রহমতে আলম (সাঃ) : ইসরা ও মি’রাজ (পর্ব পাঁচ)

আল্লাহ তায়াল তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রথম আসমান থেকে সপ্তম আসমানে মোট আটজন বিশিষ্ট নাবী রাসূলদের সাথে সাক্ষাৎ ও সালাম আদান প্রদান করানোর মাধ্যমে মূলত তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। সেই সময় প্রত্যেক আসমানে অসংখ্য ফেরেশতাও উপস্থিত ছিলেন। আবার বিশেষভাবে হযরত মূসা, ঈসা ও ইব্রাহীম (আঃ) এর সাথে দেখা করার কথা সহীহ মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মি’রাজ রজনীতে আমি মূসা (আঃ) এর সাথে দেখা করেছি। এরপর তিঁনি তাঁর দেহের আকৃতি বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দেহের আকৃতি বর্ণনা করেছেন যে, তিঁনি মৃদু কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট। দেখতে শানুয়াহ গোত্রের লোকদের ন্যায়। নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ঈসা (আঃ) এর সাথে দেখা করেছি। এরপর তিঁনি ঈসা (আঃ) এর আকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিঁনি মধ্যম ধরনের লোহিত বর্ণের পুরুষ। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি যেন গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ইব্রাহীম (আঃ) কে দেখেছি। তাঁর সন্তানদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশী তাঁর সাদৃশ্যের অধিকারী”।

আল-বায়তুল মা’মুর প্রকাশ।

এর পর একটা সময় রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে মাসজিদে বায়তুল মা’মুর প্রকাশ করা হলো। বাইতুল মা’মুর নামে বাইতুল্লাহ শরীফের উপরে সপ্তম আসমানে একটি মাসজিদ আছে। দুনিয়াতে যেমন আমরা বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করি তেমনি বায়তুল মা’মুরে সর্বক্ষণ ফেরেশতারা তাওয়াফ করেন। প্রতিদিন সেখানে এমন ৭০ হাজার ফেরেশতা তাওয়াফের জন্য আসেন, যারা ভবিষ্যতে আর কোন দিন এখানে আসবেন না। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হলো। সেখানে ইব্রাহীম (আঃ) এর দেখা পেলাম। তিঁনি বাইতুল মা’মুরে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। বাইতুল মা’মুরে প্রত্যেকদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেন যাঁরা আর সেখানে পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ পান না”।

 শরাব, দুধ ও মধুর পাত্র থেকে দুধ পছন্দ করা।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর আমার সামনে আল-বায়তুল মা’মুর প্রকাশ করা হলো। এরপর আমার সামনে একটি শরাবের পাত্র, একটি দুধের পাত্র ও একটি মধুর পাত্র রাখ হলো। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তখন জিব্রাঈল বললেন, এই হচ্ছে ফিতরাত তথা ইসলাম ধর্ম। আপনি ও আপনার উম্মতগণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত”।

 সিদ্রাতুল মুন্তাহায় অবতরণ।

সিদ্রাতুল মুন্তাহার দুটি শব্দকে যদি আমরা পৃথক করে শাব্দিক অর্থ করি তাহলে সিদ্রাতুন অর্থ হবে বরই গাছ। আর মুন্তাহা অর্থ হবে সর্বশেষ ষ্টেশন। এটাকে সিদ্রাতুল মুন্তাহা বা সর্বশেষ ষ্টেশন এজন্য বলা হয় যে, দুনিয়া থেকে যত ফেরেশতারা উপরের দিকে যান, এমনকি জিব্রাঈল ও মুনকার-নাকীর তারা ঐ পর্যন্ত যেতে পারেন, এর উপরে আর যেতে পারেন না। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত মালিক ইবনে সা’সা’আহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর নাবী যে রাতে তাকেঁ ভ্রমণ করানো হয়েছে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তারপর আমাকে সিদ্রাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত উঠানো হলো। দেখতে পেলাম, তার ফল হাজার অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতাগুলি হাতির কানের মত। আমাকে বলা হলো, এ হলো সিদ্রাতুল মুন্তাহা”।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মি’রাজ রজনীতে সিদ্রাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো। এটি ষষ্ঠ আসমানে অবস্থিত। জমিন থেকে যা কিছু উত্থিত হয় তা সে পর্যন্ত এসে পৌছে এবং সেখানে থেকে তা গ্রহণ করা হয়। তদ্রূপ ঊর্ধ্বলোক থেকে যা কিছু অবতরণ হয় তাও এ পর্যন্ত এসে পৌছে এবং সেখান থেকে তা গ্রহণ করা হয়। এরপর আব্দুল্লাহ (রাঃ) সূরা আন-নাজমের ১৬ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করলেন- অর্থাৎ “যখন প্রান্তবর্তী বাদরী বৃক্ষটি যা দ্বারা আচ্ছাদিত হবার, তা দ্বারা আচ্ছাদিত হলো”। এবং তিনি বলেন, এখানে “যা দ্বারা” কথাটির অর্থ সোনার পতঙ্গসমূহ”।

হযরত ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন যে, প্রত্যেক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, সিদ্রাতুল মুন্তাহা ষষ্ঠ আসমানে। শুধু হযরত আনাস (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীস সমূহে আছে যে, সিদ্রাতুল মুন্তাহা সপ্তম আসমানের উপরে। হযরত কাযী ইয়ায (রহঃ) বলেন, সঠিক এবং অধিকাংশের মত এটাই। এ দুই প্রকার হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য এভাবে করা যায় যে, সিদ্রাতুল মুন্তাহার জড় বা গোড়া ষষ্ঠ আসমানে এবং এ গাছের ডালপাতা সপ্তম আসমানের উপর পর্যন্ত গেছে।

 চারটি নহর দেখানো হলো।

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফসহ বহু হাদীসে এসেছে সিদ্রাতুল মুন্তাহায় চারটি নহর দেখেছেন- “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেখানে আমি চারটি নহর দেখতে পেলাম, যাদের দুটি ছিলো অপ্রকাশ্য আর দুটি ছিলো প্রকাশ্য। তখন আমি জিব্রাঈল (আঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম এ নহরগুলি কী? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য, দুটি হলো জান্নাতের দুটি নহর। আর প্রকাশ্য দুটি হল নীল নদী ও ফুরাত নদী”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ৪টি নহর দেখেছেন তার দুটি যাহিরী আর দুটি বাত্বিনী। যাহিরী বা প্রকাশ্য নহর ছিলো নীল ও ফুরাত। এর তাৎপর্য বলতে গিয়ে মুহাদ্দিসীনগন বলেছেন সম্ভবত এই যে, তাঁর দ্বীন তথা ইসলাম ধর্ম নীল এবং ফুরাতের সজীব এলাকা সমূহে বিস্তার লাভ করবে। অর্থাৎ এখানকার অধিবাসীরা বংশ পরম্পরায় মুসলিম হবে। এটার অর্থ এ নয় যে, এই দুটি নহরের পানির উৎস জান্নাতে রয়েছে। নীল নদী আফ্রিকার মিসর রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে এবং ফুরাত নদী ইরাকের কুফার নিকটে অবস্থিত।

জান্নাতের মনোরম দৃশ্য দেখা।

সিদ্রাতুল মুন্তাহার পাশেই জান্নাতের অবস্থান। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জান্নাতের সব স্তরের মনোরম দৃশ্য ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তারপর আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো। তথায় ছিল মুক্তার গম্বুজ আর তার মাটি ছিল মিশকের”। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা (তথা জিব্রাঈল ও মিকাঈল) আমাকে বললেন, এটা জান্নাতে আদন এবং এটা আপনার বাসস্থান। তিঁনি বলেন, আমি বেশ উপরের দিকে তাকালাম, দেখলাম ধবধবে সাদা মেঘের মত একটি প্রাসাদ আছে। তিঁনি বলেন, তারা আমাকে বললেন, এটা আপনার বাসগৃহ। তিঁনি বলেন, আমি তাদেরকে বললাম, আল্লাহ তোমাদের মাঝে বরকত দিন! আমাকে অনুমতি দাও। আমি এতে প্রবেশ করি। তারা বললেন, আপনি অবশ্য এতে প্রবেশ করবেন। তবে এখন নয়”।

—–চলবে ইনশা-আল্লাহ

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ