চোরাবালি

গোধূলীর যৌবনে যখন অরণ্য অপরূপ সাজে সজ্জিত ঠিক তখন গিয়ে পৌঁছিলাম পাহাড়ের ওপর দাড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ কর্টেজের দ্বারপ্রান্তে। কর্তৃপক্ষের কঠিন নির্দেশ- এক উর্দ্ধতন অফিসারের বর্ষা নামের আদরের দুলালি উক্ত কর্টেজে অবস্থান করবে দু’দিন। তার সার্বিক দেখাশুনা করতে হবে বিনা বাক্য ব্যয়ে।
এমনিতেই জীবনের বোঝা কাধে নিয়ে চলতে চলতে ক্লান্ত; তার ওপর প্রতারণার বিষাক্ত ছোবলে সমস্ত অস্তিত্ব নীল। তারপরও নির্দেশ মানতে বাধ্য হলাম; কারণ সামরিক জগতে নির্দেশ অমান্য করার কোন কৈফিয়ত প্রযোজ্য নয়।
কিন্তু যখনই বর্ষা নামের আগুন ঝরা মেয়েটাকে দেখলাম সম্পূর্ণ একা তখনই এলোমেলো হয়ে গেল আমার পৃথিবী। এত সুন্দরী মেয়ে বাস্তবে তো পরের কথা স্বপ্নেও দেখিনি! তবুও অতীতের স্মৃতি আমাকে থামিয়ে দিল। সাথে সাথে আবারও মগজের কোষে সেই কুড়িয়ে পাওয়া উপদেশটা উঁকি দিল- ‘‘মেয়েরা সাপের মত। নিঃশব্দে চলে, চুপিসারে জায়গা করে নেয় পুরুষের বুকে এবং একসময় ছোবল বসায়। আবার মেয়েদের চোরাবালিও বলা যায়- দেখলে বুঝা যায় না কিন্তু যখন টের পাওয়া যায় তখন করার আর কিছুই থাকে না।’’
জানি না কেন- তবে আমরা মুখোমুখি হতেই তার অবস্থা আমার চেয়েও করুণ হয়ে গেল। মনে হল এই মুহূর্তে গোটা কাঠামোটা ভেঙ্গে লুটিয়ে পড়বে লাল কার্পেটে। পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য আমি আমার পরিচয় এবং এখানে আসার কারণ তাকে জানালাম। শুনে এমন এক চেহারা হলো, যার মর্ম কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে ক্ষণিক পরেই তার চোখের তারায় রহস্যেময় এক আলো দেখা গেল। তার-ই সাথে পাল্টে গেল মুখাবয়ব। চোখে মুখে অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা। ভঙ্গিতে স্পষ্ট আমন্ত্রণ। মুখে কিছু না বললেও স্পষ্টই বুঝলাম- এটা প্রেম নিবেদনের একটা অভিনব সহজ সরল পন্থা।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কিংবা অলৌকিক ঘটনা- যা-ই বলি না কেন, জীবন চলার পথে বারবার কষ্টের সাথেই দেখা হয়। বারবার ফিরে আসে যন্ত্রণাময় অতীত আর ভালোবাসাময় নিষ্টুর এক যুবতীর নগ্ন শরীরের ওপর লাশ হওয়া এক যুবকের ছবি। তাই ভেবে ভেবে নিজের সীমানা ছাড়িয়ে যাই। তবুও ভাবি। যার পাশে আমার মতো কাউকে কিছুতেই শোভা পাবে না অথবা যে আমাকে নিয়ে কখনো সুখী হতে পারবে না- সেই রকম মেয়েরাই কেন বারবার আমাকে হাতছানি দেয়? বলতে দ্বিধা নেই শুধু একটা মেয়ের জন্য আমি তাদের পৃথিবীসম নিষ্পাপ প্রেমকে পায়ে ধলে নিষ্টুরতার পরিচয় দিতে বাধ্য হই। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না তাদের রূপ, যৌবন, সততা, বিশ্বস্ততা কিংবা ভালোবাসাকে। তাই ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে সাজি। পলাতক হই তাদের বসন্ত থেকে অশান্ত সন্ধ্যায়। তাদের ঋতু থেকে, মাস থেকে, দৃষ্টি থেকে বৃষ্টির আলপনা সৃষ্টির অন্তরালে।
সন্ধ্যা ঘনালে বর্ষা যখন আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠালো; সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় সাড়া দিতে বাধ্য হলাম। তবে মনটা কেন যেন বারবার বললো- যেও না ওখানে, ডুবে মরবে। তবুও চাকুরীর কারণে গেলাম। সে আমাকে তার মুখোমুখি বসাল। বললো, যদি ভুল না দেখি অথবা যদি ভুল না বুঝি তা হলে জানতে চাইব- মেয়েদের ব্যাপারে কেন এত দ্বিধা?
তার প্রশ্নের সাথে আমার অতীত বোঝা-পড়ায় বসে গেল। বলতে বাধ্য করলো মস্তিষ্ক- অনেক মেয়েমানুষ আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে থাকার পরিনতি কী হয় তা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। অনেক মেয়েকে ভালোবেসে দেখেছি। কি আছে তাদের? কি দেয় তারা?
বর্ষা উঠে দাড়িয়ে আমার পায়ের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। বললো- বিশ্বাস করবে কি না জানি না, তবে তোমার মত কাউকে আমি খুঁজছি অনন্তকাল ধরে; কল্পনার গ্রহ-গ্রহান্তরে। বহু পূর্ণিমা, বহু অমাবস্যা, বহু ইতিহাস কালের অতলে হারিয়ে যাওয়ার পর তুমি এসেছ। যদি তোমার কোন কষ্টের অতীত থাকে- ভুলে যাও। এসো আমার বুকের জমিনে। চাষাবাদ করে শষ্য তুলে নাও। দেখবে কতটা উর্বরা আমি।
লাফ দিয়ে উঠলাম বর্ষার কথা শুনে। সেও সটান দাড়িয়ে গেল। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে কিলবিল করতে লাগল সেই যন্ত্রণাদায়ক অতীত। কিছুতেই এমন নিষ্পাপ প্রেম এড়িয়ে যেতে পারছি না। কিন্তু আমার সেই প্রতিজ্ঞা, সেই হারানো বিশ্বাস, সেই মানসিক ক্ষতি, সেই রক্তে ভেজা ছবি কিছুতেই আমাকে স্থির হতে দিচ্ছে না। একসময় সব প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে দিয়ে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল।
আমার এমন দিশেহারা অবস্থা দেখে বর্ষা বুকের সাথে মিশে গেল, শীতল কন্ঠে বললো- আমাকে নির্লজ্জ ভাবছ! ভুল করছ! প্রেম পিপাসায় আমার বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তবুও স্বপ্নের পুরুষের দেখা পাওয়ার আশায় হেঁটে পাড়ি দিয়েছি হাজার মাইল। আজ আমার স্বপের সেই পুরুষের বুকে মিশে আছি। তুমি বিশ্বাস করো- মনে-প্রাণে, সত্তায়-আত্মায় শুধু তোমাকে চাই।
আমি বর্ষাকে ছাড়াতে চাইলাম। দেখাতে চাইলাম হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। অবুঝ মেয়েটা অবুঝই রইল। আমাকে তার বুকে চেপে ধরে পিষে ফেলতে চাইল। তার ব্যাকুলতা দেখে বুঝলাম পাগল হয়ে গেছে সে। আমি প্রাণপন বাধা দিলাম। সে আরও হিংস্র হয়ে উঠল। করুণ কন্ঠে বললো- আমি ক্ষুধার্ত! একবার হলেও ভালোবাস আমায়।
এমন নির্লজ্জ কামুকতা মানায় না কোন মেয়েকে। এমনিতেই রক্তাত ঘা অন্তরের অন্তরস্থলে। তার ওপর এমন এক আহবান। তবে এটা স্পষ্ট বুঝলাম- বর্ষার এই আকুলতা, এই প্রেম, শুধুমাত্র বয়সী একটা আবেগ। এখানে পরিপূর্ণ বয়সের প্রেম নেই। তাই এই মুহূর্তে নিজেকে যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি হয়তো একটা অপরাধী ছাড়া আর কিছুই হতে পারব না। তার কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে একটা প্রহসন করতে বাধ্য হলাম।
সমস্ত রাত নিজেকে নিয়ে হিসেবে মাতাল থাকলাম। বারবার ভালোবাসার সীমানা ছুঁয়ে ফিরে আসলো মন শুধু সেই উপদেশের কয়েকটা শব্দের ক্ষমতায়- মেয়েরা চোরাবালি।
ভোরের সূর্যের সাথে কেমন যেন একটা হিংসাত্বক অভিব্যক্তি নিয়ে বর্ষা আমার মুখোমুখি হলো। আমি আমার অক্ষমতা, রক্তাত্ব ক্ষত-বিক্ষত অতীত দিয়ে তাকে বুঝালাম। সে অভূক্ত বাঘিনীর মত আচরণ করতে করতে চলে গেল।
সাথে সাথে আমি আমার অফিসারকে বিস্তারিত জানিয়ে ফেরত আসার অনুমতি চাইলাম। তিনি সব শুনে আমাকে ফেরত আসার অনুমতি দিলেন। আমি বর্ষার আকাশ থেকে মুহূর্তের নোটিশে হারিয়ে গেলাম।
কিন্তু নিয়তি এখানেও আমাকে নিয়ে নিষ্টুর খেলা খেললো। বর্ষা নামের এক আবেগী মেয়ে আমাকে আবারও সেই উপদেশ বাক্যের সত্যতা প্রমাণ করে দিয়ে গেল। সে তার বাবার কাছে আমার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর অভিযোগ করলো।
কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে জানি। হয়তো চাকুরীও হারাতে পারি। কিন্তু কেন এমন হয় বারবার? কেন আমাকে নিয়ে পৃথিবীর এমন খেলা? তবে কেউ না জানুক আমি খুব ভালোভাবেই জানি কেন ভালোবাসতে পারিনা তাদের মত- যারা আমাকে বর্ষার মত ভালোবাসে।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
