প্রযুক্তির অপব্যবহারের ক্ষতি নিরসনের উপায়


প্রযুক্তি কাকে বলে, ডিজিটাল প্রযুক্তি বলা হয়, শুন্যথেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগের প্রক্রিয়া সম্পন্নকরণের কৌশলকেই আভিধানিক অর্থে ডিজিটাল প্রযুক্তি বলে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।এমনকি বাংলাদেশেও। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সব কাজ সহজেই করা যায়-শুরুতে এমনটিই বলা ও ভাবা হয়েছিল। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, বিভিন্ন অ্যাপলিকেশন সফটওয়্যার, বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও অ্যাপস, ইত্যাদিকে আমরা দ্রুত যোগাযোগের অন্যতম বাহন হিসেবে গণ্য করতে পারি। মোট কথা, তথ্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কাজ করা যায়। এজন্যই ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তির প্রতি মানুষের এত মনযোগ বা আকর্ষণ।

দেশে অব্যাহত ভাবে চলছে নির্বিচারে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার। বিশেষত মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক ও হিন্দি চ্যানেলের অপব্যবহার। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর অন্যান্য মাধ্যমের ভয়ানক আগ্রাসন তো আছেই! দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠী ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তির আসক্তির মধ্যে রয়েছে। ফলে দেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এসেছে বৈপ্লবিক নেতিবাচক পরিবর্তন। আর এর মূল ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশু, কিশোর, যুবকসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।

অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবে এখন রূপক অর্থে বাজার হচ্ছে ধর্ম , বাজার স্বর্গ। সেই বাজারের নিয়ন্ত্রকেরা স্বল্প সময়ে মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতায় আমাদের মত নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশকে ‘টার্গেট মার্কেট’ ধরে তাদের প্রযুক্তির পণ্য-সেবা সমূহের আগ্রাসী বিপণন কার্যক্রম চালাচ্ছে আমাদের এখানে।

এখন কেনই বা আজ আমদের দেশের মানুষেরা কাজ-কর্ম ছেড়ে দিয়ে মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ইন্টারনেট সহ বিভিন্ন অ্যাপস ও প্রোগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার কার্যকর কারণগুলোর দিকে নজর দিব আমরা।

সাধারণভাবে অবসর সময় কাটানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন প্রোগ্রামমুখী হয়। অনেকে আবার জীবনের অস্তিত্ববাদী সংকটের কারণেও প্রোগ্রামমুখী হয়। আমাদের সমাজের মানুষের ভয়ানক ডিজিটাল প্রোগ্রাম আসক্তির অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হলো-হৃদয় মাঝে অতিমাত্রায় অমানবিকতার উপস্থিতি, অসামজিকতা, মানসিক বৈকল্য, বেকারত্ব, কু-সামাজিকীকরণ, এটাকে ফ্যাশন হিসেবে নেওয়া, সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, সামাজিকীকরণের মাধ্যমসমূহ প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া, সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, মাঠ-পার্কের অভাব হেতু খেলাধুলার প্রতি অনীহা, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব, যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি, জীবনে প্রকৃত ধর্ম চর্চার অভাব ও উক্ত শিক্ষা বাস্তবায়নের অভাব, নিঃসঙ্গতা, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন, আদব শিক্ষার অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ইত্যাদি। মোট কথা সুষ্ঠু সামাজিক বিকাশের জন্য সর্বপর্যায়ে আদর্শমান কৃষ্টি-কালচারের অভাব। ফলতঃ বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার, পর্নগ্রাফি, ডিজিটাল প্রযুক্তির নানান রকমের খারাপ প্রোগ্রাম মানুষের মনোজগতকে গ্রাস করার প্রয়াস পাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এগুলোর প্রচার ও প্রসারে সেন্সর করা উচিত।

মানুষ বড় বিচিত্র জীব। আরো বিচিত্র তাঁর চিন্তা জগৎ ও মানুষের আচরণ। আমাদেরকে বুঝতে হবে, কম্পিউটার-ফেসবুক-ইন্টারনেট চালাতে পারলেই মানুষ মহাপুরুষ হয়ে যায় না। অন্যদিকে মানুষের আত্মার চাহিদা ও সমাজ বাস্তবতা আমরা একদম ভুলে গেছি। একথাও মনে রাখতে হবে, উন্নতির চরম শিখরে পৌছালেও সেখানে মূল্যবোধ, মানবিকতা না থাকলে তা (সে সভ্যতা) অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে অভিবাবকদের সম্পদের পিছনে না ছুটে সন্তানকে সময় দিতে হবে। কারণ, অতি প্রিয়জনের মমতার স্পর্শ অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে বেচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। আমাদের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সঙ্গী ও সুযোগের অভাব রয়েছে।

সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বাবা-মাদের। বাবা-মায়েদের বুঝতে হবে ভিনদেশী কালচার-ভাষা শেখার জন্য নিজস্ব সংস্কৃতিকে-ভাষাকে ভুলিয়ে দেবার দরকার নেই। এটা বাচ্চাদের নয়, বাবা-মা আর কিছু শিক্ষকদের দোষ। প্রয়োজনে ভিনদেশী আকাশ-সংস্কৃতির (খারাপ) অবাধ প্রবাহ এখনই বন্ধ করতে হবে। তবে তাদের ভালো গুণ গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকের অপব্যবহারও রোধ করতে হবে-যা অপরাধ প্রবণতার জন্য অনেকাংশেই দায়ী। মোট কথা আমরা আধুনিক হচ্ছি, উন্নত হচ্ছি ঠিকই-কিন্তু একই সঙ্গে পুরানো ঐতিহ্য , ভালোবাসা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধগুলো হারিয়ে ফেলছি। একই সঙ্গে উন্নয়ন, আধুনিকতা, পুরানো ঐতিহ্য হাত ধরাধরি করে থাকবে, যেখানে সবাই থাকবে সুরক্ষিত-তবেই সমাজ হবে শান্তিময়। আমাদের মাথাকে (মস্তিষ্কে) সৎ ভাবনায় পরিপূর্ণ করলে মানুষ চিন্তা চেতনায় সৎ, যোগ্য ও নির্ভীক হবে-লোপ পাবে বিকৃত রুচি, বিকলাঙ্গবাধীদের সংখ্যা যারা কিনা সহিংস হয়।

মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। শিশুদেরকেও নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে সবার আগে। প্রথম বা আদি প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকেই তাদেরকে আদব শিক্ষা দিতে হবে। বর্তমানে এসবের কিছুই নেই প্রায় পরিবারে। শিশুদের জন্য অবারিত সুষ্ঠু বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে তারা ভিনদেশি কালচারের দিকে অতিমাত্রায় ধাবিত না হয়। আমাদের দেশে পাশ্চাতের আগডুম-বাগডুম অহেতুক অনেক সিলেবাস শেখানো হয়, শেখানো হয় না নৈতিকতা-মানবিকতা, আদব কায়দা-যা বড়ই পরিতাপের বিষয় দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের ‘গোড়াতেই গলদ’। শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষায় অমূল পরিবর্তন এনে, চরিত্র গঠনোপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে সর্বত্র। তাহলেই সৎ মানুষ গড়ে উঠবে সমাজে।যারা হবে অসহিষ্ণু-সংস্কৃতিমনা-দেশপ্রেমিক। যারা লিপ্ত থাকবে না কোনরূপ সহিংসতায়। সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে বুদ্ধি আর বিবেচনায় ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হবে সবাইকে। আমরা খুব সংস্কৃতিমনা, ইতিহাস সচেতন সমাজমনষ্ক-দর্শনপ্রীত, রাজনৈতিক সচেতন জাতি নই; খুব মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল, সামাজিক কৃষ্টি-ঐতিহ্য অবহেলায় নষ্ট করে ফেলি। এর সুযোগে আমাদের সামাজিক শত্রুরা প্রকরান্তরে দেশের শত্রুরা তো আর বসে নেই! পশ্চিমা অপসংস্কৃতির মাধ্যমে তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঠিকই চালাচ্ছে। সংস্কৃতিক প্রবাহ তো আর বাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। শুধু নীতিমালা আর ক্ষমতার জোরে বিশ্বায়নের অবাধ সাংস্কৃতিকে আটকে রাখা কঠিন। একমাত্র দেশপ্রেম ও মানসম্পন্ন-যুগোপযোগী প্রোগ্রাম দিয়েই তা মোকাবেলা করতে হবে। সাংস্কৃতিক প্রবাহকে ইতিবাচক ধারায় সঞ্চারিত করে দিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।

দেশের প্রকৃত সংস্কৃতি ধারণ করার জন্য দ্বীনি শিক্ষা সভ্যতা-ইতিহাস-দর্শন-সমাজবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়বলীর চর্চা বাড়াতে হবে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহারে আজকাল পরকীয়া, পড়ালেখায় অমনোযোগীতা, অসহিষ্ণুতাসহ , অসমপ্রেমের জোয়ারে ভেসেছে সমাজ। যা সকল প্রকার সহিংসতার অন্যতম কারণ। সর্বত্র এখন চলছে পরকীয়া প্রেম সহিংসতা, তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক ডিজিটাল দুর্নীতিই মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে। আর সমাজে এ ধারার অপ্রতিরোধ্য উত্থানের ফলে-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে সর্বত্র বাজছে ভাঙ্গনের সুর। যা প্রকারান্তরে সহিংসতা, ভংগুর পরিবারে রূপ নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সমাজে কদর বাড়ছে পাপারাজিদের, বিকলাঙ্গবাদীদের। শিথিল হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। মানুষের মাঝে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে সভ্যতাই আজ হুমকির মুখে পড়েছে। তবে এর প্রধান শিকার হচ্ছে প্রায় পুরো মানব সমাজ। দিন দিন যেন সবাই আরও নতুন উদ্যোমে ধরা দিচ্ছে-পরকীয়া, সাইবার অপরাধের মায়াজালে। এখন শহুরে-গ্রাম্য বধূর পরকীয়া প্রেম, বিয়ে ও সাইবার অপরাধের ঘটনায় আইনি লড়াই হচ্ছে সর্বত্র। এক জনের বধূ বা স্বামী র্দীর্ঘদিন ঘর সংসার করার পর স্বামী বা স্ত্রীকে ছেড়ে প্রেমিক বা অবৈধ প্রেয়সীকে বিয়ের ঘটনায় বাংলার প্রায় এলাকাতেই আজ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে অরাজকতায় রূপ নিচ্ছে। এই চাঞ্চল্য, অরাজকতা আজ দেখা দিয়েছে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে। এ ধারায় আর ভাটা পড়বে বলে মনে হয় না। সবদিক বিবেচনা করে বলা যায় যে, সমাজ পরিবার এখন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক অপরাধ , পরকীয়া, অসম প্রেমের দিকে ঝুঁকছে বেশ জোরে শোরেই।

সুপ্রিয় শ্রোতা মন্ডলী!! এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অথচ লেখা পড়ার সোনালি সময় হেলায় পার করে দিচ্ছে বর্তমান ছাত্র সমাজ। সুতরাং টিভি নয়, কম্পিউটার নয়, ইন্টারনেট নয়, ফেসবুক নয়, মোবাইল নয়, ব্যস্ততার ভ্যানিটি নয়; বরং আপনার সন্তানটিকে পড়ার অভ্যাস গড়তে সাহায্য করুন। রাজনীতিবীদসহ বিনিয়োগকারীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করছি-দেশ গড়তে হলে ভালো মানুষ গড়ার উদ্দেশ্যে আগে আগে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন। আমি বলি, যে দুঃখ-দৈন্যের বাংলাদেশে আজ আমরা বাস করছি, মানসম্মত, নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক ন্যায় বিচার আমাদের সেই দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটাতে পারে। কারণ অজ্ঞতা থাকা আর অন্ধকারে থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অতএব, এখনই সময়-জেগে উঠার- “ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহারে বিরুদ্ধে”। পরিশেষে আমি বলতে চাই একটি নৌকা চলার জন্য যেমন পানির প্রয়োজন কিন্তু সেই পানি থাকতে হবে নৌকার নিচে যদি সেই প্রয়োজনীয় পানি টি নৌকার উপর উঠে আসে তাহলে যেমন নৌকা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা তেমনি নৌকার যাত্রীর প্রাণনাশের আশঙ্কাও রয়েছে।ঠিক তেমনি ভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের জন্য প্রয়োজন কিন্তু তা প্রয়োজনমাফিক ই থাকবে তাকে পানির মত নিচে থাকতে হবে যদি তা উপরে উঠে আসে তাহলে এর ধারা আমাদের ঈমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সুতরাং আমাদের করনীয় হল সর্বক্ষেত্রে মহান রাব্বুল আলামিন কে ভয় করা এবং কোরআনের আয়াত কে স্মরণ রাখা।يا ايها الذين امنوا اتقوالله حق تقاته ولا تموتن إلا وانتم مسلمون……… হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে ভয় করো এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।সুতরাং আমাদের করনীয় হল সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা এবং প্রযুক্তির এই অপব্যবহার থেকে নিজের পরিবার সমাজ এবং বন্ধুবান্ধব সকলকে বিরত রাখা।

السلام عليكم ورحمة الله

লেখকঃ
দারুল হাদীস (এম.এ,ইসলামিক স্টাডিস)
জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ