গ্রাম্য সালিশ ও মোড়লীপনা!

কেউ বলে মুরব্বি, কেউ বলে মোড়ল আর আমি বলি গ্রাম্য কীট। তবে সকল মুরব্বী বা মোড়ল এই কথাটির অন্তর্ভূক্ত নয়। পাঠকরা বুঝে গেছেন হয়তো লেখাটি কাদের নিয়ে লেখা। গ্রাম্য সালিশগুলোতে মোড়লদের অভাব হয় না। সালিশে এই মোড়লারা কেহ টাকার বিনিময়ে, কেহ আত্নীয়দের রক্ষা করতে আবার কেহ মোড়লগিরি দেখাতে আসেন।

“দেশের প্রতিটি গ্রামে পঞ্চায়েত কমিটি রয়েছে। পঞ্চায়েত কমিটি গ্রামের সালিশ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে এই পঞ্চায়েত কমিটি। ইদানিং পঞ্চায়েত কমিটির বিরোদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই।”

অভিযোগের পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিটি পঞ্চায়েত কমিটিতে রাজনৈতিক বিবেচনা, টাকার গরম, গোষ্ঠির প্রভাব যাদের আছে তাদেরকেই কমিটির সদস্য করা হয়। এই কমিটিতে অন্তভূক্ত হয়ে নেতারা দলীয় এজেন্ডা, টাকার গরমওয়ালারা টাকার গরম দেখান আর গোষ্ঠিওয়ালারা গোষ্ঠির প্রভাব প্রতিপত্তি দেখান। পঞ্চায়েত কমিটিতে আবার নোংরা রাজনীতি আছে। তবে অধিকাংশ সালিশ রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়ে থাকে। আর সালিশ না মানলে হতে হয় চরম লাঞ্চিত, অবহেলিত, হিংসা ও বঞ্চনার শিকার।

তেমনি মোড়লীপনার শিকার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের কোরবানপুর গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবার। গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, জায়গা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজল আহমদ ও পাখি মিয়ার পরিবারের মধ্যে বিরোধ চলছিল। বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষ স্থানীয় সালিশকারী ও পঞ্চায়েত কমিটি সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে গেলে তারা উভয়পক্ষের কাছ থেকে জামানত নিয়ে সালিশ বসে রায় দেন। সালিশে একটি পক্ষ এই রায় মেনে নিতে পারেনি। রায় না মেনে আদালতে মামলা করায় কাজল আহমদের পরিবারকে গ্রাম থেকে সমাজচ্যুত করে পঞ্চায়েত কমিটি।

একজন ব্যক্তির কাছে বিচার গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তার কাছে যদি মনে হয় সে ন্যায় বিচার পায়নি। তাহলে সে আদালত বা ন্যায় বিচার পাবার জন্য যে কারো কাছে যেতে পারে। এখানে দোষের কিছু নেই।

শুনলাম এটিতেই শেষ নয়। সালিশকারীগণ এলাকার লোকদেরকে সমাজচ্যুত পরিবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে না যাবার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ দেয়। যারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাবে তাদেরও পরিণতি ঐ পরিবারের মতো হবে বলে ঘোষণা দেয় তারা। এরপর থেকে কেল্লা ফতে। এই নিষেধের ফলে সমাজচ্যুত পরিবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কয়েক লক্ষ বকেয়া টাকা আদায় সম্ভব হচ্ছেনা। এমনকি শিশু-সন্তানরা মসজিদে গিয়ে কুরআন শিক্ষা নিতে পারছে না।

যাইহোক সমাজচ্যুত করার কারণে ঐ পরিবারটি একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করে গ্রাম্য পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নজরুল মিয়া সহ আরও ৫জনের নামোল্লেখ করে। এটিতো ভালোভাবে নেয়নি পঞ্চায়েত কমিটি বরং আরও উল্টো তাদেরকে গ্রাম থেকে ৫ বছরের জন্য সমাজচ্যুত করে।

কাজল আহমদের পরিবার সমাজচ্যুত হয়েছে যে তা নয়। এখানে একেক সময় একেক পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয় তুচ্ছ কারণে। এখনো বেশ কয়েকটি পরিবার কোরবানপুর এলাকায় সমাজচ্যুত আছে। আবার রাজিৈনতক মোড়লদের কাছে ক্ষমা চাইলে সমাজচ্যুত পরিবারকে সমাজে অন্তভূক্ত করা হয়। এরকম ঘটনা জেলার সবকটি উপজেলায় কমবেশী হয়েছে।

গণমাধ্যমের বরাতে আরও জানা যায়, পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি প্রভাবশালী লোক হওয়ায় তার বিরোদ্ধে এলাকায় কেউ কথা বলতে চায় না। সভাপতির বিরোদ্ধে কেউ গেলে হতে হয় সমাজচ্যুত। ঐ ইউনিয়নের মেম্বার, চেয়ারম্যান পঞ্চায়েত কমিটির কাছে অসহায়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি জেনে গণমাধ্যমকে বলেছেন, সভ্য সমাজে এরকম সমাজচ্যুতের ঘটনা ঘটতে পারে না। এবং আইন অনুযায়ী সমাজচ্যুত করার কোন বিধান নেই। এবং তিনি সরেজমিন তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।

পরিশেষে বলতে চাই, রাজনৈতিক কীটদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে পঞ্চায়েত কমিটিকে? যাতে এধরণের কোন সমাজচ্যুতের ঘটনা ঘটতে না পারে অন্যায়ভাবে। আর প্রশাসনের কাছে দাবি জানাবো পঞ্চায়েত কমিটির মানবাধিকার লঙ্গনের জন্য ঐ কমিটিকে জবাবদিহির পাশাপাশি শাস্তির মুখোমখি করতে হবে। এরকম অন্যায় যাতে আর কোন পরিবারের সাথে না হয়। শুধু কোরবানপুর গ্রাম নয় দেশের যেকোন এলাকায় এরকম ঘটনা ঘটলে প্রশাসন সঠিক ব্যবস্থা নেবে। সেই কামনাই করি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ