লন্ডন-তারেক-জামায়াত তত্ত্বের গাজুড়ে গল্প!
যারা আল আজিরার রির্পোটের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ কোন ধরনের সাংবাদিকতা; এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের বলছি, দেশে দেশে রির্পোটিংগের ষ্টাইল,ঘটনার বলবার ব্যাপ্তি ও ভঙ্গিতে পার্থক্য থাকে। ব্রিটেনে বিবিসি স্কাই সহ সবাই এক ধরনের গল্প বলবার ভঙ্গিতে বিশেষ রিপোর্টগুলো করে। তাদের প্রতিবেদনে অনেক অপ্রয়োজনীয় ফুটেজ দৈর্ঘ্য বাড়বার মানে এই প্রমান করে না যে, তার প্রতিবেদনের তথ্য অসত্য।
দুরে নয়, পাশের দেশ ভারতের আনন্দবাজার আর আমাদের প্রথম আলোতেও রির্পোটিংগের ধরন,শব্দ চয়ন,খবরটি পাঠককে জানাবার ধরনটা আলাদা।
দুই.
বিএনপির অনেকে আল জাজিরার এই রির্পোটে বেজায় খুশি। যেন, ক্ষমতায় আল জাজিরার রির্পোট প্রায় বসিয়েই দিয়েছে, এমন উত্তাপ ষ্টাটাসে,কমেন্ট। অনেকে রির্পোটটির জন্য তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ইঙ্গিতে ক্রেডিট দিচ্ছেন। আওয়ামীলীগের,সরকারের দালাল বুদ্বিব্যাবসায়ী লোকজনও তারেক রহমান এ রির্পোটের পেছনে, এমনটা বলছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মধ্য রাতের প্রেস রিলিজেও লন্ডনের ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আছে।
লন্ডনে আমি যতদিন ধরে আছি,রাজধানী শহরের সাউথইষ্টে থাকি। ততদিন ধরে তারেক রহমান সাহেব থাকেন কাছের কিংসষ্টনে। আমার ঘর থেকে গুনে ২৭ মিনিটের পথ তার ঘর ও পাশের কিংসষ্টন লজে উনার দরবার। এ লজের লবিতে বসে তিনি সাক্ষাত দেন,নেতাকর্মীদের মধ্যে যে কজনের যতক্ষন এক্সেস থাকে,তিনি তাদের নিজেদের মধ্যকার কামড়া-কামড়ির নালিশ ধৈর্য্য নিয়ে শুনেন। সংবাদকর্মী হিসেবে খবর এবং খবরের বাইরেও উনাকে চিনি। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্টানে দেখা হয়। আজ একযুগ উনি এদেশে একযুগ থাকেন। তবুও আজ পর্যন্ত ব্রিটেনের কোন প্রভাবশালী মন্ত্রী দুরে থাক,অপরিচিত মন্ত্রী নিদেনপক্ষে হাউস অব লর্ডসের কোন প্রবীন সদস্যের সাথে তারেক রহমান সাক্ষাত করছেন,এরকম একটা ছবি কেউ দেখাতে পারবে না। নিজের মায়ের,বার বারের প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ কারাবরনের সময়েও তিনি একজনও ব্রিটিশ এমপি, মন্ত্রী বা তৃতীয় শ্রেনীর রাজনৈতিক কোন দলের কাছ থেকে নুন্যতম একটা বিবৃতি এনেও দিতে পারেন নি। উনার স্বীকৃত,ঘোষিত উপদেষ্টাদের মধ্যে আছেন ঢাকার ফুলবাড়িয়া মার্কেটের সাবেক জুতার দোকানদার,লন্ডনে ওয়ার্ড কাউন্সিলার নির্বাচন করে হারা মানুষজন।
যাইহোক ব্রিটেনের কোন মুলধারার গনমাধ্যমে কোনদিন তারেক রহমানের একটা সাক্ষাতকারও কোনদিন ছাপাতে পারেন নি তার উপদেষ্টারা। আমি নিজে কয়েকবার চাইলেও তারেক রহমান প্রকাশের জন্য কোন সাক্ষাতকার দিতে রাজি হন নি। তিনি বলেছেন, বাংলা মিডিয়াকে তিনি এদেশে আসার পর কোন সাক্ষাতকার দেননি। দিলে আমাকে দেবেন। না দিলেও, এটা তার বিনয়। যখন বলেছিলাম, তখন সংবাদপত্রে তারেক বক্তব্য প্রকাশে উচ্চ আদালতের বাঁধা ধরা নির্দেশনা ছিল না। আমার করা সব গুরুত্বপুর্ন নিউজটি বাংলা ট্রিবিউনের পর সেটা ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে ইংরেজিতে প্রকাশ হয়। পেশাদার কোন সংবাদকর্মীদের মধ্যে উনার লন্ডন জীবনে তাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি নিউজ আমিই করেছি।
আর, সেই তারেক রহমান আল জাজিয়ার সম্পাদকীয় পলিসির ভেতরে প্রভাব খাটিয়ে একেবারে সরকার বিরোধী প্রচারযুদ্বের সুতোয় একেবারে আগুন দিয়ে দিয়েছেন,এটা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
বাস্তবতা হলো লন্ডনে তারেক রহমান,বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ রেহেনার অনুসারী বিএনপি বা আওয়ামী রাজনীতির বাইরে বাংলাদেশীদের আলাদা একটা বলয় গড়ে উঠছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের এলিট শ্রেনীর বড় একটা অংশ আসা যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নীরবে লন্ডনে স্যাটেল হয়েছেন। নামে বেনামে বাড়ী ঘর কেনা, ব্যবসায় বিনিয়োগ,কোটি কোটি টাকায় ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেনা, সন্তানের লেখাপড়ার পথে তাদের মধ্যকার একটা ধারা আছে। প্রশাসনের বর্তমান সাবেক কর্মকর্তা,ব্যবসায়ীদের টাকা আনা,এখানে বিনিয়োগ ও ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এদেশে আলাদা একটা প্রভাবশালী চক্রই গড়ে উঠেছে।
এসবেরও বাইরেও দুই দল থেকে বাদ পড়া,প্রকাশ্যে ক্ষমতাহীন, দলছুট এবং ফ্রেশব্লাড কিছু মানুষজন আছে। এদের অনেকে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। মাথার উপরে ব্রিটিশ সরকারের বাড়ির ছাদ,সরকারী বেনিফিট সব আছে। নিজের থাকা চলার চিন্তা তাদের করতে হয় না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বাংলাদেশী মানুষজন আছেন। দেশের মন্ত্রী এমপিদের ছেলে মেয়েরা এদেশে চুটিয়ে নানা ব্যবসা করছেন।
এদেশে গত দশ বছরে আমার চোখের সামনে একটা নতুন বাংলাদেশী শ্রেনী গড়ে উঠেছে। এই সমাজে পদোন্নতি বঞ্চিত,বাধ্যতামুলক অবসর,শাস্তিমুলক অবসর পাওয়া কিছু সরকারী সাবেক ও সেনা কর্মকর্তারা আছেন। হিথ্রো এয়ারপোর্টে প্রথমবার নেমেই এসাইলাম চাওয়া সাংবাদিক, ডাক্তার,ডক্টরেটরা আছেন। রাজনৈতিক আক্রোশে ক্ষমতাশীন দল করেও পুঁজি হারানো ব্যবসায়ীরাও শামিল। সারাজীবন আওয়ামীলীগ করলেও লীগ যেহেতু এক যুগ ধরে সরকারে, তাই বাংলাদেশী বলে রাজনৈতিক-সামাজিক আশ্রয় পেতে হলে প্রমান করতে হয়, তিনি বিএনপি বা জামায়াতের জন্য মাঠে জেলে নির্যাতিত ছিলেন। কাজেই, জামায়াত সেজে এসাইলাম পাওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আছেন। আসল জামাত বিএনপির প্রচুর লোকজন গত দশ বছরে এদেশে পাড়ি দিয়ে সেটেল হয়েছেন নানা ভাবে। এদের মধ্যে জামায়াতের সাবেক শীর্ষ আইনজীবি ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাকের মতো পেশাজীবি মানুষজন আছেন। অতি সম্প্রতি এই ভদ্রলোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সবকিছু থেকে দুরে। জামায়াত ভেঙ্গে নতুন দলে তার সমর্থন, সমর্থক সবই ছিল। ভিপি নুরও দেশে দল ঘোষনার আগেই লন্ডনে সংগঠন করেছেন।
পড়তে,চাকুরী করতে এসে বা গান শোনাতে এসে স্থায়ী হওয়া মানুষজনের বিভিন্ন গ্রুপ আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এল্যামনাই এসোসিয়েশন লন্ডনে বহুযুগ আগ থেকে ছিল। এখন সব ব্যাচের আলাদা ফেসবুক গ্রুপ রিইউনিয়ন, মেজবান, দাওয়াত, ভ্রমনের গ্রুপ আছে। ব্রিটেনের মুলধারার লেবার, কনজারভেটিভের পাশাপাশি দেশের বিএনপি আওয়ামীলীগ লুকিয়ে করেন এরকম কিছু মানুষজন আছেন। সিলেট,চট্রগ্রামের আঞ্চলিক,পীর ভিত্তিক ধর্মভিত্তিক কিছু বলয় আছে। চট্রগ্রাম বন্দর,সিলেটের ইউরেনিয়াম,বহুজাতিক ট্রেনলাইন নিয়ে ব্যবসা করতে চাওয়া কিছু ব্যাবসায়ী গ্রুপের লবিষ্ট,পেইড ও চুক্তিভিত্তিক দালাল কাজ করছে বিভিন্ন পর্যায়ে।
এদের বাইরে, ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত ধন-যশ কামানো ব্যারিষ্টার, উকিল,ডাক্তার, টেনেটুনে চলা সাংবাদিকদের, কবি-লেখকদের টেবিল টক,নিয়মিত আড্ডার গ্রুপ আছে।
অনেক জায়গাতেই শুনি, দেশের রাজনীতি,দিনবদল নিয়ে নানা পর্যায়ের আলোচনা হয়। সবকিছুই যে আষাঢ়ে গল্পের আলোচনা সেখানে, তাও নয়।
তাদের মধ্যে সংক্ষুব্ধ কিছু মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়ার প্রানপন চেষ্টা করছেন। হাঁটাহাটি করছেন, বিভিন্ন লাইনে। এদের কারো কারো সাথে এদেশে,দেশে বিত্তবান কিছু সন্মানের জন্য নেতা হতে, দিন এলে মনোনয়ন কিনে এমপি হতে আগ্রহী মালদাররা আছেন। আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগা এমন লোকজনদের সিলেটীরা মুরগা বলে আবডালে ডাকেন।
তাদের অনেকের ব্রিটেনের মুলধারার রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক,পেশাদার পলিটিক্যাল লবিষ্ট মহলে চিকেন টিক্কা মাসালা, ভাত,মাছ মদ সহ অনেক কিছুর খাতিরে সম্পর্ক আছে। নিজের মেধায় মুগ্ধ করে ব্রিটেনের মন্ত্রী উপদেষ্টাদের বন্ধুতা পাওয়া কলকাতা এবং ঢাকার খুব অল্প কিছু দামী মানুষজন কমিউনিটিতে আছেন। তাদের অনেকে কোন ব্যাক্তিগত ফেসবুকও ব্যবহার করেন না। তাদের ফোন লন্ডনের সাউথহল থেকে দিল্লীর সাউথ ব্লকে রোমিং ছাড়াই কানেক্টেড। চায়না,সাংহাই,তুর্কি সব গ্রুপের কী পয়েন্টের মানুষজনের আর্ন্তজাতিক একটা শহর লন্ডন।
আমাদের হাইকমিশনের তথ্য,যোগাযোগ উইংগের নিয়মিত বদলি হয়ে আসা যাওয়া সরকারী চাকুরীজীবিরা এসবের বেশিরভাগই সঙ্গত কারনেই জানবার চেনবার সুযোগ হয় না। চেষ্টাও দেখি না। কাজেই লন্ডন থেকে পররাষ্ট্রের নথিতে নতুন ছকে পুরনো কেচ্ছাই লেখা থাকে ।পররাষ্ট্রের প্রেসনোটেও লেখা হয় তিনি আরো বলেন, কবি আরো বলেন দের গল্প।
কমিউনিটির প্রকাশ্য নেতৃত্ব,সিক্সটি নাইন-ফোরটি নাইন বাল..ল ডটকম নামের তামাশা টিভির তর্ক তর্ক খেলার বালখিল্যতা,এর ওর সাথে ফটো তুলবার আর ছাড়বার ফটো রাজনীতির পথে মোহ হারানো, বিরক্ত মানুষজনরাও ঠিকই আড়ালে সন্ধ্যাগুলি নিজেদের মানুষ নিয়ে বসেন। অফিস,চেম্বার ব্যবসা প্রতিষ্টানের সামনের দরোজা বন্ধ করে,দুরের পার্কিংগে গাড়ী রেখে করোনার অবসরে আড্ডার সময় ,কলেবর কেবল বেড়েছেই। এদের মধ্যে অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজে পড়ুয়া ১৫ বছর কখনো দেশে না ফিরতে পারা মানুষজন তাদের খুব ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের পতনের জন্য মরিয়া। কারন মা,বাবা বৌ ভাইয়ের সাথে তাদের দেখা করতে হয় ওমরাহতে বা ইন্ডিয়াতে গিয়ে। দেশে না ফিরতে পারায় সম্পদ,বাড়ী ঘর নিয়ে নিচ্ছে ভাই,শত্রু।
এদের সাথে আছেন, দেশে আওয়ামীলীগ,লন্ডনে বিএনপি ছদ্মবেশী কিছু সুশীল।
কাজেই লন্ডন আর ডেভিট বার্গম্যান মানেই যে কামাল হোসেন যোগ জামাত প্লাস ওমুক, আজ এখন এখানকার কমিউনিটি কিন্তু,সেই জায়গায় নেই।
তৃতীয়ত,আল জাজিরার নিউজটি কে করিয়েছে,পেছনে কারা-তাদের ষ্টোরী এত দীর্ঘ কেন এসব প্রশ্ন`র চেয়ে মুল বিষয়টি গুরুত্বপুর্ন।
সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন হল, তারা নিউজ করছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নানা দুর্নীতি,অসঙ্গতি, রাজনীতি আর আমলা তন্ত্রের নামে নানা অনাচার নিয়ে।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মধ্যরাতে তড়িঘড়ি করে দায়সারা “জামাত বিএনপির,রাজাকারের দোসর” ইত্যকার বহুল মর্দিত শব্দ ও বাক্য বোঝাই একটা লিখিত বক্তব্য আল জাজিরার নিউজে প্রকাশিত অভিযোগের যুৎসই উত্তর হতে পারে না, কোনভাবেই। যুক্তির নিরিখে।
সাংবাদিকতা,সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে সরকারের দায়িত্ব,আল জাজিরার খবর মিথ্যা হলে,সেটি জাতির কাছে প্রমান করা।
আমি লন্ডনে দীর্ঘদিন ধরেই একজন ভারতীয় মুসলমান ব্যবসায়ীর কোম্পানীতে একটা ফ্রন্টডেক্সে বসি। এখনকার মালিকদের মরহুম বাবা আমাকে কোম্পানীতে এনেছিলেন। ফেব্রুয়ারীর এক তারিখ থেকে কাজ নেই,করোনাকালীন অবসরে আছি বলা যায়। তবু গত দুদিনে কাজের জায়গার ভারতীয়,পাকিস্তানী ও ব্রিটিশ সহকর্মীদের কাছ থেকে হোয়াটসআপে পাওয়া আল জাজিরার সেই সংবাদের লিংকটি,বাংলাদেশের একজন সন্তান হিসেবে আমাকে স্থম্ভিত এবং লজ্জিত করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গনতন্ত্রহীনতার মধ্যেও দেশের প্রবাসী আয়,গার্মেন্টস,মাছ রফতানি আর উন্নয়নের এগিয়ে যাবার গল্পের আমার নির্বাচিত অংশগুলি চেতনে-অবচেতনে আমি কাজের অবসরে তাদের বলে এসেছি। আমার ভারতীয়,পাকিস্তানী সহকর্মীদের সাথে দেশ নিয়ে আলোচনায় এই প্রথমবার কোন খবরের লিংকে করে আসা লজ্জা আমাকে তুমুলভাবে অপমানিত,ক্ষুব্ধ এবং আহত করেছে।
লেখকঃ লন্ডনে কর্মরত সাংবাদিক
এশিয়াবিডি/মুবিন/কামরান