করোনাকালীন বিয়ে; হতাশ রাক্ষুসে সমাজ!

মুবিন খান

ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু সে বিয়ের করার জন্য এগুতে পারছে না। পরিবারও তাকে বিয়ে করতে সম্মতি দিচ্ছে না। কারন তার কাছে সেরকম টাকা নেই। বিয়ে করতে মোটা অংকের টাকা প্রয়োজন। বাবা বলছেন, আমি ঢাকঢোল পিটিয়ে সমাজের সবাইকে দাওয়াত করে তোমাকে বিয়ে করাবো।

তার আগে তুমি নিজের ক্যারিয়ার গড়ো। বিয়ের খরচ যোগাড় করো!আমাদের সমাজে একটা ছেলে বিয়ের পীড়িতে বসতে কমপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা নগদ হাতে নিয়ে বসতে হয়। একটা পরিপূর্ণ প্রাপ্ত বয়সের যুবক বিয়ে করতে গেলে সেটা তার কাছে অভিশাপ মনে হয়।

কারণ নিকৃষ্ট এই সমাজের কিছু রাক্ষুস মোড়লরা বিয়েকে একটি মানুষের জীবনের সবচাইতে কঠিন কাজ হিসেবে বানিয়ে রেখেছে। বিয়ে করতে হলে একটা ছেলেকে ৫ বছর স্ট্রাগল করে টাকা রোজি করে তারপর বিয়ের পীড়িতে বসতে হয়৷ তার পাচ বছরে কামাই করা রোজগারির টাকা ওই পারা-প্রতিবেশীদের নানাধরনের কথা শুনে তাদেরকে উৎসর্গ করে দিতে হয়।

একটা ছেলের শারীরিক পরিপূর্ণতা পায় ১৬-১৭ বছরে। আর একটা মেয়ের শারীরিক পরিপূর্ণতা ১৫ বছরের আগেও পেয়ে যায়। ইসলাম বলছে ছেলেমেয়ে উপযুক্ত হয়ে গেলেও বিয়ে দিয়ে দাও। নতুবা বয়সের তাড়নায় সে যে মন্দ কাজে লিপ্ত হবে সেটার গোনাহের অংশ মা বাবার উপরও পড়বে।

আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের বিয়ের একটা নির্দিষ্ট বয়স করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা মতে, একটা ছেলে ২১ বছর হলে বিয়ে করতে পারবে। আর একটা মেয়ে ১৮ বছরে বিয়ে করতে পারবে।

কিন্তু সমাজে আমরা সিস্টেম করে দিয়েছি আবার অন্য রকম। ছেলেদের চাকরির বয়স সীমা ৩২ বছর। তার গ্রাজুয়েশান শেষ করতে করতে বয়স হয়ে যায় ২৬/২৭ বছর। তারপর বিয়ে। সে যেভাবে হউক প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করতে হবে। শুধু কি তাই? বিয়েতে সে নিজের জীবনের দামের চাইতে বেশি মোহরানা দিতে হবে। পারা প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের ৩ দিনের খাবার সে বহন করতে হবে। তার উপর যাতায়াত খরচ, ডেকোরেশন সহ সব সে নিজেই বহনকারী। আমাদের সিলেটে বরযাত্রীদের জন্য ছেলের শুধু গাড়ির খরচ এক লাখের চাইতে বেশি হয়। এদিকে মেয়ের বাবারও কি কম খরচ? একটা ভালো পাত্রের কাছে বিয়ে দিচ্ছেন; খাবার থেকে শুরু করে ছেলের বাড়ির আসবাবপত্র সব মেয়ের বাবাকেই দিতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে দু’পক্ষের মোটামুটি ২০ লাখ টাকা বিয়েতে খরচ হবে।

এইযে ২০ লক্ষ টাকার খরচের বিয়েতে ছেলে বা মেয়ের কি ফায়দা হলো? তারা কি পেল? তাদের লাভ টা কি? বরং যারা এসেছে, খেয়েছে দেখেছে সবাই একটা না একটা ভুল ধরে চলে গেছে। এটা ভালোনা সেটা ভালো, সেটা ভালো না এটা ভালো! হ্যাঁ! এটাই সমাজের চিত্র।

করোনাকালীন এই বিয়ে আমাদের রাক্ষুসে সমাজকে বেশ হতাশ করে তুলেছে। তারা এখন আর বিয়ের পরামর্শ সভায় ইনিয়েবিনিয়ে বসে ফালতু কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেনা। বাংলাদেশে করোনাকালীন এই সময়ে প্রকাশ্যে বা গোপনে একবারে সাধারণভাবে নিজেদের মাঝে স্বল্প খরচে বিয়ের পীড়িতে বসছেন যুবক যুবতীরা। ধ্বনি, মধ্যবিত্ত, গরীব সবাই সমান ভাবে বিয়ে করছেন।
মোহরানার ব্যপারটা আমার জানা নেই। করোনাকালে মোহরানাও সীমিত করা প্রয়োজন।
তবে বিয়ের আনুসাঙ্গিক যে খরচটা একটা যুবককে সবচাইতে বেশি প্যাঁরা দেয় সেটা থেকে সে বেচে গেছে।
পাশের বাড়ির চাচা যখন তাকে বলেছেন একা একা নাকি বিয়ে করে ফেলেছ? উত্তরে তার একটা নীরব মুচকি হাসি-ই যেন সমাজের বহু সমস্যা জর্জরিত কিছু ঘটনার একধরনের নীরব প্রতিবাদ। করোনার কারণে আপনাকে নিতে পারিনি। আর মনে মনে বলছে আমি চাচ্ছিলাম না আপনি আমার বিয়েতে যান।

করোনার এই সময় গুলো আমাদের অনেক সঠিক দিক জানাতে ও বুঝাতে সক্ষম হয়েছে। আমরা জীবন মানেই বুঝতাম বিলাসিতা, আনন্দ, ফূর্তি, অধিক চাহিদা ইত্যাদি।

কিন্তু আমাদের জীবন আসলে কি? আমরা আজকে রাতে ঘুমিয়ে গেলে আগামীকাল সকালের সূর্য দেখতে পাবো কি না সেটার কোন গ্যারান্টি নাই। করোনা আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছে আমরা যে সমাজের মানুষদের খুশি করার জন্য জীবনের সব উপার্জন ঢেলে দেই, বিপদের সময় সেই সমাজের লোকেরাই আমাদের সামাজিক ভাবে হেয় করবে৷ এমনকি মৃত্যুর পরও কাছে আসতে চাইবে না।

একটি যুবক এই করোনাকালীন সময়ে তার নিজের পছন্দের মানুষকে স্বল্প খরচে কাছে টেনে নিয়ে আসতে পেরেছে। যার সাথে সে হালাল একটা সম্পর্ক করে জান্নাতে ঘর বেধে থাকার স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু সমাজ নানা ভাবে তাকে স্বাভাবিক দিনে সেই সুযোগ করে দেয় না। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বিয়ের পীড়িতে বসতে হলে তার আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ে। এই করোনাকালীন সময়ে নিজের অনেক পরিচিত ভাই-ব্রাদার বিয়ে করেছেন। কেউ কেউ প্রবাসী ছিলেন। কেউ বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেন। কেউ সদ্য চাকরি পেয়েছেন। তাদের সাথে কথা হলো; সবাই হাসিমুখে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলছেন আলহামদুলিল্লাহ। ভাই আল্লাহ অনেক বাচিয়ে দিয়েছেন। নইলে ঋণ করতে হতো অনেক টাকা। করোনা শেষ হলে বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের একটা পার্টি দিয়ে দেবো। এটাই শেষ।
হ্যাঁ, এভাবেই হাসি মুখে অনেক টাকা ঋণ করে বিয়ে করতে হয় এই সমাজে। আর এই টাকা টা ছেলে বা মেয়ের কোন কাজেই আসে না। বরং অভিশপ্ত এই সমাজের পেটে চলে যায়।

করোনার এই সময় গুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। ইসলাম আমাদের জীবন যতোটা সহজ করে দিয়েছে। আমরা বিভিন্ন সেনসিটিভ বিষয়ে সেগুলো কতোটা কঠিন করেছি? আমরা দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য অনেকটা সময় ইসলাম ব্যবহার করি। অথচ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।

আমরা যদি এই দেশের সুপার সাকসেসফুল কোন বিজনেসম্যান এর জীবনী জানতে চাই, দেখবেন তারা সাকসেসফুল হয়েছে অনেক পরে। অন্তত ৪০/৪৫/৫০ বছর বয়সে। তাইলে তারা কি তত দিন বিয়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন?

আমাদের পিতামাতা, সমাজ, আত্মীয় স্বজন সবাই সব কিছু ইসলাম অনুয়ায়ী করেন। শুধু এই একটা বিষয়ে উনারা ইসলাম মানেন না। সেটা হলো বিয়ে। পাত্র ভালো জব করে না দেখে উনারা বিয়ে দেন না। আর সমাজ বলে আগে প্রতিষ্ঠিত হউ তার পর বিয়ে করো!

অথচ মানবজাতির পথপ্রদর্শক মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আমাদের বলছে, আগে বিয়ে করো,গরীব হলে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আল্লাহ্‌র। -(সূরা নূর)।

লেখকঃ প্রবাসী সাংবাদিক 

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ