ব্রেক্সিটের ‘এক্সিট’ যাত্রায় কী ঘটলো, কেন ঘটলো?


ব্রিটেনের স্কুলে, হাসপাতালে গত এক দশক ধরেই আসন সংকটের তীব্রতা। অথচ এ সময়কালে ব্রিটেনে বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের মতো নন-ইইউ দেশগুলো থেকে অভিবাসন কমেছে কমপক্ষে অতীতের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ। তারপরও আবাসন থেকে পরিবহন কোথাও সিট খালি নেই। এর মূল কারণ ইউরোপ থেকে জীবিকার আশায় ব্রিটেনে পাড়ি জমানো লাখো মানুষের ভিড়। দেশে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা আর বেকারত্বে বিপর্যস্ত ইউরোপিয়ান নাগরিকদের সহজ টার্গেট হয়ে উঠলো ব্রিটেন। ইউরোপের কিছু দেশ থেকে মানুষজন ব্রিটেনে হাজারে হাজারে ছুটলেন সন্তানদের চাইল্ড বেনিফিট সহ বিভিন্ন সরকারি সুবিধা নেওয়ার আশায়। অন‌্যদিকে আলস্যে জগৎ বিখ‌্যাত শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের একটা অংশ এমনিতেই বছরের পর বছর বেকার থাকতে অভ‌্যস্ত। লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার সরকার ২০০৭ সালে বিদায় নিলো। ব্রিটেন অর্থনৈতিক মন্দা ও বিপর্যয়ের মুখে পড়লো। গত ১৩ বছর ধরে ব্রিটেনের ক্ষমতায় ডানপন্থী কনজারভেটিভ সরকার। কনজারভেটিভের আমলে দফায় দফায় বেনিফিট কাট হলো, কর্মহীন বেকার মানুষকে কাজে ফেরাতে প্রশিক্ষণ, পোশাক, প্রণোদনা সহ নানা সমন্বিত উদ্যোগ নিলো সরকার। বাধ‌্য হয়ে কাজে গিয়ে ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের একটা অংশ দেখলো, কারওয়াশ থেকে শুরু করে সেলসম‌্যান বা ওয়েটারের মতো ব্রিটেনের লো-পেইড ও কম দক্ষতাসম্পন্ন চাকরিগুলোর সিংহভাগই ইউরোপ থেকে আসা কর্মীদের দখলে। অবশ‌্য এ কাজগুলো ব্রিটেনে দেশ থেকে আসা বাংলাদেশি তথা এশিয়ান মানুষজনেরও মূল কাজ। এ সেক্টরগুলো মূলত চলে যাচ্ছিল ইউরোপ থেকে আসা কর্মঠ শ্রমিকদের হাতে। তখন থেকেই শুরু ব্রিটেনে ইউরোপিয়ান বিরোধী একটি জন মনস্তত্ত্বের।

পাঠক, খেয়াল করলে দেখবেন, ঠিক সে সময়েই, অর্থাৎ ২০১৪ বা ২০১৫ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে ডানপন্থী দলগুলো দেশে দেশে অভিবাসী ঠেকানোর স্লোগান নিয়ে মাঠে নামে। নাইজেল ফারাজের মতো উগ্র দক্ষিণপন্থী ও অভিবাসন বিদ্বেষী ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা ব্রিটেনে অভিবাসী ঠেকাবার স্লোগান নিয়ে দল গড়েন, মাঠে নামেন। তারাই দাবি তোলে ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার। ২০১৬ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তখন ডেভিড ক‌্যামেরন। ক‌্যামেরনকে ব্রিটেনের অন‌্যতম সফল প্রধানমন্ত্রী মনে করা হয়। কনজারভেটিভ পার্টি মূলত শ্বেতাঙ্গ ও আদি ব্রিটিশ মানুষের দল। দলটি দেখল, কনজারভেটিভের সমর্থকরাই এ ইস‌্যুতে অনেকে নাইজেলকে সমর্থন দিচ্ছেন, বিপরীতে লেবার পার্টি ভঙ্গুর অবস্থানে। ২০১৬ সালে পরিস্থিতি এমন দাড়াঁলো, ব্রিটেনের ডাক্তারখানাগুলোতে ইউরোপিয়ান নাগরিকরা প্রতি মিনিটে একজন করে রেজিস্ট্রেশন করছেন। ইইউ নাগরিকদের ব্রিটেনে চলমান হারে ঘরের চাহিদা বিদ্যমান থাকলে ব্রিটেনকে প্রতি চার মিনিটে নির্মাণ করতে হবে একটি বাসস্থান। এমন অসম্ভব বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রিটেনের ইউরোপে থাকা না থাকার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হলো ২০১৬ সালের ২৩ জুন। সঙ্গত কারণেই জনমত নিজেদের পক্ষে টানতে ডেভিড ক‌্যামেরন আর কনজারভেটিভ পার্টি ব্রেক্সিটের ট্রাম কার্ডটি খেলবার জন‌্য সময়টিকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন। ভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষেই ব্রিটিশ জনগণ রায় দিলেন। জনগণের হতাশামাখা প্রবল এক জাতীয়তাবাদ ব্রেক্সিট বিভক্তির মূল স্লোগান হয়ে দাঁড়ালো। মোটামুটি এটুকু হলো ব্রেক্সিটের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ জনমত গড়বার শুরুর ঘটনা প্রবাহ।

দুই.
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরেই পড়তির ধারায়। ইতালির মতো দেশ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর ক্ষমতাসীন শীর্ষ রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে বহুদিন ধরেই। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের অভ্যুদয় ১৭০৭ সালের পহেলা মে। আর দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামের রাষ্ট্র সংঘে যোগ দেয় ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আগে ২৬৬ বছর ব্রিটেন স্বাধীন ও এককভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পর ৪৭ বছর হয়েছে। যে বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল ব্রিটেন, তার অনেকখানিই এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। আর ব্রিটেন ইউরোপে বিগত বছরগুলোতে থাকলেও ইউরোপে ব্রিটেন তার মুদ্রা ও ভিসার নিজস্বতা নিয়েই টিকে ছিল। তারপরও, ব্রিটেনের এক তৃতীয়াংশের বেশি নাগরিক মনে করতেন, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এককভাবে পথ চলতে পারবে না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিকদের জন‌্য এটি ছিল নিতান্তই গ্লানিকর।
১৯৭৫ সালে ব্রিটেনের ইউরোপে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে অনুষ্ঠেয় ভোটের প্রাক্কালে প্রচারিত লিফলেটে ব্রিটেনের মানুষকে আহ্বান জানানো হয়েছিল, ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে কমন মার্কেটে জয়েন করার। তখন এর নাম ছিল ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি। আর এখন কেবল নাম পাল্টে সেটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নই হয়নি। ইউরোপ নেতাদের অনেকের পরবর্তীতে খায়েশ হয় ইইউভুক্ত দেশগুলো নিয়ে অভিন্ন দেশ গড়ার। অভিন্ন দেশ হিসেবে পার্লামেন্ট, সুপ্রিম কোর্ট, পতাকা, জাতীয় সংগীত, প্রেসিডেন্ট, ফরেন মিনিস্টার; সবই হয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। অথচ এর বিপরীতে ব্রিটেন তার আপন স্বকীয়তা আর অনেক ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতাও হারায় ইউরোপের কাছে। কার্যত, শেষদিকে ইউরোপের সুবিধা নিয়েছে অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র সদস্য দেশগুলো। যার জন্য চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছিল অর্থনৈতিকভাবে আগের অবস্থানে না থাকা ব্রিটেনকে।
ব্রিটেন ইউরোপে থাকবে কিনা, এই ইস্যুতে রেফারেন্ডাম সহ তিন দফা ভোট দেয় ব্রিটিশ জনগণ। তিনবারেই ব্রিটিশ জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে রায় দিলেও ব্রিটেনের এমপিরা সে রায় বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ান।

তিন.
২০১৬ থেকে ২০২০। এ চার বছর জুড়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় একক ইস‌্যু ছিল ব্রেক্সিট। এই ব্রেক্সিটের জন‌্য ডেভিড ক‌্যামেরনের পর থেরেসা মে; দুজন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা ছেড়ে বিদায় নিতে হয়েছে। মন্ত্রীরা পদত‌্যাগ করেছেন, এমপিরা দল ছেড়েছেন।
২০১৯ সালের নির্বাচনে বরিস জনসনের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন। ব্রিটেনের জনগণ চাইছিলেন, বিষয়টির নিষ্পত্তি হোক। করোনা ঝড়ে লন্ডভন্ড এখন পুরো ব্রিটেন। ২০২০ সালের শেষার্ধে এসে খোদ কনজারভেটিভ পার্টির অনেক নেতাকর্মীই বিশ্বাস করতে পারেননি, চুক্তিসহ ব্রেক্সিট হচ্ছে। কেননা, খোদ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনই চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট হওয়ার সম্ভাবনার কথাই বলছিলেন বারবার। তারপরও ২৪ ডিসেম্বর চুক্তিসহ ব্রেক্সিট সম্পন্ন হয়েছে। করোনার নতুন ধরনের সংক্রমণে ব্রিটেন এখন আক্ষরিক অর্থেই বিপর্যস্ত। চাকরি হারিয়ে বেকার লাখ লাখ মানুষ। অর্থনীতি বিপর্যস্ত। করোনাভাইরাস বিশ্বের মধ্যে ব্রিটেনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়াবহতম রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার আক্রান্তের সংখ‌্যা। হাজারো প্রাণের মৃত‌্যুর মিছিল রোজ। নতুন ধরনের করোনার উপসর্গ দেশটিতে ধরা পড়ার পর পরিস্থিতি এই মুহূর্তে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলো পূর্ণ করোনা রোগীর ভিড়ে। বহু হাসপাতাল চিকিৎসাসেবা বাতিল করেছে। সরকার, জনসাধারণ সবার মধ্যেই এক ধরনের প্রবল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের প্রায় সব দেশ ব্রিটেনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। এরমধ্যেই বড়দিনের আগের বিকেলে চুক্তিসহ ব্রেক্সিট নিষ্পত্তি হওয়ার খবর ব্রিটিশ জনগণকে কিছুটা হলেও স্বস্তির বড়দিন উপহার দিয়েছে। দীর্ঘ চার বছরের ঝুলে থাকা বিষয়টি সম্পন্ন হওয়ায় ব্রিটেনের মানুষ খুশি, দল মত নির্বিশেষেই। ইউরোপের সঙ্গে বরিসের দরকষাকষির কৌশলে তার ভোটাররাও খুশি।

চার.
ব্রেক্সিটের পুরো চুক্তির পুরোপুরি এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। যতটুকু এসেছে, তার মধ্যে ব্রিটেনের সীমান্তে ইউরোপের মাছ ধরা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে এক ধরনের সমতা, ভ্রমণ, অর্থনৈতিক সেবা, পণ্য মান ও পেশাগত সেবার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বিষয়ই একটি সময়ক্রম উল্লেখ করে পর্যালোচনাযোগ‌্য রাখা হয়েছে। যা ব্রিটেনের জন‌্য প্রায় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক। কিন্তু ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস ব্রিটেন সহ পুরো ইউরোপে বিশেষত মানবাধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু এখন আর ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে সে আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। আর একটি বিষয় হলো, ব্রিটেন ইউরোপের অপরাধ তালিকা, ফিঙ্গার প্রিন্ট সহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যে ইইউ তথ‌্য ব‌্যবহার করতে পারতো, তার বেশিরভাগই এখন আর ব্রিটেন ব‌্যবহার করতে পারবে না।

পাঁচ.
ব্রিটেন ইউরোপ ছেড়ে আসুক এটা তিন দফায় ব‌্যালটের মাধ‌্যমে জানান দিয়েছেন ব্রিটিশ জনগণ। এ কারণে ব্রেক্সিট আক্ষরিক অর্থেই জনরায়, কোনও দলীয় বা সরকারি সিদ্ধান্ত নয়। আর ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের পর ব্রিটেন সাময়িকভাবে আর্থিক মন্দায় পড়বে, সেটি গত চার বছর ধরেই আলোচনা চলছে। সে লক্ষ‌্যে ব্রিটেন প্রস্তুতি নিয়েছে, এমনটি বলেছেন সরকারের দায়িত্বশীলরাও। আর যে কোনও সুস্থ‌ অর্থনীতিতে অন্তত দশ বছরে একটি মন্দা সুস্থ অর্থনীতির নিয়ামক। আর ব্রিটেন ২০০৮ সালের পর চলতি দশকে ২০১৯ পর্যন্ত কোনও মন্দার মুখে পড়েনি। সে হিসেবে একটি মন্দার সম্ভাব‌্যতা অনেক আগে থেকেই ছিল। আর ২০২০ সালে ব্রেক্সিট চূড়ান্ত বাস্তবায়নের আগে ব্রিটেন আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ে। তবে সেটি ব্রেক্সিট নয়, করোনার কারণে। তারপরও গত বৃহস্পতিবার ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের চূড়ান্ত ঘোষণার আগেই ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম দশমিক দুই শতাংশ বাড়ে। অক্সফোর্ডের করোনা টিকা ব্রিটেনে অনুমোদন পাওয়ার পর করোনা পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে, এ প্রত‌্যাশা অনেকেরই।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ব্রিটেনের মূল সমস‌্যা ছিল ব্রেক্সিট, তারপর করোনা। একটি ইস‌্যু আপাত নিষ্পন্ন হওয়া নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ জনগণের জন‌্য সুসংবাদ।

লেখক:  সাধারণ সম্পাদক, ইউকে বাংলা প্রেস ক্লাব।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ