কুহেলী প্রহর

জেনি পার্কারের সাথে পরিচয় হয়েছিল ডাবলিনের এক নির্জন গলিতে অবাঞ্চিত এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। হাতের মুঠোয় অফুরন্ত সময় নিয়ে যখন আয়ারল্যান্ডে বাউন্ডুলের মতো ঘুরছি, তখন এক সন্ধ্যায় নির্জন এক গলিতে একটা যুবতী মেয়ে ধর্ষিত হতে যাচ্ছে দেখে প্রতিবাদী হয়ে তাকে রক্ষা করতে সফল হয়েছিলাম। সেই থেকেই জেনির সাথে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। জেনি অবশ্য নিজেকে ঋণী ভেবে ঋণ শোধের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল; এমন কি সম্পর্কের গভীরতা বাড়াতেও চেয়েছিল। কিন্তু  আমি তো বাউন্ডুলে,  আমার তো চাইলেও থামা হবে না কারও জীবন প্রান্তে। শেষে জেনি ব্যর্থ হয়ে আমাকে একটা ওয়াদায় বেঁধে নিল- আয়ারল্যান্ডে এলে তার সাথে দেখা না করে যেন বেরিয়ে না যাই।
জীবনের গতিতে সেই যে আয়ারল্যান্ড থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। দীর্ঘ ছয়টি বছর আর ওখানে যাওয়া হয়নি। কিš‘ ছয় বছর পর যখনই এখানে এলাম সর্ব প্রথমই জেনির কথা মনে হল। হাতের কাজ গুছিয়ে নিয়ে তার বাসায় ফোন দিলাম। জেনির মা জানালেন- জেনি ডাবলিনে নেই। একটা চাকুরী পেয়ে সে পশ্চিম আয়ারল্যান্ডে চলে গেছে। তার মায়ের কাছ থেকে সেই ফার্মের ফোন নম্বারটা নিলাম। ফোন করতেই একটা মেয়ে ফোনটা রিসিভ করল। জেনিকে চাইতে সে তাকে ডেকে দিল।

আমার কন্ঠ শুনেই জেনি আবেগে ভেসে গেল। পরক্ষণে হঠাৎ করেই তার কন্ঠের পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। অস্বাভাবিকভাবে আমার খোঁজ-খবর নিল। আমি বললাম- “তোমার ঠিকানা দাও; আয়ারল্যান্ডে যখন এসেছি তোমার সাথে দেখা করে যাই। জীবনে হয়তো আর এখানে নাও আসতে পারি।” জেনি সাথে সাথে কোন উত্তর দিল না। একটু পরে বলল- তুমি ডাবলিনে থাক। দুই দিন পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসছি।
ঘন্টাখানেক পর জেনি আমার হোটেলে ফোন দিল। জানাল সে ছুটি পাচ্ছে না। ঝাপসা একটা ঠিকানা দিয়ে বলল যেন কালই রওয়ানা দিয়ে দেই। ঠিকানা অনুযায়ী বুঝলাম শ্যানন এর মোহনা আর ট্রালী বে’র মাঝামাঝি কোথাও থাকে সে।
গ্রেইস্টোনসে একটা কাজ বাকি ছিল তাই ডাবলিন থেকে ওখানে গেলাম। পরদিন সকালেই ভাড়া করা অস্টিন নিয়ে জেনির ফার্মের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। একটা সমস্যা প্রথম থেকেই সৃষ্টি হয়ে বসে আছে। জেনি তার ফার্মের সঠিক অবস্থান আমাকে দিতে পারেনি। কারণটাও স্বাভাবিক। পশ্চিম আয়ারল্যান্ডের ঐ দিকের বেশিরভাগ এলাকা দূর্গম গভীর বনভূমি আর পাহাড় ঘেরা। আর ফার্মাটা ঐ দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত । তাকে ওখানে হেলিকপ্টারে করেই আসা যাওয়া করতে হয়। তবে মোটামুটি একটা ধারনা দিতে তার তেমন কোন সমস্যা হল না।

গ্রেইস্টোনস থেকে রওয়ানা দিয়ে প্রায় একশত পঞ্চাশ মাইলের মতো চলে এসে থামতে বাধ্য হলাম। ম্যাপটা দেখা দরকার। ওয়ান-ইঞ্চ স্কেল ম্যাপটা ভালোভাবে পরীক্ষা করলাম। জেনি বর্ণনার সাথে মিল রেখে ম্যাপে জায়গাটার মোটামুটি একটা অবস্থান নির্ধারণ করতে পারলাম। জায়গাটা হল ক্যাসল আইল্যান্ড থেকে প্রায় সাড়ে চার মাইল উত্তরে। অ্যাবিফিল গ্রাম থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। ম্যাপটা গুছিয়ে রেখে আবার রওয়ানা দিয়ে প্রায় দশ মাইল এগিয়ে বামে মোড় নিয়ে একটা মেঠো পথ ধরে চলে এলাম নকাকিন পাহাড়ের ঢালে। ম্যাপ বের করে নিজের অবস্থান ঠিক করলাম। আমি দাঁড়িয়ে আছি অ্যাবিফিল গ্রাম থেকে প্রায় আট-নয় মাইল দক্ষিণ-পূবে। তার মানে যেখানে আছি তার পশ্চিমে খুব কাছাকাছি কোথাও ফার্মটা।

জায়গাটা এতই নির্জন যে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় আর জঙ্গল। ওখানে দাঁড়িয়েই গ্যানরাডারি পাহাড়ের মাথা দেখা যায়। গাড়ি থেকে নেমে সামনে একটা পাহাড় চূঁড়ায় উঠলাম। বিনকিউলার চোখে তুলতেই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই প্রায় দেড় মাইল দূরের রোজ ভ্যালি ফার্মটা লাফ দিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল। ফার্মটাকে নিয়ে প্রকৃতির অদ্ভুদ খেলা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। ফার্মটার দু’পাশে দু’টো পাহাড় ইংরেজি ভি হরফের মত। ওই ভি’র মাঝেই বিশাল ফার্মটা। গাছ-পালা আর পাহাড় ফার্মটাকে এমন ভাবে আড়াল করে রেখেছে হঠাৎ করে এটা কারও চোখে পড়বে না। এমন কি আকাশ দিয়ে ওড়ে যাওয়ার সময়ও নয়। যদিও ওদিকে চোখ যায় ভালো ভাবে দৃষ্টি না দিয়ে কেউ বুঝতেই পারবে না আসলে ওখানে কি আছে। বিনকিউলার চোখ থেকে না নামিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। বিশাল ফার্ম হাউজের কাছে ট্রেইলর লাগানো নীল রং করা এবং ফার্মের ছাপ মারা বেশ কয়েকটা ট্রাক্টর প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। এক পাশে একটা হেলি-প্যাডও আছে। হেলি প্যাডে নীল রং করা রোজ ভ্যালি ফার্ম লেখা একটা সিকোরস্কি প্যাসেঞ্জার হেলিকপ্টারও দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়িতে ফিরে এসে ম্যাপ নিয়ে বসলাম। উল্টো পথে আসা হয়ে গেছে। ফার্মের পশ্চিমে অবশ্য বেশ কয়েকটা মেঠো পথ আছে, যা দিয়ে ফার্মে ঢুকা যায়। কিš‘ এদিক দিয়ে ফার্মে ঢুকার কোন রাস্তা পেলাম না। শেষে হঠাৎ করেই মাথায় একটা বুদ্ধি এল। পাহাড় ডিঙিয়ে ফার্মে যাব। অরণ্যের প্রতি দূর্বলতা ক্রমে রক্তের গতি বাড়িয়ে তুলল।
প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস নিয়ে গাড়ি ছাড়লাম। বন্য প্রাণিদের চলার একটা পথে হাঁটতে লাগলাম। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে বাতাসের মৃদু ছন্দ। পায়ের নিচে ঝোপ-ঝাড় আর ঘাস। আসে-পাশে অসংখ্য অপরিচিত বুনো ফুলের সুন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে বেশ কয়েকটা পাহাড় পিছনে ফেলে এলাম।

ফার্মটার সিকিউরিটি সিস্টেমটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। সাধারণত পশ্চিম আয়ারল্যান্ডে যেখানে কোন ফার্ম থাকারই কথা নয় সেখানে এই ফার্মে এত সিকিউরিটির কি প্রয়োজন ভেবে পেলাম না। কিন্তু  ফার্মে ঢুকেই এর উত্তর পেলাম। দূভার্গক্রমে রোজ ভ্যালি ফার্মে ঢুকেই এমন কিছু আবিষ্কার করলাম যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখানে ফার্মটা জাস্ট একটা শো। আড়ালে বেআইনী এমন কিছু হ”েছ যা দিয়ে মালিক টাকার পাহাড় গড়ছে। জেনির অব¯’ান আমাকে দ্বন্ধে ফেলে দিল। কিš‘ তখনও বুঝে উঠতে পারিনি- আমি ফাঁদে পা দিয়েছি।

ফার্ম মালিককে দেখেই আমার পৃথিবী ঘুরে গেল। এ হল সেই লুটাস যে ডাবলিনে জেনিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। আর সেই লুটাসের ফার্মেই জেনি কিভাবে চাকুরী করে এ জিনিসটা বুঝে উঠতে পারলাম না!
লুটাসের নির্দেশে আমাকে বন্দি করা হল। জেনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল। আমি প্রশ্ন ছুড়লাম- কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে । উত্তরে লুটাস জানাল- সে জীবনে কখনও কিছুতেই ব্যর্থ হয়নি একমাত্র ডাবলিনের সেই সন্ধ্যা ছাড়া। আর সেই অব্যর্থতার জন্য নিজেকে অন্ধকার জগতের রাজা বানাতে কোন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু  যখন জীবনের প্রথম ব্যর্থতার মুখ দেখল একমাত্র আমার জন্য তখন প্রতিশোধের আগুন তার অন্তরকে জ্বালিয়ে ছাই করে দিল। জেনিকে জোর করে তার বিছানা সঙ্গি বানিয়ে সেই আগুন কিছুটা নিভাতে পারলেও তার আসল শিকার এই আমি তখন আয়ারল্যান্ড থেকে চলে যাওয়ায় সেই হিসাবটা বাকি থেকে যায়। কিš‘ কাল যখন জেনিকে ফোন দেই তখন সে জেনির পাশেই ছিল। সুযোগ বুঝতে সময় লাগেনি। জেনিকে বাধ্য করে আমাকে এখানে নিয়ে আসার খেলা খেলতে।
লুটাস একটু সময় নিয়ে আবার বলল- বেচারির তোমার প্রতি বেশ অনুরাগ। কিন্তু  পিস্তলের মুখে দাঁড়িয়ে সেই অনুরাগ কয়জন ধরে রাখতে পারে। জেনিও পারেনি। তবে আমি আজ নিজের একমাত্র ব্যর্থতাকে ঢাকতে সফল হব তোমাকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দিয়ে। খেলার ছকটা এমন ভাবে করেছি- সবাই জানবে তুমি একটা দূঘটনার শিকার। নাও, রাতটা প্রার্থনা করে কাটিয়ে দাও। আর ভোরের খেলার জন্য প্রতি নাও।

জেনিকে একটা প্রতারক মনে হল। কিন্তু   শিকার এবং লুটাসের হাতের খেলনা। জেনি খুব সুন্দর একটা ছক করে আমাকে এই কঠিন সিকিউরিটির মাঝে পালাতে সাহায্য করল। তবে সবচেয়ে বিপদজনক সমস্যা হল আমি আমার গাড়ির দিকে যেতে পারব না। লুটাসের প্রথম টার্গেট হবে আমার গাড়ি।
রাতের আধাঁরে চাঁদের আলোয় গভীর অরণ্যের মাঝে শুধু আন্তাজের উপর ভর করে চললাম। চলতে চলতে জেনির তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলাম। লুটাস এই ছয় বছরে বিশাল এক ক্ষমতাশালী লোকে পরিণত হয়েছে কিছু অবৈধ ব্যবসা করে। লোকটা অনেকটা পাগলের মতোও। ডাবলিনের সেই সন্ধ্যা সে জীবনেও ভুলবে না এমন প্রতিশ্রুতি  দিয়েছে জেনির কাছে। জেনির বর্ণনা যদি ঠিক থাকে তাহলে এই মুহূর্তে লুটাসের শিকার তার হাতের মুঠো থেকে পালিয়ে যাওয়ায় আরও পাগল হয়ে যাবে। সে তার সকল ক্ষমতার প্রয়োগ করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে তার বিশাল বাহিনীর কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কোন দিক দিয়ে কোথায় যাব কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। শেষে পরি¯ি’তির উপর ভরসা রেখে এগিয়ে গেলাম। একটাই লক্ষ্য থাকলো যেভাবে হোক আয়ারল্যান্ড থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। না হয় পৃথিবীর আলো আমার জন্য আর আসবে না।

সকালের সূর্যের সাথে আমিও লিমেরিকের অ্যাথেয়া শহরে ঢুকলাম। ফার্ম থেকে শহরটা প্রায় আট মাইল উত্তর-পশ্চিমে। শহরটা একেবারেই ছোট। শহরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা সরাইখানা পেয়ে ঢুকে পড়লাম। নিজেকে কিছুটা হালকা লাগল। কিছুটা নিরাপদও মনে হল। কিš‘ ব্রেকফাস্টটা সারার আগেই বিপদ এসে হাজির হল। একটা নীল রঙের বেডফোর্ড ভ্যান এসে থামল পোস্ট অফিসের সামনে। রোজ ভ্যালির ছাপ মারা। অস্ত্র হাতে নিয়ে চারজন নামল। যা বুঝার বুঝে গেলাম। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওয়ালেট খুজলাম। ওটা ফার্মে অথবা পাহাড়ে কোথাও ফেলে এসেছি। তার বদলে কিছু খুচরো পয়সা পকেটের তলায় পড়ে আছে। এর মধ্য থেকে কয়েক সেন্ট কাউন্টারে রেখে মুহূর্তের নোটিশে পিছনের দরজা দিয়ে একটা নির্জন গলিতে বেরিয়ে এলাম। গলির শেষ মাথায় একটা তিনশো পঞ্চাশ সিসি কাওয়াসাকি দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই দেখলাম মেঘ না চাইলেও আমার জন্য বৃষ্টি অপেক্ষা করছে- ইগনিশনে চাবি ঢুকানো আছে।
সষ্ট্রা ও কাওয়াসাকির মালিকের কাছে ক্ষমা চাইলাম মনে মনে। উঠে বসে স্টার্ট দিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে এলাম। পিছনে এক বৃদ্ধা অবিরত চোর চোর বলে চিৎকার করতে লাগল।

গলির শেষ মাথা থেকেই পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে আঁকাবাঁকা সরু পথ। চূঁড়ায় উঠে থামলাম। পিছনে তাকাতেই দেখলাম বেডফোর্ড ভ্যানটা এ দিকে আসছে। বাঁচতে হলে দ্পারুত লাতে হবে। ডান দিকের পাকা রাস্তাটা উত্তরের ক্যারিকেরী শহরের দিকে গেছে। শহরটা প্রায় ছয় মাইল দূরে। তারপর আরও চার মাইল গেলে আরডাপ গ্রাম, তারপর টি-টোয়েনটি এইট জাংশন। ঢাল বেয়ে নেমে পাকা রাস্তায় উঠে ছুটলাম। কিন্তু  স্পষ্ট জানি ক্যারিকেরী পৌঁছানোর আগেই রাস্তা থেকে সরে যেতে হবে যদি বাঁচতে চাই।

অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পরও নীল ভ্যানটা আমার পিছু ছাড়ল না। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ভ্যানটা মাইল দু’য়েক দূরে একটা চূঁড়া ডিঙাচ্ছে । বিরতিহীন ভাবে ছুটতে লাগলাম মৃত্যু পিছনে নিয়ে। ছোট একটা ব্রিজ পেরিয়ে দেখলাম একটা চৌরাস্তা। ডানে মোড় নিয়ে সরু রাস্তাটা ধরে ছুটতে ছুটতে ট্রালীর উত্তরে একটা গলফ কোর্সের কাছে পৌঁছাতেই দেখলাম এখান থেকে টি-টোয়ানটি এইট পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ।
সন্ধ্যার পরপরই একটা ছোট শহরে ঢুকলাম। শহরটা এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু  কাওয়াসাকির পেট্টল প্রায় শেষ হয়ে গেছে। শহরে ঢুকে দেখলাম এখানেও রোজ ভ্যালি ফার্মের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অভিশাপ দিলাম নিজেকে আর লুটাসকে। গাড়িটাকে ফাঁকি দিয়ে পার্কিং এরিয়ার বেড়ার কাছে চলে এলাম। পেট্টল চুরি করতে বাধ্য হলাম। পকেটে যে কয়টা সেন্ট আছে তা দিয়ে যে পরিমাণ পেট্টল পাওয়া যাবে তা দিয়ে শহর থেকে বাহিরও হওয়া যাবে না। একটা লেন্ড ক্রুজারকে টার্গেট করলাম। পরিস্কার একটা পানির বোতল সংগ্রহ করে হামাগুড়ি দিয়ে পেট্টল ট্যাংকের কাছে চলে এলাম। পেন নাইফ দিয়ে ট্যাংক ফুটো করে অল্প সময়েই কাওয়াসাকির ট্যাংক ভরাট করলাম। ক্রুজারটার রেজিস্টেশন নাম্বারটা মুখস্ত করে শহরের শেষ প্রান্তে চলে এলাম। পকেটের শেষ কয়েকটা সেন্ট দিয়ে কিছু চকলেট বার ছাড়া আর কিছু পেলাম না। চকলেট বারগুলো পকেটে ঢুকানো শেষ করতে পারিনি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমি যে দিকে রওয়ানা হয়েছি সে দিক থেকে রোজ ভ্যালির তিনটি ট্রাক আসছে। দ্রুত  কাওয়াসাকি নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে গেলাম। ওখান থেকে দেখলাম ট্রাকগুলো চলে গেল শহরের অন্য প্রান্তের দিকে। গলি থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম শহরের মাঝামাঝি ট্রাকগুলো রোজ ভ্যালির অন্য গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জন লোক দু’টি গাড়ি থেকে নেমে মুখোমুখি হয়ে কথা বলছে। রওয়ানা দিয়ে দেব ঠিক তখন দেখলাম সেই বেডফোর্ড ভ্যানটাও এসে থেমেছে অন্য গাড়িগুলোর সামনে।

নিজেকে বড় অসহায় মনে হল। পরবর্তী ক্রস রোডে পৌঁছে দক্ষিণে বাঁক নিয়ে টি-টোয়েনটি এইট ধরে ট্রালী থেকে বেরিয়ে এলাম।
শহর থেকে বাহির হওয়ার সাথে সাথেই পিছনে তাকিয়ে দেখলাম গাড়িগুলো আমাকেই অনুসরণ করছে। এই মুহূর্তেই তাদের ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে পড়তে হবে; না হয় কালকের সূর্য আর আমার দেখা হবে না। মেইন রাস্তার একটু ভেতরে একটা পুরুনো ও পরিত্যক্ত গোলাঘরের সন্ধান আমার জানা ছিল। পিছনে গাড়ির হেড লাইটগুলো যখন একটা বাঁকের আড়ালে তখন ঢুকে পড়লাম সেই গোলাঘরে যাওয়ার রাস্তায়। অতঃপর সেই গোলাঘরেই রাতটা কাটিয়ে দিতে বাধ্য হলাম।
সকালে সূর্য উঠলে আমিও বেরিয়ে পড়তে প্রস্তুত হলাম। বিখ্যাত এমারেল্ড পাহাড় কেরীর ঢাল এটা। ঢালের চারপাশে কোথও কেউ নেই। কিছুটা সামনে এক সারি পাহাড় কাউন্টি কেরী ইনল্যান্ড আর বিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের ক্যাসলমেইন হারবারকে আলাদ করেছে। রাতেই একটা ছক এঁকেছি কিভাবে কি করতে হবে। মালোতে আমার এক বন্ধু থাকে। পুলিশে চাকুরী করে। যেভাবে হোক ওখানেই পৌঁছাতে হবে। তার সাহায্যেই আমাকে পশ্চিম আয়ারল্যান্ড থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কাওয়াসাকিতে বসে মেইন রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় রোজ ভ্যালি ফার্মের কোন গাড়ি নেই। ভাগ্যের উপর নির্ভর করে ছুটলাম।

আমি যেখানে আছি তার পশ্চিমে ট্রালী, দক্ষিণে কিলনারী আর বানট্রীম বে, পূবে কর্ক। তাই টি-টোয়ানটি এইট এর সর্ব শেষ শহর ক্যাসল আইল্যান্ডের পূব দিকে পৌঁছে সেকেন্ডারি রোড এল-নাইন ধরে দক্ষিণ দিকে ঘুরে ত্রিশ মাইল দূরের কানটারের দিকে রওয়ানা দিলাম। পরবর্তী শহরই কানটার। আর মালো এখান থেকে প্রায় ষাট মাইল।

অনেকক্ষণ চলার পর পূব দিক দিয়েই টি-থারটিতে গিয়ে উঠলাম। মালো এখান থেকে আরও বারো কি তেরো মাইল। লুটাসের কোন গাড়ি বা লোকজনের দেখা পেলাম না। সাময়িকভাবে হয়তো তাদের ফাঁকি দিতে পেরেছি। কিন্তু  মালোতে পৌঁছানোর আগে নিজেকে কোনভাবেই নিরাপদ মনে করলাম না।
বিকেলের দিকে মালোতে পৌঁছাতে পারলাম। কিন্তু  এর আগে অনেক কষ্ট সইতে হল, অনুভব করতে হল মৃত্যুর হাতছানি। আর পাগলের মতো ছুঁটতে হল শত শত মাইল। আজও নিজের কাছে প্রশ্ন করে এর কোন উত্তর পাই না- কেন আমার জীবনে এমন অবাঞ্চিত ঘটনা ঘটে বারবার!

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ