বাউণ্ডুলেঃ পাবলিক বাসে একদিন
হঠাৎ তীব্র একটা গন্ধে মাথাটা ভন্ করে ঘুরে উঠলো। সাথে সাথে পেটের সবকিছু বেরিয়ে আসতে চাইল মুখ দিয়ে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে আশে-পাশে নজর দিলাম। দেখি দুই সিট সামনে বসা ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন। উনার তখন পৌষ মাস, কিন্তু আমার যে সর্বনাশ।
বিনীতভাবে উনাকে বললাম- ‘‘ভাই, আমার সমস্যা হচ্ছে, যাদি সিগারেটটা ফেলে দিতেন তাহলে ভালো হতো।’’ উনি কিছু না বলে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। এমনকি সিগারেটটার ছাই ঝেড়ে আবার সুখ টানের প্রস্তুতি নিলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আবার অনুরোধ করলাম। এবার উনি যেভাবে তাকালেন মৃত মানুষও এ দৃষ্টি দেখলে দৌড়ানো শুরু করবে।
সিগারেট যে শুধু আমার সমস্যা করছে তা নয়, বাসে বসা আশপাশের দু’ একজনের অবস্থাও আমার মতো। তারা নীরবেই সব সহ্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি একটু সুপুরুষ হতে চেয়ে যে দৃষ্টি দেখলাম, সে দৃষ্টি আরও কিছুক্ষণ আমার উপর থাকলে আমি ভষ্ম হয়ে যেতাম। যাক উনি উনার দৃষ্টি সরিয়ে সুখ টান দিতে লাগলেন আর আমরা সমস্যাগ্রস্থ দু’ একজন অকাতরেই ভোগতে লাগলাম।
নিজের অবস্থা যখন আরও ঘোলাটে হচ্ছে ঠিক তখন দেখি আমার পিছনে বসা আরেক ভদ্রলোক(!) সিগারেট ধরিয়েছেন। একটু দূরে দেখি এক যুবতী মেয়ে নাকে ওড়না চেপে ধরেছে। পাশের সিটে বসা আরেক মহিলা; যাকে দেখলেই বুঝা যাচ্ছে তিনি মা হতে যাচ্ছেন- তিনিও নাকে মুখে আঁচল চেপে ধরছেন এবং পাশে বসা যুবতীকে সরিয়ে নিজে জানালার পাশে যাচ্ছেন। কিন্তু জায়গা মতো পৌঁছার আগেই উনি বমি শুরু করলেন।
মহিলার সামনের সিটের এক যুবক এই বার সচল হলেন। তিনি আমার পিছনে বসা ভদ্রলোককে(!) বললেন- ‘‘ভাই, সিগারেটটা ফেলে দেন, দেখছেন না কিভাবে সমস্যা হচ্ছে।’’ কথাটা শুনা মাত্র উনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং যাত্রাপালার সেই রাজাদের মতো সংলাপ শুরু করলেন- ‘‘এতো যদি সমস্যা; তবে প্রাইভেট গাড়িতে যান না কেন?’’ যুবকও কম নয়, সেও বললো- ‘‘দেখেন না একজন মহিলা বমি করছেন। আর পাবলিক বাসে যে সিগারেট খাওয়া নিষেধ তা কি জানেন না?’’ লোকটা গোয়ারের মতো মুখ করে বললেন- ‘‘আরে মিয়া, রাখেন এসব নিষেধ-ফিষেধ। ঐ মহিলার এমনিতেই বমি হওয়ার সময়, বমি তো হবেই।’’
এবার আমার পুরুষত্ব জাগলো, বললাম- ‘‘এই ভাই, সিগারেটটা ফেলে দিলেইতো হয়। অপরাধ তো করছেন আবার বড় বড় কথাও বলছেন। আপনাদের একটুও কাণ্ডজ্ঞান নেই।’’ আমার এই কথায় সামনে বসা ভদ্রলোক(!) সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন- ‘‘এই ছেলেরা, বেয়াদবের মতো কথা বলছো কেন? এতো সমস্যা থাকলে পাবলিক বাসে উঠবা না। অপদার্থের দল।’’
যুবক এবার দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার পিছনের লোকটার কাছে এসে বললেন- ‘‘ঐ মিয়া, সিগারেট ফালান, না হয় খবর আছে।’’ আমার সামনের লোকটা এবার পিছনের লোকটার পক্ষ নিয়ে যুবককে আক্রমন করলেন। আমিও যুবকের পক্ষ নিলাম। শুরু হয়ে গেল তুমুল আন্দোলন। ততক্ষণে যুবতীও বমি শুরু করেছে। আমি লোক দুটোকে বললাম- ‘‘দেখেন তো, ঐ মহিলার না হয় বমি হওয়ার কথা; তবে এই যুবতী কেন বমি করছেন।’’
পিছনের লোকটা বললেন- ‘‘এই যুবতী তোর কি হয়? এদের নিয়ে এত ব্যস্ত কেন?’’ বাক-বিতর্কের এক পর্যায়ে শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি। বাসের সবাই নীরব, যেন কোন বক্সিং শো দেখছেন। শুধু বাসের হেলপার এসে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন। এমন সময় দেখলাম বাসের ড্রাইভার একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিচ্ছেন আর ঠোঁট গোল করে ধোঁয়া জানালা দিয়ে বাহিরে ছাড়ছেন; যেন বাসের ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে উনার কোন খেয়ালই নেই।
যাক এক সময় আরও দু’ একজনের চেষ্টায় অমিমাংশিত ভাবে আমরা কিছুটা শান্ত হলাম। নিজ নিজ সিটে বসে আগুন দৃষ্টি ঝরাতে লাগলাম; যেন আমরা দৃষ্টি যুদ্ধ করছি।
কিছু দূর যাওয়ার পর কয়েকটা কলেজগামী মেয়ে বাসে উঠলো। তাদের পিছনে কয়েকজন যুবকও উঠলো। যুবকদের দিকে তাকাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, এই মেয়েদের জন্যই তাদের বাসে উঠা। মেয়েরা বসার সিট পেলও যুবকদের বাঁদুর ঝুলা ঝুলতে হলো। তবুও তারা যেন তৃপ্ত। তারা বিভিন্ন মন্তব্য ও ইশারায় মেয়েদের বিভ্রান্ত করতে লাগলো। মেয়েরা লজ্জায় মাথা নত করে চুপচাপ বসে থাকতে বাধ্য হলো।
একটু খেয়াল করে দেখলাম একটা মেয়ে কাঁপছে। যুবকরা এবার সিগারেট ধরাল। সিগারেটের গন্ধে আবারও মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো। আর সম্ভবত আগের ছোট খাট একটা বিজয়, মেয়েটার কাপুনি এবং সুপুরুষ হওয়ার নেশায়, ঘুর্ণায়মান মাথা সুপরিকল্পনা না করেই আমাকে নায়ক সাজতে উৎসাহ দিলো। বাধা দিলাম যুবকদের; ফলস্বরূপ একপর্যায়ে যখন সবকিছু উত্তপ্ত হলো, প্রচণ্ড ব্যথায় আমি জ্ঞান হারালাম।
চোখ খুললাম হাসপাতালের বেডে। অসংখ্য ব্যান্ডেজ শরীরে। ব্যথায় অসাড় গোটা কাঠামোটা। পাশের বেডে দেখি ঠিক একই রকম অবস্থায় বাসের সেই প্রতিবাদী যুবক। উনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন- ‘‘ভাই, এটাই হলো সমাজ, এটাই হলো সভ্যতা; আর এই সভ্যতার ছোঁয়া আমাদের গায়ে লাগাতে পারিনি বিধায় তারা আমাদের গায়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো’’।
আমি উনাকে জিজ্ঞাস করলাম- ‘‘আপনার এ অবস্থা কেমন করে হলো’’। উনি বললেন- ‘‘কারো মধ্যে বীরপুরুষের প্রবণতা দেখলে নিজে তাকে অনুসরণের প্রবল একটা ব্যাধি আমার আছে। আর আপনাকে অনুসরণ করতে গিয়েই তো আমার এই অবস্থা। ভাই, সভ্যতা এরকমই। আপনি জানেন কিনা জানি না; তবে আমি অজ্ঞান হওয়ার আগ মুহূর্তে শুনলাম দুই তিনটা কন্ঠ বলছে- এখন ঠিক হয়েছে। বাসে উঠেছি থেকে এ দু’জনের যন্ত্রনায় একটু ঘুমাতেও পারলাম না।’’
লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কেকে

