বরকতময় রামাদ্বান : সাদাক্বাতুল ফিত্বর


রাহমাত, বারাকাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাহিনা পবিত্র মাহে রামাদ্বান মাসের ইবাদত সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত হচ্ছে রোজার শেষে ঈদুল ফিত্বরের দিন সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা। যাদের উপরে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা ওয়াজীব তাদের অনেকেই আদায় করার সঠিক সময় ও কি দ্বারা আদায় করবেন সেটা নিয়ে অনেকটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান। তাই আজকের প্রবন্ধে আমরা কখন ও কি দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করব সে দুটি বিষয় পরিষ্কার করার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ।

সাদাক্বাতুল ফিত্বর কখন দিবেন?

সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায়ের ক্ষেত্রে দুটি সময়ের কথা পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে-(এক) ফজিলতপূর্ণ সময়- ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজের পূর্বে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদেরকে ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করার নির্দেশ দেন”। সুনানে আবূ দাউদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ এর মধ্যে এসেছে- “হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজাদারের অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণের কাফফারাস্বরূপ এবং গরীব-মিসকীনদের আহারের সংস্থান করার জন্য সাদাক্বাতুল ফিত্বর নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে তা আদায় করে তা গ্রহণীয় দান। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পর আদায় করে, তা হবে দানসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি দান”।

(দুই) জায়েজ সময় – ঈদের একদিন বা দুদিন পূর্বে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা। তখন তা ওয়াজিব হিসেবেই আদায় হয়ে যাবে। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক পুরুষ, মহিলা, আযাদ ও গোলামের পক্ষ হতে সাদাক্বাতুল ফিত্বর অথবা (বলেছেন) সাদাক্বাই রামাদ্বান হিসেবে এক সা’ খেজুর বা এক এক সা’ যব আদায় করা ফরজ করেছেন। অতঃপর লোকেরা অর্ধ সা’ গমকে এক সা’ খেজুরের সমান দিতে লাগল। (রাবী নাফি বলেন) ইবনে উমর (রাঃ) খেজুর (সাদাক্বাতুল ফিত্বর হিসেবে) দিতেন। এক সময় মাদীনায় খেজুর দুর্লভ হলে যব দিয়ে তা আদায় করেন। ইবনে উমর (রাঃ) প্রাপ্ত বয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকলের পক্ষ হতেই সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করতেন, এমনকি আমার সন্তানদের পক্ষ হতেও সাদাক্বার দ্রব্য গ্রহীতাদেরকে দিয়ে দিতেন এবং ঈদের এক বা দুইদিন পূর্বেই আদায় করে দিতেন”।

 ঈদের নামাজের পর দিলে কি আদায় হবে?

সাদাক্বাতুল ফিত্বর ঈদের দিন ঈদের নামাজের পূর্বেই আদায় করা মোস্তাহাব। যদি কোনো কারণবশত ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করতে না পারে তাহলে পরে হলেও আদায় করা ওয়াজিব। এটা কখনো নফলে পরিণত হবে না। (হেদায়া প্রথম খণ্ড)।

 ঈদের কতদিন পূর্বে ফিতরা আদায় করা যাবে?

এ বিষয়ে ইসলামি স্কলারদের মতভেদ থাকলেও গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, রামাদ্বানের পূর্বে আদায় করলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে শামী দ্বিতীয় খণ্ড)

 কি দ্বারা আদায় করা?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা
সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা হতো, যেমন খেজুর, কিসমিস, জব ও পনির। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা’ পরিমাণ যব অথবা এক সা’ পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা’ পরিমাণ পনির অথবা এক সা’ পরিমাণ কিসমিস দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করতাম”।

গম দ্বারা কি আদায় করা যাবে?

হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর যুগে গমের ফলন বেড়ে যাওয়ায় গমকে আলোচিত চারটি পণ্যের সঙ্গে সংযোজন করা হয়। আর তখন গমের দাম ছিল বাকি চারটি পণ্যের তুলনায় বেশি। আর মূলত এই দাম বেশি থাকার কারণেই হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) গমকে সাদাক্বাতুল ফিত্বরার পণ্যের তালিকাভুক্ত করেছিলেন। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে এক সা’ খাদ্যদ্রব্য বা এক সা’ খেজুর বা এক সা’ যব বা এক সা’ কিসমিস দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করতাম। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর যুগে যখন গম আমদানী হলো তখন তিনি বললেন, এক মুদ গম (পূর্বোক্তগুলোর) দু’ মুদ এর সমপরিমাণ বলে আমার মনে হয় (আদায় করার নির্দেশ দিলেন)”। সহীহ বুখারী শরীফের আরো একটি হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদাক্বাতুল ফিত্বর হিসেবে এক সা’ পরিমাণ খেজুর বা এক সা’ পরিমাণ যব দিয়ে আদায় করতে নির্দেশ দেন। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, অতঃপর লোকেরা যবের সমপরিমাণ হিসেবে দু’ মুদ (অর্ধ সা’) গম আদায় করতে থাকে”।

উপরোক্ত হাদীসের মাধ্যমে আমরা মোট পাঁচ প্রকারের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করার কথা জানলাম। সেগুলো হচ্ছে- খেজুর, কিসমিস, জব, পনির ও গম। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে উপরোক্ত হাদীসে যে খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে তা সে দেশের প্রধান ও প্রচলিত খাদ্য দ্রব্য ছিলো। তাই তা থেকে তারা সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করতেন। হাদীসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্যের যে উল্লেখ রয়েছে তা উদাহরণ হিসাবে এসেছে নির্ধারণ হিসেবে নয়। তাই প্রত্যেক দেশের প্রধান ও প্রচলিত খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিত্বরা আদায় করা যাবে।

অতএব বাংলাদেশে যেহেতু খাদ্য হিসেবে চালের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে তাই চালের ফিতরা আদায় করা যাবে। তবে যবের উপর ক্বিয়াস করে ধানের ফিতরা দিলে আদায় হবে না। আর চালের
ফিত্বরার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন- হযরত ইবনুল কাইউম (রহঃ)- (কিতাব ইলামুল মুয়াক্কেয়ীন এর দ্বিতীয় খণ্ডে)। হযরত আল্লামা উষাইমীন (রহঃ)- (কিতাব মাযমুআ ফাতাওয়া উষাইমীন আঠারতম খণ্ডে)। হযরত হাফিয আইনুল বারী (রহঃ)- (কিতাব সিয়াম ও রামাদ্বান)।

 মুদ্রা (টাকা) দ্বারা কি আদায় হবে?

মুদ্রা দ্বারা আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। তার দলীল হচ্ছে- “হযরত যুহাইর (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক (রহঃ) থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রামাদ্বানের সাদাক্বাতুল ফিত্বর খাবারের বিনিময়ে মুদ্রা (টাকা) দ্বারা আদায় করতেন। (ইবনে আবি শায়বা দ্বিতীয় খণ্ড, সনদ সম্পূর্ণ সহীহ তথা প্রমাণযোগ্য)।

হাদীসের পর্যালোচনা- কেউ কেউ মুদ্রা (টাকা) দ্বারা ফিত্বরা দেওয়া জায়েজ হবে না বলেন। কারণ হিসেবে উনারা বলতে চান উক্ত হাদীসের রাবী হযরত ইসহাক (রহঃ) শেষ বয়সে উম্মাদ হয়ে গেছিলেন! (নাউযুবিল্লাহ)। আসল কথা হলো তিনির শেষ বয়সে এসে সৃতি শক্তি কমে গিয়েছিল। আর এটা যে কারো হতে পারে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। আর তিনি এই হাদীস যখন বর্ণনা করেছেন তখন কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ সৃতি শক্তির মানুষ ছিলেন। আবার এই বানোয়াট অভিযোগ তুলে যদি উক্ত হাদীস বাদ দেওয়া হয় বা দূর্বল বলা হয় তাহলে উনি সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস মিলিয়ে কমপক্ষে নয়টি হাদীস বর্ণনা করেছেন সেগুলো কি করবেন? অথচ সহীহ বুখারী শরীফের যে ১২১ জন বর্ণনাকারী রয়েছেন সবাই গ্রহণযোগ্য এখানে কারো বিষয়ে কোন মুহাদ্দীসের কথা নেই। সুতরাং আমরা যদি সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস গ্রহণ করতে পারি তাহলে অবশ্যই ইবনে আবি শায়বা এর হাদীসও গ্রহণ করতে পারি।

 কয়েকজন প্রসিদ্ধ ইমামগণের মত।

হযরত হাসান বসরী (রহঃ) এর একটা আসার- “তিনি বলেন, মুদ্রা (টাকা) দ্বারা সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করার দ্বারা কোন সমস্যা নেই”। (ইবনে আবি শায়বা দ্বিতীয় খণ্ড)

হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) এর চিঠি- ভাবার্থ: “হযরত ইমাম ওয়াকী (রহঃ) কুররা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমরা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযিয (রহঃ) নিকট সাদাক্বাতুল ফিত্বর সম্পর্কে একটি চিঠি নিয়ে আসলাম সেখানে লিখা ছিলো লোকজন সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করবে অর্ধ সা’ অথবা তার সমমূল্যে অর্ধ সা’ পরিমান দিরহাম দ্বারা দিয়ে”। (ইবনে আবি শায়বা দ্বিতীয় খণ্ড)

ইমাম ইবনে আবি শায়বা (রহঃ) তার রচিত কিতাব ইবনে আবি শায়বা এর দ্বিতীয় খণ্ডে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে- অর্থাৎ সাদাক্বাতুল ফিত্বর মুদ্রা (টাকা) দ্বারা আদায় করার (বৈধতা) সম্পর্কে।

ইমাম বায়হাকী (রহঃ) তার রচিত কিতাব সুনানুল কুবরা চতুর্থ খণ্ডে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে- এই অনুচ্ছেদ হলো মুদ্রা (টাকা) দ্বারা যাকাত আদায় করা অনুমোদিত।

আল্লামা জাজীরী (রহঃ) বলেন- “মুদ্রা (টাকা) দ্বারা সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা জায়েজ বরং সর্বোত্তম। কেননা তাতে গরিব অসহায় মানুয়ের অধিক উপকার সাধিত হয়”৷ (ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা প্রথম খণ্ড)

হযরত ইবনে রশীদ রহঃ) বলেন- “ইমাম বুখারী (রহঃ) এ মাসআলায় টাকা দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা হানাফীদের সাথে সহমত পোষণ করেছেন”। (ফাতহুল বারী তৃতীয় খণ্ড)

হযরত ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) বলেন- “খেজুর, গম বা যব দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা আবশ্যক নয়। বরং যদি এর মূল্য দ্বারা আদায় করা হয়, যা গরীবদের জন্য অধিক উপকারী, তবে তা জায়েজ আছে। কেননা, সাদাক্বাহ দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হলো গরীবদের দারিদ্রতা দূর করা এবং তার সেদিনের প্রয়োজন পূর্ণ করা”। (মাউসূআতু ফিক্বহি সুফিয়ান সাওরী)

সর্বোপরি মুদ্রা (টাকা) দ্বারা সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায়ের মত ব্যক্ত করেছেন, হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ), ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ), উমর বিন আব্দুল আজীজ (রহঃ), হযরত হাসান বসরী (রহঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ), ইমাম তাহাবী (রহঃ), ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াই (রহঃ) ও ইমাম আবু সাউর (রহঃ)। (যাকাতুল ফিত্বর আহকামূহা ওয়া নাওয়াজিলুহা, মুহাম্মদ বিন আব্দুল গাফফার শরীফ কৃত)

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ফেৎনা সৃষ্টি না করে সঠিক দ্বীন বুঝে আমল করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ