প্রতিদান
মাঝরাতে নাক ডাকার বিশ্রী শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া কোন সুখকর ঘটনা নয়।আকাশ পথে প্রায় আট ঘন্টার দীর্ঘ ভ্রমণ আর যানজটের স্বর্গরাজ্য ঢাকার রাস্তায় অসহনীয় যানজট পাড় হয়ে হোটেলে এসে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয়ার মুহূর্তকাল পর ঘুম ভেঙ্গে গেলে কার না বিরক্তি লাগে?অবশ্য বিরক্তির রেশ কাটতে বেশি সময় নেয় না তাহুরার।অলিভিয়া প্রিসলির নিষ্পাপ মুখখানা যে কারো রাগ পানি দেয়ার জন্য যথেষ্ট।বেশ বাড়াবাড়ি রকম সুন্দর চেহারার এই মেয়েটাকে দেখে কে বলবে যে এই বিশ্রী রকম নাক ডাকার জন্য দায়ী সে।সুন্দর চেহারার চেয়েও সুন্দর মন দিয়ে স্রষ্টা এই মেয়েটিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।বরাবরই মেয়েটির আচরণের প্রেমে ডুবে থাকে তাহুরা।ইচ্ছে করলে আলতো ধাক্কায় মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে দিতে পারে সে।অলিভিয়াও আচমকা ঘুম ভেঙ্গে হাসিমুখে রাত কাটিয়ে দিবে গল্পগুজবে।কিন্তু মাঝরাতে ঘুমে ডুবে থাকা মেয়েটির স্বপ্নরাজ্যে হানা দিতে ইচ্ছে হল না তাহুরার।বরং নিঃশব্দে বিছানা ছাড়ল সে।ঢিলেঢালা হাতাকাটা গেঞ্জি আর থ্রি কোয়াটার পড়েই ব্যালকনিতে পা বাড়াল সে।যদিও কানাডা আর বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ব্যাপক পার্থক্য আছে তবুও অস্বস্তি হলো না তার,এত রাতে নিশ্চয়ই চারতলার ব্যালকনিতে উঁকি মেরে তার যৌবন দেখার মত কোন পুরুষ জেগে নেই।এই মাঝ রাতে এককাপ গরম কফি সঙ্গী হলে মন্দ হত না। ইন্টারকমে বেল বাজালেই এককাপ ধোঁয়া ওঠা কফি চলে আসবে,কিন্তু ইচ্ছে হলো না কেন জানি।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ ছেড়ে ব্যালকনিতে পা রাখা মানুষটির স্বাভাবিকভাবেই খানিকটা গরম লাগার কথা।অথচ দখিণা হাওয়া আলতো ছুঁয়ে গেল তার আধ খোলা শরীর।দেহের সাথে দোলা দিয়ে উঠল মন।ভরা পূর্ণিমার স্নিগ্ধ আলো রাঙিয়ে দিল তাহুরার অচেনা জগৎ।এভাবে প্রকৃতির মাঝে ডুবে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ায় ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার অলিভিয়া।শরতের কোমল এই রাত স্মৃতিকাতর করে দিচ্ছে তাহুরাকে।অথচ প্রায় একুশ বছর পর ফেরা এই শহরে কোমল কোন স্মৃতি নেই তার,যা আছে তা হল চরম দুঃসহ,অসহনীয় আর নিদারুণ পাশবিকতায় ভরপুর কিছু ভয়ংকর স্মৃতি।
তার বয়স যখন চৌদ্দ থেকে সতের এই তিন বছরের স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে তাহুরার।চৌদ্দ বছর বয়সের আগে তেমন প্রণিধানযোগ্য স্মৃতি ছিল না তার।নাইট গার্ডের চাকুরী করা বাবা জুনায়েদ আর গার্মেন্টস কর্মী মা জোবেদার সংসারে তেমন অভাব অনটনও ছিল না।বেশ ভালোই চলছিল তাদের তিন জনের সংসার।মাথাভর্তি চুলের দুই বেণী আর ঠোঁটে লাল রঙয়ের গাঢ় লিপিষ্টিকের মাখামাখি সাজে দলবেঁধে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোই কেবল সুখস্মৃতি হিসেবে মনস্পটে ভেসে ওঠে তার।আহা!প্রতি ঈদে নতুন জামা কেনার বায়না ধরা হয় না কত বছর!এমন মিষ্টি একটা সংসারের মায়া ত্যাগ করে তাহুরার বাবা যেদিন পাশের বাসার এক প্রবাসীর সদ্য বিবাহিতা তরুণী স্ত্রীকে নিয়ে এলাকা ছাড়ল সেদিন থেকেই ভাগ্যদেবী তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।রাতভর ডিউটি করা বাবা দিনভর স্ত্রীহীনতায় ভুগেই হয়তো পাশের বাসায় সুখ খুঁজে পেয়েছিল।বাবার এহেন কাণ্ডে প্রচন্ড আঘাতপ্রাপ্ত তাহুরা নীড় খুঁজে পেত মায়ের কোলে।সমবয়সী ছেলেমেয়েদের টিপ্পনী শুনেও মায়ের মলিন মুখে আশ্বাসের হাসি প্রেরণা যোগাত তাকে।লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হয়ে মায়ের মুখে প্রশান্তির স্নিগ্ধ হাসি ফোঁটাতে চেয়েছিল কিশোরী এই মেয়েটি।কিন্তু আরও একটি অসম প্রেম নামক ঝড় তার সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিতে এক বছরের বেশিও সময় নেয় নি।স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ার বছর খানেক পরেই নিজের চেয়ে প্রায় এগারো বছরের ছোট বাসের এক হেল্পারকে বিয়ে করে তাহুরার মা।বাবা মায়ের একের পর এক স্বার্থপর কর্মকান্ডে ভেঙ্গে পড়ে সে।তবুও নিয়তিকে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না তার।নতুন বিয়ের পর নিজের মেয়েকে কাছেই রেখেছিল তাহুরার মা।নতুন বাবাও তাকে বেশ ভালোই আদর করত।কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেই আদর তার জন্য অস্বস্তিকর আদরে পরিণত হয়।মায়ের অনুপস্থিতিতে নতুন বাবার বিব্রতকর আদরের কথা লজ্জ্বায় মাকে বলার সাহসও পেত না অসহায় এই কিশোরী।কিন্তু বাড়ন্ত শরীরের কিশোরী মেয়ের প্রতি তার নতুন স্বামীর কুবাসনা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না তাহুরার মায়ের।অতঃপর নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ রক্ষা ও নিজের দাম্পত্য জীবন সুরক্ষিত রাখতেই মেয়েকে তার মামার বাসায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।কিন্তু তাহুরার নতুন বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তাদের সাথে না থাকলে তাহুরার জন্য কোন আলাদা খরচ বহন করতে পারবে না সে,এমনকি তাহুরার মাও যেন তাকে গোপনে কোন খরচ না দেয় সে জন্য বেশ করে শাসিয়ে দেন তিনি।ফলস্বরূপ দুই বছর আগে বেপরোয়া চালকের সেচ্ছাচারিতায় সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পা হারানো পঙ্গু মামার সংসারে এক প্রকার বোঝা হিসেবেই আগমন ঘটে তাহুরার।মামার সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন এখন মামির কয়েক বাসায় ছুটা বুয়ার কাজের মাইনে।পাঁচ বছর বয়সী মামাতো বোনের একমাত্র কাজ হলো তার মায়ের লেজ ধরে ঘুরে বেড়ানো।
তাহুরার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আফসোসের অন্ত ছিল না তার মামা আর মামির কিন্তু তাদের সংসারের দূরাবস্তার কথা জানান দিতেও ভুলে না তারা।এক কামরার বাসায় মামাতো বোনকে নিয়ে ফ্লোরে ঘুমাতো তাহুরা আর মামা মামি ঘুমতো বাসার একমাত্র আসবাব পুরোনো দিনের শ্রীহীন একটা খাটে।গভীর রাতে খাট নড়ার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেত তার,মামা মামির অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করা নিঃশ্বাসের শব্দ বাকিরাত ঘুমাতে দিত না যৌবনের পথে পা বাড়ানো এই কিশোরীকে।সপ্তাহ খানেক বাদেই অস্বস্তিকর এই বাসস্থান পরিবর্তন হয় তার।খুব সংকোচের সাথেই তাহুরার মামি তার জন্য ঠিক করা একটি কাজের খবর দেয় তাকে।ভাগ্য খুব ভালো বলেই নাকি তাহুরার জন্য এমন ধনী একটি পরিবারে স্থায়ী একটি কাজ পাওয়া গেছে,কাজও তেমন বেশি কিছু না বাসা বাড়ি ঝাড়ু দেয়া আর থালা বাসন ধোয়া। রান্নাবারি আর জামাকাপড় কাচার জন্য তাদের আলাদা ছুটা বুয়া আছে।তাহুরার ইচ্ছে থাকলে নাকি পড়াশোনার সুযোগ দিতেও রাজি তারা।থাকা খাওয়ার কথা কি আর বলতে হয়?এমন ধনী পরিবারে থাকা খাওয়ার অভাব হবে না তার,ছয় তলা বাড়ির মালিকের পরিবারে রাজরানীর হালেই থাকবে তাহুরা।মনে অনেক শঙ্কা,ভয় থাকা সত্বেও বিকল্প না থাকায় রাজরানীর নামে চাকরানির জীবন বেছে নিতে হল স্বপ্নবিলাসি এক কিশোরীকে।
মালিবাগ পদ্মা হলের বিপরীত পাশে ছয় তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার পুরো ইউনিট জুড়ে থাকত তাহুরার মনিব পরিবার।পঞ্চাশোর্ধ গৃহকর্তা সফি উদ্দিন,তার স্ত্রী অনামিকা উদ্দিন,দুই ছেলে রায়হান ও তানিম আর বড় ছেলের স্ত্রী নীলিমা রায়হান এই নিয়ে ছিল তাদের পরিবার।বড় ছেলে ও তার স্ত্রী একই সাথে প্রাইভেট একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করত।ছোট ছেলে মাত্রই একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।কর্মস্থলে যোগ দিয়েই তাহুরা বুঝতে পারল মামির কথার সাথে অনেকাংশেই মিল নেই এই বাড়ির কাজের।রান্নাবারি থেকে শুরু করে সকলের কাপড় কাচা ও গৃহস্থালীর সব কাজ তাকেই করতে হয়।কয়েক দিনের মাথায় বাড়তি পাওনা হিসেবে ছোট খাটো ভুলের জন্য অকথ্য ভাষায় গালাগালির পাশাপাশি হালকা পাতলা শারীরিক নির্যাতনও শুরু হলো তাহুরার জীবনে।দুইমাসের মাথায় মনিবের বাসায় না জানিয়ে মামা আর মায়ের বাসায় গিয়েছিল সে।কিন্তু দুই পরিবারই সেখান থেকে বাসা ছেড়ে কোথায় বাসা নিয়েছে তা কেউ বলতে পারল না।অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে আপাত দৃষ্টিতে মাথার উপর ছাদ হিসেবে থাকা পারিবারিক নির্যাতন কেন্দ্রেই ফিরে আসতে হলো তাকে।সেদিন ব্যাপক মারধরের শিকার হয়েছিল তাহুরা। দিনশেষে নগ্ন হয়ে বাথরুমের আয়নায় নিজের উর্ধাঙ্গের কোথাও দাগহীন জায়গা খুঁজে পায় নি সে।এরপর থেকে বাসা থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ হয় তার।দারোয়ানকেও জানিয়ে দেয়া হয় এই সিদ্ধান্ত।এখনকার দিনের মত মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা ছিল বলে কার্যত গৃহবন্দী হয়ে পড়ে তাহুরা।অবশ্য বেদনা জানানোর মত কেউ বা যাওয়ার মত কোন জায়গা ছিল না বলেই বলেই দুমুঠো ভাত আর রান্নাঘরের মেঝেতে গুটিসুটি হয়ে ঘুমানোর লোভে লঘু পাপে গুরুদণ্ড সইতে লাগলো মেয়েটি।
এরপর আর ভাবতে পারছিল না তাহুরা,গা কাটা দিয়ে উঠছিল তাছাড়া খানিকটা হলেও ঘুমাতে হবে তাকে,সকালে উঠে অনেক কাজ করতে হবে।অনেকগুলো এসাইনমেন্ট হাতে নিয়ে পাঁচ দিনের জন্য ঢাকায় এসেছে তারা,তারা বলতে তাহুরা আর অলিভিয়া।অলিভিয়ার ছন্দময় নাক ডাকার শব্দ তাহুরাকে আজ ঘুমাতে বারণ করছে তা সে রুমে ঢুকেই বুঝতে পেরেছিল।অগত্যা ব্যালকনিতে বসে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া মাঝরাতের তুলনায় খানিকটা মলিন আলোর চাঁদের সাথে গল্প করাই ভালো।
আজ থেকে প্রায় একুশ বছর আগের রাতটিও ছিল শরতের এমন এক পূর্নিমা রাত।রান্নাঘরের জানালা বেয়ে আশা চাঁদের আলো উছলে পড়ছিল তাহুরার গায়ে।মুগ্ধ হয়ে চাঁদের আলো গায়ে মাখছিল সব হারিয়ে নিঃস্ব অথচ উচ্ছল এই কিশোরী।বাসায় মানুষজন কম থাকায় কাজকর্মও কম তাই অনেকটা আগেই শুয়ে পড়েছে তাহুরা।গৃহকর্তা আর গৃহকর্ত্রী দুজনেই গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করতে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেছেন আর তাদের বড় ছেলে আর তার স্ত্রী বার্ষিক ছুটি কাটাতে গেছে থাইল্যান্ড।সেমিস্টার পরীক্ষা থাকায় ছোট ছেলেই কেবল বাসায় রয়ে গেছে।শীতের আগমনী বার্তা জানাতে শরতের মাঝ সময়টাতেই খানিকটা শীতশীত ভাব চলে এসেছে।পাতলা একটি কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে ছিল তাহুরা।চাঁদের আলো ভালোভাবে গায়ে মাখতে কাঁথা টা পাশে সরিয়ে রাখে সে।অজান্তেই নিজের শরীরের দিকে নজর পড়লে খানিকটা লজ্জ্বায় পড়ে যায় তাহুরা। শরীরটা খুব দ্রুতই কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিচ্ছে।এত নির্যাতনের পরও এত সুন্দর একটা শারীরিক গঠনের জন্য স্রষ্টার কাছে শোকরিয়া জানায় সে।গৃহকর্তার ছোট ছেলে তানিমের ডাকে আপন ভাবনায় ছেদ পড়ে তাহুরার।এক কাপ চা বানিয়ে তার ঘরে দিয়ে আসতে বলল তানিম।একটু অবাক হলো তাহুরা চায়ের অত নেশা নেই তানিমের তবে আজ কেন?কে জানে রাত জেগে পড়বে বলে হয়তো চা খাবে।ঘুমের আকুলতায় কাতর শরীটাকে নিতান্তই অনিচ্ছায় বিছানা ছাড়াতে হলো।চা বানিয়ে তানিমের ঘরে যাওয়ার পর তানিম একটা আধ খাওয়া কোকের বোতল হাতে তুলে দিল তাহুরাকে,
-নে এটা খা।
তাহুরা বোতল টা নিল।তানিম প্রায়ই তাহুরাকে তার আধ খাওয়া কোকের বোতল খেতে দেয়।এটা নতুন কিছু না।এভাবে খেতে খেতে কোক তাহুরার প্রিয় পানীয়তে পরিণত হয়েছে।কোকের বোতল হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিল সে।তানিম আটকাল তাকে,
-এখানেই খা,তাহুরা।আমার চা খাওয়া শেষ হলে কাপটাও নিয়ে যাস।
বলেই চায়ে চুমুক দিল তানিম।তাহুরাও চুমুক দিল কোকের বোতলে।পুরো পানীয়টা শেষ করতেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল তার।টলতে শুরু করল তাহুরা।
-কিরে,খারাপ লাগছে?
বলেই দুই হাতের কনুইতে ধরে তাহুরাকে নিজের খাটে বসিয়ে দিল তানিম।তানিমের মত বাড়িওয়ালার ছেলের তার মত কাজের মেয়ের এমন আন্তরকিতার দরুন তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল তাহুরার মন।
-মাথা ডা ঝিমঝিম করতাছে ভাইজান,কাপ ডা আমি পড়ে নিমু নে।আমি যাই।
-না,তুই এখানেই শুয়ে পড়।
বলেই আপত্তিকরভাবে ছেঁড়াফাঁড়া ময়লা জামার আড়ালে ঢাকা নোংরা অথচ নব্য যুবতি তাহুরার শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে ধনীর দুলাল তানিম।
-কি করতাছেন,ভাইজান?
-কিছু নারে তাহুরা,আয় তোকে একটু আদর করি।
এক ঝটকায় খাট থেকে উঠে যেতে চায় তাহুরা।পারে না,কোকের মধ্যে মেশানো ঘুমের ঔষধ নিস্তেজ করে দেয় তাকে,শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় সে।আর সদ্য যৌবনে পা দেয়া বড়লোকের বখে যাওয়া সন্তান তানিম পশুর মত আদর করে অসহায় একটি মেয়েকে।তাহুরা এই আদরের তীব্রতায় জ্ঞান হারায় দ্রুতই। সকালে ঘুম থেকে উঠে আগের রাতে তার সাথে ঘটে যাওয়া পাশবিক ঘটনার যন্ত্রণা বুজতে পারে তাহুরা। নিম্নাঙ্গের যন্ত্রণায় বিছানা ছাড়তে পারছিল না সে।তবুও কষ্ট করে উঠে নিজের রক্তে ভেজা বিছানার চাদর বালতিতে ভেজায় তাহুরা।ভেতর থেকে ঘরের মূল দরজা টেনে বুজতে পারে তানিম বাহির থেকে তালা দিয়ে গেছে তাকে।সপ্তাহখানেক পর তানিমের বাবা মা আসার আগ পর্যন্ত প্রতি রাতেই তার উপর চলত অমানুষিক নির্যাতন।কাউকে কিছু বললে এসিডে মুখ ঝলসে দেয়ার হুমকি তানিম দিয়ে রেখেছে একাধিকবার।আর তানিমের মাকে এসব বললে উল্টো তার উপরই যে নির্যাতন হবে তা তাহুরাও জানত।কিন্তু নিজের ছেলের বর্বরতার স্বীকার তাহুরার হাঁটাচলা দেখেই কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিল তানিমের মা।তিনি অবশ্য নিজের শরীর দেখিয়ে তার ছেলের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করার দায়ে নতুন করে নির্যাতন শুরু করে তাহুরার উপর।আর চুরির দায়ে পুলিশে দেয়ার ভয় দেখচ্ছিল বারবার।এদিকে উপর্যুপরি নির্যাতন আর চিকিৎসাহীনতায় সত্যিই দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাহুরা।তাই বাধ্য হয়ে এক ঘুমদুপুরে,সবাই যখন ঘুমে তখন দারোয়ান কুদ্দুস মিয়ার হাতে পায়ে ধরে তাকে নিয়েই হাসপাতালে যায় তাহুরা।হাসপাতালের ডাক্তারকে সব কিছু খুলে বলে সে।সব শুনে মেডিকেল টেস্টের জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশকে খবর দেয় হাসপাতাল কতৃপক্ষ।পুলিশ তাহুরার জবানবন্দি ও মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে তানিমের মা কে,পুলিশের চোখে ধূলা দিয়ে পালিয়ে যায় তানিম।উপযুক্ত অভিভাবকের অভাবে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয় তাহুরাকে। পরদিন হাতকড়া পড়া অবস্থায় তানিমের মায়ের ছবি দেশের প্রায় সবক’টি দৈনিকে প্রকাশিত হয় আর ইনসেটে তাহুরা ও তানিমের ছবি।ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টার এ প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তাহুরাকে অফিসিয়ালি দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন ঢাকায় অবস্থিত কানাডার হাইকমিশনে কর্মরত নিঃসন্তান বিধবা মিসেস প্রিসুলিয়া লরেন্স।
তারপর থেকে এদেশের নির্যাতিতা তাজরিন তাহুরা কানাডায় তাহুরা লরেন্স নামেই পরিচিত।সেদেশেই পড়াশোনা শেষ করে একটি সামাজিক কল্যাণমূলক স্বেচ্ছাসেবী সংঘটন কেয়ার ইন্টারন্যাশনালে কাজ করছে সে।বাংলাদেশে থাকা অতীতের কারো সম্পর্কে আর কোন তথ্য নেই তার কাছে।কিন্তু মহাকাল কারো প্রাপ্য বুজিয়ে দেয়ার আগে কাউকে ভুলে যায় না।
নতুন বিয়ের প্রায় বছর পাঁচেক পরেই তরুন স্বামীর সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে জোবেদা বেগমের। এর বছর খানেক পরে ঘটে বিচ্ছেদ।তারপরও বছর কয়েক গার্মেন্টেসের চাকুরিটা চালিয়ে যেতে পারলেও রোগব্যাধি আর বেশিদূর এগুতে দেয় নি তাকে।জীবনের সঞ্চিত সকল অর্থ ডাক্তারের পেছনে ব্যয় করে,শেষ জীবনে নিজেকে সপে দিতে হয় এক বৃদ্ধাশ্রমে।
অন্যদিকে গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় তিন বছর জেলে কাটিয়ে বাড়ি ফেরা অনামিকা উদ্দিন তার হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পায় না কিছুতেই।তার পুত্রবধূ নীলিমা রায়হান সংসারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে নিজের হাতে।স্বামী সফি উদ্দিনের মৃত্যুর পর সংসারে আরো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে অনামিকা।নিজের ঘটনো সেই অপকর্মের পর তানিম আর বাড়ি ফেরে নি।কোথায় আছে জানেও না কেউ।দুইবছর আগে পান্থপথে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত জঙ্গির ছবি পত্রিকায় দেখে তানিমকে দেখে চিনেছিল তার মা।কিন্তু সামাজিক কারন ও বড় ছেলে আর পুত্রবধূর আপত্তিতে ছেলের লাশ দেখতে বা নিজেরা এনে মাটিও দিতে পারে নি অনামিকা।তারপর থেকে খানিকটা অস্বাভাবিক আচরন করতেন তিনি।যার সূত্র ধরে স্বামীর সাথে আলোচনা করে শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়ার মত পবিত্র দায়িত্ব পালন করে নীলিমা।
দারিদ্রতা বিমোচনে বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ পর্যবেক্ষনে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি হয়ে এদেশে এসেছে তাহুরা ও অলিভিয়া।সরকারি কাজগুলো সেরে দুটো বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শনের পরিকল্পনা আছে তাদের।চারদিনের ব্যস্ত শিডিউলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকারী কার্যক্রম পর্যবেক্ষন শেষে অলিভিয়াকে এদেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোর তথ্য সংগ্রহ করতে বলে সন্ধ্যাকালীন ঘুমে গেল তাহুরা। অলিভিয়ার নাক ডাকার অত্যাচারে কাটানো নির্ঘুম রাতের খানিকটা দাওয়াই এই সন্ধ্যাঘুম।অলিভিয়া বৃদ্ধাশ্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে করতে একপ্রস্থ ঘুম দিয়ে উঠল তাহুরা।রাতের খাবার শেষে প্রতিবেদন নিয়ে বসল সে।
খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে প্রাচীন চীনের শান রাজবংশ পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য সর্বপ্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।সেই বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশ ও বিনোদনের সব ব্যবস্থাই ছিল।কালের পরিক্রমায় কম বেশি সব দেশেই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে।বাংলাদেশে একটি সরকারি ও বেশ কয়েকটি বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে।এর মধ্যে দুটো বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শনের জন্য বাছাই করল তাহুরা,যার একটির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আছে আর অপরটি দেশি বিদেশি কারো অনুদান গ্রহণ করে না।
যেদিন রাত এগারোটায় তাহুরাদের ফ্লাইট সেদিন খুব সকালেই উত্তরার মৈনারটেক এলাকায় অবস্থিত আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছল তারা।সেখানকার কর্মকর্তাদের অসহযোগিতামূলক মনোভাব,বয়স্কদের সাথে একান্তে কথা বলতে না দেয়া আর যাদের সাথে কথা বলতে দেয়া হয়েছে তাদের শেখানো বুলি আওড়ানো এ সবই অনিয়মের স্পষ্ট প্রমাণ।যদিও বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক সেলিনা শেলী অনিয়মের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আপন নিবাস ছেড়ে তারা যখন গাজীপুরের কুড়িবাড়ি ইউনিয়নের বিশিয়া বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছান ততক্ষণে সকালের স্নিগ্ধ রোদ তার চরিত্র পাল্টাতে শুরু করল।২৭ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত বিশাল এই প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অত্যন্ত মনোরোম।সবুজে ঘেরা,পাখির কলরবে ভরপুর,প্রকৃতির সান্নিধ্যে গড়ে ওঠা এই আশ্রমে অসহায় মানুষগুলোর সব ধরণের সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান।গিভেন্সী গ্রুপের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এই চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানটি কারো ব্যাক্তিগত,প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রীয় অনুদান গ্রহণ করে না।আশ্রমে ঠাই পাওয়া প্রবীণ নিবাসীদের সাথে কথা বলেও কথার সত্যতা পাওয়া গেল,পাওয়া গেলো না কোন অনুযোগ,অভিযোগ।জীবনের সব হারিয়ে নিঃস্ব এই মানুষগুলোর মাঝে আক্ষেপের ছাপ পাওয়া যায় না কোথাও,নিজেদের মধ্যে পারষ্পরিক সম্পর্কও বেশ মজবুত তাদের।আশ্রমের সামনের সবুজ লনের এক কোনে বসে থাকা দুজন বৃদ্ধাকে দেখে এগিয়ে যায় তাহুরা।সবুজ ঘাসে বসা জোবেদা বেগমের পেছনে চেয়ারে বসে তার মাথায় উঁকুন খুঁজছিল অনামিকা উদ্দিন।মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া কাঁচাপাকা চুলের অনামিকার আভিজাত্য চাপা পড়েছে বয়সের আড়ালে,যৌবন হারিয়ে বার্ধ্যকে নাম লেখানো জোবেদার চেহারায় অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট।একুশ বছর পর নিজের অতীতের দুই স্মৃতি চিনতে খুব কষ্ট হয় না তাহুরার,নিঃশব্দে সামনে এসে দাঁড়াল তাদের।বিদেশি ম্যামের আচমকা আগমনে খানিকটা অপ্রস্তুত জোবেদা ও অনামিকা প্রায় এক সাথেই দাঁড়িয়ে পড়ে।মোটা কাঁচের আড়াল থেকে বয়স্ক দুই জোড়া চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল তাহুরাকে।এত চেনা লাগছে কেন মেয়েটিকে?কোথাও কি দেখেছে তাকে?
লেখকঃ
বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

