অবেলায় স্টেশনে
পড়ন্ত বিকেল ৷মোহনগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে ছিলো অভি৷ লক ডাউনের কারনে এখন ট্রেনের সংখ্যা কমে গেছে ৷ আজ আর ট্রেন নেই ৷ কিছুক্ষণ আগে শেষ ট্রেনটি ছেড়ে গেল ৷ ছোট স্টেশন ৷ ভীড় ভাট্টা নেই ৷ এমন সময় স্টেশনে বসে থাকতে ভালো লাগে অভির ৷
— অবেলায় স্টেশনে কি করো ? আজ তো আর ট্রেন নেই ৷
একটি মেয়ে কণ্ঠের শব্দে পেছন ফিরে তাকায় অভি ৷ অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ে বয়স ত্রিশের কোঠায় ৷ নীল শাড়ী কালো, টিপ, খোঁপায় সাদা মালতী ফুলের স্তুপ যেন ৷
— এমনিই বসে আছি ৷ ভালো লাগে তাই , জবাব দেয় অভি ৷
–চিনতে পেরেছো ?
— ছবিটি অচেনা হলেও স্বরটি অচেনা নয় ৷
— যাক বাবা স্বরটি তাহলে মনে রেখেছো ৷ বিয়ে করেছো শুনলাম ছবিটি রিপ্লেস করে বউয়ের ছবি দিয়েছো ? বউ ভুলিয়ে দিয়েছে বুঝি ছবিটা ? খুব আদর করে বুঝি ? তবে স্বরটি ভুলাতে পারলো না কেন ?
— হুমম বিয়ে করেছিলাম ৷ আসলে কেউ ভোলায় নি নিজেই ভুলে গেছি ৷ সব কিছু ভুলতে চেয়েছি কিন্তু সব পারলাম কই ? মনটা বড্ড বেয়ারা ৷ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না ৷
–বিয়ে করেছিলাম মানে ? বউকে ছেড়ে দিয়েছো ? আর কত অন্যায় এই এক জীবনে করবে বলো ?
— নিত্য যে মনের ভিতর চলে
ভিন্ন নারীর ভালোবাসার চাষ ৷
কোন সাহসে আমার সাথে কেউ
গড়বে সুখ স্বপনের আবাস ৷
নিত্য যে খুঁজে ফিরে
ভিন্ন নারীর সুবাস ৷
এমন কি ফুল ছিল তার
সুরোভিত করবে আমার আবাস ৷
নিত্য যে চোখের তারা
খুঁজে ফিরে অন্য নারীর আকাশ ৷
কোন রংয়ে সে মুগ্ধ হয়ে
আগলাবে আমার ভালোবাসাহীন আবাস ৷
— তার মানে আবার অন্য কোন মেয়ের প্রেমে পড়েছিলে তুমি ? ছিঃ ৷
— হা হা হা ৷ অনেকদিন পর হাসলাম ৷ প্রথম প্রেমটাকেই তো ভুলতে পারলাম না , নতুন করে আর কি প্রেমে পড়বো ? নতুন করে প্রেমে পড়তে পারলে তো বউটাকেই আটকে রাখতে পারতাম ৷
— তাহলে বিয়েটা করলে কেন ?
— বিয়ে তো আমি করিনি ৷ বড্ড ভালো মেয়ে পরমিতা ৷ আমার ছন্নছাড়া জীবনটাকে গোছানোর জন্য জোর করেই আমাকে বিয়ে করেছিল পারিবারিক ভাবে ৷ দু বছর সংগ্রাম করেছিল আমাকে ট্রাকে আনতে পরে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে ৷ বেচারী!
— হা হা হা ৷ অভি মনে হচ্ছে বউ তোমাকে ত্যাগ করার পর বউয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে ?
— ঠিক ভালোবাসা না করুণা ৷
— এতো কষ্ট করেছে তোমাকে ফেরাতে , তুমি চাইলেই তো ফিরতে পারতে ৷
— চেষ্টা করেছিলাম বৈকি ৷ তাই তো ছবিটি ভুলতে পেরেছি কিন্তু আর কিছু তো ভুলতে পারলাম না ৷ তার কণ্ঠ সদা বীণা হয়ে বাজে , সুখ স্মৃতি গুলো ওলটপালট করে দেয় ভাবনার জাল ৷
— চলো কোন রেস্টুরেন্টে বসি ৷ চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে ৷
— চা এখানেই পাওয়া যাবে ৷ কতদিন পরে দেখা হল বলো ৷ এখানে ভালোভাবে কথা বলা যাবে ৷ বসো আমি চা নিয়ে আসছি ৷
একটু পরে দু কাপ চা নিয়ে হাজির হয় অভি ৷
— নাও তোমার চা ৷
— ভুলে গিয়েছিলাম একটাতে চিনি দিতে না করবো ৷
— আমি ভুলিনি যে ,তোমার চা তে চিনি চলে না ৷
— এতো ছোট ব্যাপারটা ও মনে রেখেছো ?
— এর চেয়েও ছোট ব্যাপার গুলোও ভুলতে পারিনি ৷
— অনেক বড় কবি হয়েছো দেখলাম ৷
— কি যে বলো যা তা ৷ আচ্ছা হঠাৎ এখানে এলে কেন ?
— হঠাৎ আসিনি তো ৷ জেনেই এসেছি ৷ আজকের পত্রিকায় তোমার একটা কবিতা ছেপেছে সেখানে দেখলাম দুটি লাইন লিখেছো “যদি কখনও দেখতে ইচ্ছে হয়/ চলে এসো অবেলায় স্টেশনে ৷” তাই চলে এলাম ৷
— কি করে জানলে আমি এই শহরের এই স্টেশনেই থাকবো ?
— জানতাম না তো ৷ তবুও মনকে বোঝানোর জন্য এসেছিলাম ৷ তোমাকে পেয়ে যাবো সত্যিই ভাবিনি ৷
— কতটা আশ্চর্য্যের ব্যাপার বলো ৷ একই শহরে থাকি কিন্তু কেউ তা জানি না ৷ আজ দেখা হয়ে গেল ৷
— নিয়তি আমাকে এখানে টেনে এনেছে ৷
— যাহোক কেমন আছো বলো ? হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে হলো কেন ?
— ভালো আছি ৷ বহুদিন থেকেই দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু উপায় ছিল না ৷ হয়ত আজকের দিনটি নিয়তি নির্ধারিত করে রেখেছিল তাই উপায় বাতলায় নি ৷
— হয়ত তাই ৷
–আচ্ছা কতদিন পরে আমাদের দেখা হলো ?
–ঠিক তের বছর পরে ৷
— তের বছর আগে কি এমন হয়েছিল যে আমরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম ?
— আজ থাক ৷ সে কথা না হয় বলবো অন্য কোন দিন ৷
— কোথায় ? কখন ?
— অবেলায় স্টেশনে ৷
অভি সঞ্চিতার পাশ থেকে উঠে রেল লাইন ধরে হাটতে শুরু করলো ৷ এলোমেলো লম্বা চুল , দাড়ি, গোঁফ, মলিন বস্ত্র ৷ নির্লিপ্ত চোখে সঞ্চিতা তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ অভিকে দেখা যায় ৷ তারপর উঠে স্টেশনের বাইরে দাড়িয়ে থাকা প্রিয় রোলস রয়েলস চালিয়ে ফিরে গেলো ৷
লেখকঃ ঢাকা, বাংলাদেশ থেকে
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

