ব্যথার শ্রাবণ

চট্টগ্রাম থেকে সিলেট আসব। স্টেশনে দাড়ানো আন্তঃনগর পাহাড়িকায় বসে মানুষের ব্যস্ততা দেখছি। এমন সময় পাশের খালি সিটে কারো নড়াচড়ার শব্দ পেলাম। দৃষ্টি ঘুরিয়েই বর্ষাকে দেখলাম আমার পাশে বসে আছে। কল্পনাও করিনি এভাবে তার সাথে দেখা হয়ে যাবে। নিজের অজান্তেই প্রচণ্ড শীতল একটা অনুভূতি শরীরের প্রতিটি নার্ভ স্পর্শ করে গেল। বর্ষার দীর্ঘশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শুনতে পেলাম। পাথর হয়ে গেল সময়।
কয়েক মুহূর্ত পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারলাম। অভিমানের বুনিয়াদি ট্রেনিং পাওয়া মন- দৃষ্টিকে আবারও বাহিরে নিয়ে গেল। ট্রেন ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে হুইসেল বাজিয়ে। মনে হলো পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আমার সমস্ত পৃথিবী। মনের গহিণে অতীত স্মৃতি কেঁদে উঠে তার অস্তিত্ব জানান দিল-
বর্ষা ছিল কৃষ্ণচূড়ার মতো রক্তিম। কলেজ আঙিনায় তার পদচারণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাকে দেখলেই ভুলে যেতাম পৃথিবী, ভুলে যেতাম নিজের অস্তিত্ব। তবুও নিজের পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে স্বপ্নগুলোকে গলা টিপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করতাম। তাই মন থেমে যেত- থামত না দৃষ্টি। র্নিলজ্জের মতো বিধাতার অপরূপ সৃষ্টি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
বর্ষা যখন আমার এ অবস্থা দেখল। তখন একদিন ক্লাস শুরুর আগে সবার সামনে আমার হাতখানেক তফাতে দাড়িয়ে ইচ্ছে মতো গালিগালাজ শুরু করলো। অভিনব পন্থায় আমার দুই চোখে তার তর্জনি ও মধ্যমা দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললো- তোমার চোখ কি দেখেনা- তোমার পরিবারে এমন কেউ নেই যে আমার চাকর হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
অপমানের আঘাতে রক্তাত হই। ব্যথার শ্রাবণ বহে যায় আমার সমস্ত অনুভূতিপূর্ণ অঙ্গে। জানি এটা বর্ষার অহংকার। তাই মাথা নত করে অপরাধী হয়ে বসে থাকি। সারা ক্লাসময় কেউ হাসে, কেউ ব্যঙ্গ করে, কেউ সহানোভূতি দেখায় আর বর্ষা অবিরত বিষবাক্য ছাড়তেই থাকে।
সেই মুহূর্তেই ঐ কলেজের সমাপ্তি দিয়ে দিলাম। অনেক পরিকল্পনা মাথায় খেলে গেল। প্রতিশোধের তীব্র আকাঙ্ক্ষা মনকে বিষাক্ত করে দিতে লাগলো। অনেক কষ্টে নিজেকে থামালাম। বাস্তব সত্যটা মনের আঙিনায় ছবির মতো বিছিয়ে দিয়ে মনকে বুঝালাম। তারপর স্থানান্তরিত হয়ে অনেক দূরে চলে গেলাম। উদাস আর বাউণ্ডুলে হয়ে অন্য একটা কলেজের আঙিনায় জীবনকে অন্যভাবে চালিয়ে দিলাম।
সেই থেকে আমি ব্যথার শ্রাবণে ভেজা এক বাউণ্ডুলে- যে কোনদিন হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয় না, যে কোনদিন যেতে যেতে বৃষ্টির আড়ালে দৃষ্টি হারায় না।
নরম একটা হাতের স্পর্শে বাস্তবে ফিরে এলাম। দেখলাম বর্ষার জলভরা চোখ আর ক্ষমা প্রত্যাশার পরশমাখা হাত। অনুভব করলাম আজও আমার সেই নিষ্পাপ প্রেম মরেনি। আজও ভালোবাসা মরিচীকা হয়নি। বরং ক্ষয়ে ক্ষয়ে আরও পূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু সেই অপমান, সেই যন্ত্রণাও যে অমর হয়ে বসে আছে মনের গহিণ ভালোবাসাকে বন্দি করে দরজায় পাহারাদার সেজে!
বর্ষা ভাষাহীন। শুধু দৃষ্টি চঞ্চল। আমার অস্তিত্ব অভিলাসী হয়। একটুও ঘৃণা অনুভব করিনা তার প্রতি। তাই নিজের ভোজ চোখ আড়াল করতে দূরের চলমান আকাশে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে যাই।
অগোছালোভাবে বর্ষা ক্ষমা চাইল। জানাল- আমি চলে যাওয়ার পর নিজের ভুল বোঝে অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে দিশেহারা হয়ে আমাকে পাগলের মতো খুজে চলছে পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে, অরণ্য, সাগর, চাঁদ, তারা, গ্রহ, নক্ষত্র, অণু, পরমাণুতে। কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এতদিন সে অপেক্ষায় ছিল- একদিন আমার সাথে দেখা হবে আর সে ক্ষমা চাইবে।
বর্ষা যে আমাকে এভাবে খুঁজছে সে কথা আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। তবুও এ মুহূর্তে কিছুই বলা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। আমি ভাষাহীন হয়েই রইলাম।
বর্ষা অনেক আকুতি-মিনতি করলো। বলল- তুমি বিশ্বাস করো আমি আমার সব অহংকার, পরিবারের অর্থের গৌরব সেদিনেই ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়েছি, যেদিন এত অপমানের পরও তুমি নির্বাক থেকে চলে গেলে। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না- পবিত্র পানিতে গা ধুয়ে, জ্যোৎস্নায় বসে রাতের হিমেল হাওয়া অঙ্গে মেখে, পাহাড়ী বাতাসে চুল বেঁধে, বনফুল মাথায় গুজে তোমার আরাধনায় অনেক কেঁদেছি। শুধু একবার তোমার মুখোমুখি হওয়ার প্রতিক্ষায় বসন্ত আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আজ আমার সেই আরাধনা পূর্ণতা পেল। শুধু একবার বলো- আমাকে ক্ষমা করেছ।
আমি তার হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম ক্ষমার সুন্দর রূপ। সে আমার পা ছুঁয়ে দিতে চাইল। আমি তাকে এ মুহূর্তে আমরা কোথায় আছি সেটা মনে করিয়ে দিলাম।
প্রায় নয় ঘন্টার যাত্রায় নয় মিনিট সময়ও বর্ষা আমাকে রেহাই দিল না। আমি তাকে স্পষ্ট বলে দিলাম- আমি বাউণ্ডুলে সেই থেকে, যেদিন তুমি আমাকে বাউণ্ডুলে বানালে। আমি প্রেমহীন পাষাণ সেই থেকে, যেদিন তোমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখার অপরাধে আমাকে বস্ত্রহীন করে জনসম্মুখে দাঁড় করালে। তবুও আমি আজও বেচে আছি ঠিক আমার মতো করে এক পৃথিবী সাজিয়ে। হয়তো আরও অনেককাল বেঁচে থাকবো নয়তো মুহূর্তের নোটিশে আকাশের তারা হয়ে যাব। তাই আমার শূণ্য হৃদয়ে তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নাই। বালুচরে ঘর বাঁধার চেয়ে ঠিকানাহীন থাকাই ভালো।
বর্ষা কেঁদে কেঁদে অস্থির। অন্যান্য যাত্রীরা আঁড় চোখে তাকিয়ে আছে। আমি আবারও তাকে আমাদের অবস্থান মনে করিয়ে দিলাম। সে আমলে নিল না বরং আরও পাগল হয়ে গেল। বললো- মানুষ ভুল করে প্রমাণ করে সে মানুষ। আমিও ভুল করে প্রমাণ করলাম আমিও মানুষ। আবার মানুষ ক্ষমা করে প্রমাণ করে সে মানুষ। তুমিও আমাকে ক্ষমা করে প্রমাণ করলে তুমিও মানুষ। আর এটাতো মিথ্যে নয়- কোন একক্ষণে আমার এলোমেলো ভুল প্রহরে যোগ্য না হওয়ার পরও তোমার মতো এক মহামানবের মন ছুঁয়ে দিয়েছিলাম। নিজের ভুলে হয়েছিলাম অপরাধী। কিন্তু তোমার মহত্ত্বে আজ আমি মুক্ত, তবে দিশেহারা। অনেকটা সময় যদিও কালের অতলে হারিয়ে গেছে তবুও এ মুহূর্তে আমি তোমাকে দৃঢ়চিত্তে সেই প্রতিজ্ঞা দিতে পারি- আমি তোমাকে সুখী করতে পারবো।
আমি মুছকি হাসলাম বেরসিকের মতো। বললাম- আমার সীমানা অনেক আগেই সীমাহীন হয়ে গেছে আকাশের মতো। লুট হয়ে গেছে সঞ্চিত সম্পদ। ওখানে আর কিছুই নেই। আমি আমার মতো থাকতে চাই- একা, নিঃসঙ্গ এক বাউণ্ডুলে বেশে।
বিকালের মিষ্টি রোদ যখন সমস্ত সিলেট শহরে খেলা করছে তখন বর্ষার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার বাঁকে হারাতে চাইলাম। সে পিছু পিছু এসে বলে গেল- তোমার ক্ষমার দৃষ্টিতে আমি বৃষ্টি হয়ে মুক্ত হয়ে গেলাম; তবুও মন কাঁদবে, কাঁদবে প্রতি অঙ্গ, কাদবে আমার পৃথিবী, তোমাকে ধরে রাখতে পারিনি বলে… তোমাকে ছুঁয়ে আমার অষ্টপ্রহর নষ্ট করতে পারিনি বলে।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
