গল্পটা অসমাপ্ত
রাত সাড়ে নয়টার কিছুটা পরেই দক্ষিণ এথেন্সের এলিনিকন এয়ারপোর্ট এর পূর্ব টার্মিনালের কাছাকাছি ল্যান্ড করলো প্লেনটা। আরোহীদের সাথে নিজেও নেমে এলাম। পেশাগত কারণেই এখানে আমার আসা।
টার্মিনাল ভবনের বাহিরে প্রচুর লোকজন। গেটটা পেরুতেই নির্ধারিত এজেন্ট আমাকে সাবজেক্ট দেখিয়ে দিয়ে দ্রুত হেটে গেল ফুটপাত ধরে। আমিও পিছু নিলাম এজেন্টের দেখিয়ে দেওয়া সেই পঞ্চাশ ছোঁয়া বাঙালি ভদ্রলোকের।
অবৈধ না হলেও আমার কাজটা ছিল বেশ বিপদজনক। তাই সর্বদাই আমাকে সতর্ক থাকতে হতো। কিন্তু সেদিন ভুল করে বসলাম। ভুল মানুষের পিছু ধরে ভুল জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম। ভদ্রলোক আসলে আমার সেই সাবজেক্ট নয়।
তিনি তার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে এই লুকোচুরি করে যাচ্ছেন। এ গলি ও গলি হয়ে সব শেষে একটা নির্জন জায়গায় আসলে- দেখলাম ভদ্রলোকের অপেক্ষায় বসে আছেন তার ভালোবাসার মানুষ। লম্বা চুলের উজ্জ্বল শ্যামলা হরিণী চোখের বাঙালি মহিলাকে দেখেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। উনাকে মোটামুটি চিনতাম এমনকি উনার স্বামীর সাথেও আমার কথা হয়েছিল একদিন। এ ক্ষেত্রে আমার কিছুই করার নেই। ফিরে এলাম নিজ কক্ষপথে সঠিক মানুষের সন্ধানে।
এই ঘটনার দুই মাস পর- তখন ছুটি কাটাচ্ছিলাম ম্যানড্রাকি স্ট্রীটে। এমন সময় আবার দেখা হলো পড়ন্ত বয়সী সেই বাঙালি জুটির সাথে। তবে কিছুটা অস্বভাবিক দর্শন। কয়েকজন নেশাখোর যুবকের খপ্পরে পড়েছিল দু’জন। বিশ্রী কিছু হয় হয় এমন সময় নিজেকে আবিষ্কার করলাম ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে। খুব সম্ভবত স্বদেশী বলেই এমনটা হলো। উদ্ধার করে নিয়ে আসলাম আমার গাড়িতে। লিফট দিতে চাইলাম। বিভ্রত ভাবে প্রত্যাখান করলেও সন্ধ্যার আঁধারে ওখান থেকে দ্রুত সরে যাওয়াটা তাদের খুব জরুরী ছিল বলে হয়তো প্রত্যাখান করার পরও গাড়িতে উঠে বসলেন।
সেই পরিচয়। তারপর বেশ কয়েকবার দেখা। আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে অসঙ্গতিগুলো একে একে ধরা পড়লো। প্রশ্ন করে বসলাম। ভদ্রমহিলা জানতেন- আমি উনার স্বামীকে চিনি। হয়তোবা এজন্যই তারা কথা দিলেন আগামী শনিবার আমায় শুনাবে তাদের দুই যুগের দুই ভালোবাসার করুণ গল্প।
পরের শনিবার দু্’জনই এলো নির্ধারিত স্থানে- ম্যানড্রাকিতে। আমাকে নিয়ে ঢাল বেয়ে প্লাটিয়া সিমিস-এ নেমে এলো ওরা। অস্ত্রাগারটাকে পাশ কাটালো। ভ্রমণ বিলাসীরা ঘুর ঘুর করছে চারপাশে, চারিদিকে চাপাকন্ঠের বিস্ময়ধ্বনি, যেন জোরে কথা বললেই যীশুর তিনশো বছর আগের তৈরি মন্দিরের উঠনে প্রাচীন দেবতাদের ঘুম ভেঙে যাবে। ডানদিকে সাইমি গেট, ভেতরে তাকালে বাণিজ্যিক বন্দরের অনেকটা দেখা যায়, সে যুগে নাম ছিলো এমবোরিয়ো, চারদিক থেকে দুর্গপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। পাইরিয়াস থেকে আসা বেশিরভাগ জাহাজ আর নৌকা ওখানেই নোঙর ফেলতো। নীল একটা লাইনার রয়েছে এই মুহূর্তে। ফ্রিডম গেট পেরিয়ে আকটি বুবুলা-র দিকে হাটা দিল। ম্যানড্রাকি হারবারের সাগরমুখী দিকটাকে রক্ষাকারী প্রকান্ড বাঁধে উঠে এলো ওরা। সামনে কিছুই নেই, আছে শুধু তিনটে প্রাচীন উইণ্ডমিল আর ফোর্ট সেইন্ট নিকোলাস। ওখানেই আমাকে বসালো তারা- দু’জন মিলে শুনালো এক অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প।
সেই ১৯৯১ সালে যখন পরী ক্লাস টেনে পড়ে তখনই পরীদের বাড়িতে বেড়াতে আসা দূর সম্পর্কের আত্মীয় আকাশের সাথে তার দেখা হয়। দু’জনই অনুভব করে কিছু একটা যেন বাসা বাঁধতে চাচ্ছে মনের গহীনে। তবুও মুখে বলার সাহস হয়নি কারও। পরী তার ঘনিষ্ট দুই বান্ধবীর সাথে বিষয়টা শেয়ার করে। বান্ধবীরা তাকে এসব ছেড়ে পড়ালেখায় মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর বান্ধবীরা জানতে পারে- ভেতরে ভেতরে পরী আর আকাশের সম্পর্কটা অনেকটা এগিয়ে গেছে। আকাশ যখন দ্বিতীয়বার পরীদের বাড়ি আসে তখন সেই পরীর পড়ার টেবিলে লাল গোলাপ আর “ভালোবাসার প্রথম গোলাপ তোমার জন্য” লেখা একটা চিরকুট রাখে।
যদিও বুকে কাপন ধরা অনুভূতির জন্ম হয়ে গেছে তবুও ভয়ে আড়ষ্ট পরী তখনো চুপচাপ। তবে কিছু দিন পর পরী তার নানা বাড়ি গেলে আকাশ সন্ধান পায়। বেশি দূর ছিল না আকাশের বাড়ি। আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় আকাশের প্রায়ই আসা যাওয়া ছিল ও বাড়িতে। আর ওখানেই আকাশ পরীকে জয় করে। শুরু হয় অসমাপ্ত গল্পের পরবর্তী অধ্যায়ের পাগল করা ভালোবাসা।
পরী যখন বাড়ি ফিরে এলো। তখন আকাশ মোটর বাইকে প্রায় একশত বিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পরীর সাথে দেখা করতে আসতো। ঘনিষ্ট বান্ধবী দু’জন তাদের সঙ্গ দিত। আবার পরী যখন নানা বাড়ি যেত তখন তার এক খালা তাদের সাহয্য করতেন। উনার সাহায্যেই তারা শহরময় রিক্সায় ঘুরে বেড়াতো।
তারপর হঠাৎ করেই আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। পরীর সব স্মৃতি ফেরত দেয় সে। পরীর কৈফিয়ত তলবের আগেই সে হারিয়ে যায়। ভেঙে পড়ে পরী। প্রচন্ড মানসিক আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়। অতঃপর পরী দেশান্তর হয়।
প্রায় ছয় বছর পর পরীর বিয়ে হয় অর্থলোভী, অনুভূতিহীন, এক অসামাজিক আত্মীয় সাথে। কিন্তু পরী তখনো ভুলতে পারেনি আকাশকে। ভুল করে পরী; সহজ ভাবেই স্বামীকে বলে দেয় আকাশের কথা। যদিও তিনি কিছু বলেননি। তবে বন্দি জীবনের ঘোষণা দিয়ে দেন ধীরে ধীরে।
তারপরও জীবন থেমে থাকেনি। এই টাকার সন্ধানে ঘুরা স্বামীর সংসারে পরী মা হয়। এর-ই মাঝে হঠাৎ করেই বিদেশের রাস্তায় আবার দেখা হয়ে যায় আকাশের সাথে। এবার কৈফিয়ত চায় পরী। প্রতিউত্তরে আকাশ জানায় কঠিন এক বাস্তবতা- জানায় তার কঠিন এক অসুখের কথা। যদিও জানতো সে আর কোনদিন ভালো হবে না কিন্তু একদিন সে ঠিকই ভালো হয়ে যায়। সংসারিও হয়। বাবাও হয়।
দু’জন যখন আবার নিজেদের সংসার ভুলতে শুরু করলো পরস্পরকে পেয়ে ঠিক তখন আকাশ আবারও উদাও হয়ে গেল। আকাশ সাথে সাথে কারণটা বলে- আমি তাকে তার সংসারেই সুখি দেখতে চেয়েছিলাম।
পৃথিবীর নিজ কক্ষপথে ক্রমাগত ঘূর্ণনের কারণে বারবারই দু’জনের দেখা হয়ে যাচ্ছে। এখনো দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। যদিও দু’জন কেউই নিজ সংসারে সুখি নয় তবুও সামাজিকতার বাধ্য-বাধ্যকতায় তারা আটকে আছে।
পরীর তিন সন্তান; আকাশও তিন সন্তানের বাবা। এ অবস্থায় তারা কিছুতেই এই মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি পাচ্ছে না
আকাশের বয়সটা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই আর পরীর মেয়েটার বয়স চৌদ্দ। এ অবস্থায়ও দু’জনের দেখা হলে দু’জনই ভুলে যায় নিজ পৃথিবী। আবার কেউ একজন যখন নিজেকে কিছুটা ফিরে পায় তখনই ছলনা করে কিছুটা দূরে হারায়। কিন্তু অজান্তেই ফিরে আসে পরস্পর পরস্পরের কাছে। আবার নতুন করে আরও তীব্রতর হয়ে ভালোবাসায় আকড়ে ধরে। অতঃপর গল্পটা অসমাপ্তই থেকে যায়।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান