্ছে না।
আমার বন্ধুরা তাকে দেখতে গেলে ওদের কাছে প্রতিদিন সে জিজ্ঞেস করে আমি আসিনা কেন? আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে এই পরীক্ষা টা একটা বিশাল পরীক্ষা ছিল। আমি তখন সেটা ভেবেছিলাম এটা শুধু আমার একাডেমিক পরীক্ষা। কিন্তু আসলে এটা আমার জীবনে আরও কিছু পরীক্ষা ছিল। বন্ধুত্বের পরীক্ষা।
এই পরীক্ষার কাছে হেরে যাই আমি। দেখা হয়নি তার সাথে।
অতঃপর একদিন মধ্য রাতে বন্ধু ফয়সলের ফোন। কান্না জর্জড়িত কন্ঠে বললো- “বন্ধুরে কামরুল আর পৃথিবীতে নাই।
কথাটা শোনার পর একটা কিরকম অনুভূতি লক্ষ করলাম ।চারিদিক অন্ধকার মনে হচ্ছে। আমি যেন আমার জীবনের খুব বড় একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে খুব অপরাধীও মনে হয়েছিল। কি করবো কি না কিছুই বুঝতে পারিনি।
কামরুলের সাথে শেষ দেখা হয়েছে আমার। কিন্তু সেটা শুধু আমারই দেখা। এসেছি আমি দেখা করতে। সে তখন চির নিদ্রায় শায়িত। বন্ধু এখন আর কথা বলেনা। আমাকে আর কোন প্রশ্নও করেনা। ওর ফেইসবুকেও এখন আর কোন সমস্যা হয় না। আমি যখন তাকে লাশ রাখার কাঠের মাঝে দেখি, আমি ভাবছি- সে ঘুমিয়ে আছে। সে আবার জেগে উঠে আমাকে বলবে- বন্ধু আমার তো ফেইসবুকে আবার সমস্যা হয়েছে।
মানুষের জীবনটা আসলেও পরিমাপ করা সম্ভব না। পৃথিবীটা অনেক স্বার্থপর। কখনো কাউকে আমাদের কাছে আপন করে দেয়। আবার চিরদিনের জন্য ছিনিয়ে নেয়। কথা বলা আড্ডা গল্প সবকিছু স্মৃতিতে ফেলে দিয়ে যায়। হারানোর মূল্য অনেক বেশি। আমরা হারাতে চাই না। কিন্তু প্রকৃতি হারিয়ে নেয়। যে বন্ধুর সাথে আড্ডা ফূর্তিতে সব সময় মেতে থাকতাম। আমার সেই বন্ধুটা যে আর কোনদিন কথাই বললো না। সে আমাদের সবাইকে একলা রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালো।
আমার তো ট্রিটের কোন প্রয়োজন ছিলনা। ট্রিট থেকে তো আমার বন্ধুটা সবচেয়ে দামী। খুব ইচ্ছে করে অনেক জুরে চিৎকার করে বলতে, বন্ধুরে, আমার ট্রিট লাগবেনা, শুধু তুই ফিরে আয়- বন্ধু। স্বার্থপরের মতো আমাকে একা রেখে চলে গেলে না ফেরার দেশে। ওপারে ভালো থাকিস বন্ধু। আমার প্রতিটা মোনাজাতে তুই আছিস, তুই থাকবি। আল্লাহ তোরে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।
লেখকঃ ফ্রিল্যান্সার, তরুন সংবাদকর্মী
এশিয়াবিডি/ডেস্ক

