স্নাইপার


পাঁচ মাইল আগে গাড়ি থামিয়ে এক আগন্তুকের কাছ থেকে নিয়ে আমাকে দেওয়া হলো ফিশারিশ ইকুইপমেন্টের একটা ছোট বক্স। তারপর মাইল দুই এগিয়ে গিয়ে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল গাড়ি থেকে। নির্জন চা বাগান আর রাবার বাগানের ভিতর দিয়ে হেটেই পৌছিলাম এখানে। সূর্য তখন মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিমের পথে রওয়ানা দিয়েছে। লেকের দক্ষিণ পাড়ের নির্জন জঙ্গলে সর্বোত্তম জায়গাটায় এসে দাড়ালাম। বন এবং পাখি আর পতঙ্গের বিচিত্র শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই আশে পাশে। লেকের উত্তর পাড়ে একটা পিকনিক স্পট। ছুটির দিন বিকেল ছাড়া খুব কম লোক আসে এখানে।
গতকাল সন্ধ্যায় আমাকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের এক যুবকের থ্রি-আর ছবি দেওয়া হয়। নির্দেশ দেওয়া হয়- দূর থেকে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দাও। লোকটা আসন্ন ছুটির দিন সস্ত্রীক এ লেকে আসবে তাও জানিয়ে দেওয়া হল। কারণ জিজ্ঞেস করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এর জন্য আমাকে বিনিময় দেওয়া হয়। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে কাজে নেমে গেলাম।
পালানোর রাস্তাটা ঠিক করার পরেই বসলাম বাক্সটা নিয়ে। ঢালাটা খুলতেই দেখলাম- দুই টুকরো করে রাখা একটা পয়েন্ট টুটু রাইফেল। সাথে একটা উইভার ভ্যারিয়েবল্ টেলিস্কোপিক সাইট, ষোল ইঞ্চি লম্বা একটা সাইলেন্সার, ইলির হাই ভেলোসিটি লঙ রাইফেল গুলির একটা বক্স আর একটা স্ক্র ড্রাইভার।
বেশ কিছুটা সময় নিয়ে রেডি করলাম রাইফেলটা। এর মধ্যে পিকনিক স্পটে জনা দশেক পুরুষ মহিলা নিয়ে দুইটা গাড়ি এসে থামল। রাইফেলটা কাধে ঠেকিয়ে টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি দিলাম। একলাফে কাছে চলে এল প্রায় তিনশো ফুট দূরের জায়গাটা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম সবাইকে। নেই ওখানে সেই যুবক। কোনো সমস্যা নেই- সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক বাকি।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে একটা পাজেরো জীপ এসে থামল। খালি চোখে দেখে সঠিকভাবে বুঝে উঠতে না পারায় আবার টেলিস্কোপের সাহায্য নিতে হল।
ক্রস হেয়ারের কেন্দ্র বিন্দু সয়ংক্রিয়ভাবেই স্থির হল তরতাজা এক যুবকের ওপর। ছবিতে দেখা সেই মুখটা দেখে অনুভূতিহীন হয়ে গেলাম। স্বাভাবিক তরতাজা সুন্দর এক যুবক। কিন্তু অজান্তে আমার তর্জনিতে তার জীবন খেলা করছে। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ মনে আসলো- লোকটার তো একটা সংসার আছে। সে তো কোন মায়ের সন্তান, কারো স্বামী।
এমন সময় ক্রস হেয়ারটা গিয়ে পড়ল আরেকটা মুখের ওপর। এতক্ষণ মাঝে ছিল ঐ যুবকের মুখটা। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। আরিফা!!! অবশ হয়ে গেল সমস্ত শরীর। নিজের অজান্তে রাইফেলসহ হাতটা নেমে গেল নিচে। “দুপ” করে মৃদু একটা শব্দ হল। বেরিয়ে গেছে একটা গুলি হাতে ধরা রাইফেল থেকে। সংবিৎ ফিরল মুহূর্ত সময় পরে। আমার কি হয়ে গেল- ভাষায় বুঝানো সম্ভব নয়। তবে পেশাগত কারণেরই নিজেকে স্থির করতে পারলাম। দেখলাম সুভাগ্যক্রমে গুলিটা হাত দশেক দূরে একটা গাছের গায়ে গিয়ে বিঁধেছে। চুপ করে বসে থেকে চারপাশে দৃষ্টি দিলাম। যেমন ছিল তেমনি রয়েছে সব। এই কর্মকান্ড  পৃথিবীর কোনো বেঘাত ঘটেনি। পিছনের ঝোঁপে ঠিক আগের মতই টুনটুনিটা লাফাচ্ছে। ডানের ছোট শিরিশ গাছটায় তেমনি বসে ঝিমাচ্ছে শালিক জুটি। বেশ অনেকটা উত্তর-পশ্চিমে লেকের পদ্ম পাতায় চঞ্চল পায়ে আগের মতই হেটে বেড়াচ্ছে নিঃসঙ্গ ডাহুকটা।
আরিফাকে দেখতে আবার টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি দিলাম। ঐ যুবক আর আরিফা বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে বসে আছে একটা কংকৃটের বেঞ্চে। তাহলে এ-ই আরিফার স্বামী! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের গভীর থেকে। আরিফা… একটা প্রেমময় ইতিহাস।
ভার্সিটির আঙ্গিনায় আরিফা আর আমি ছিলাম প্রেমিক যোগল। কিভাবে যে দুজন দুজনার প্রেমে পড়েছিলাম কেউই বুঝিনি। যখন সম্পর্কটা ছুঁয়াছুয়ির পর্যায়ে চলে গেল তখনি বুঝলাম আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু হঠাৎ করেই রিমন এল আমাদের মাঝে। অর্থে, বিত্তে, চিত্তে রিমন ছিল অনেক সরস। আমি হেরে গেলাম। হারালাম আরিফাকে।
ঠকানো হয়েছিল আমাকে। নিষ্টুরভাবে ছিনিমিনি খেলা হয়েছিল আরিফার প্রতি আমার আন্তরিক দূর্বলতাকে নিয়ে। এখনো বিশ্বাস হয় না আরিফা আমার সাথে এমন করেছে। কিন্তু বাস্তব সত্যি তো আর অস্বীকার করা যায় না। আরিফা চলে গেল রিমনের বাহুডোরে। তাদেরকে সুখী দেখে আমি সুখী হলেও পথের মাঝেই পথ হারিয়ে ফেলাম।
ভুলে গেলাম আরিফার অস্তিত্ব আর রিমনের পেটা শরীরের দৃঢ়তা। আড়ালে আড়ালে অনেক দূর গিয়েও পথ খোজে পেলাম না। হারিয়ে গেলাম গোলক ধাঁধায়। বিচিত্র এক জীবনের সন্ধান পেলাম। স্বেচ্ছায় ডুব দিলাম অন্ধকারে। আশায় রইলাম যদি হঠাৎ কেউ এসে নিয়ে যায় প্রাণটা। তাই এমন করেই জীবনকে নিয়ে নিষ্টুর খেলা খেলালাম।
জীবনেও ভাবিনি এমন পরিস্থিতিতে আমার দৃষ্টি পথে আরিফা এসে দাঁড়াবে। কিন্তু আরিফার পাশে তো রিমন নয় অন্য একজন। বিচিত্র মেয়ে! বিচিত্র জীবন এদের। তবে আরিফা যে সুখী তা তার বাহ্যিক দিকই বলে দিচ্ছে। আমি পারব না তাকে অসুখী করতে। আমি আমার কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি এর প্রতিক্রিয়া খুব খারাপ। তবে যদি সেই খারাপটা আমার চাহিত স্বপ্নটার বাস্তবায়ন ঘটায় আমি পূর্ণতা পাব। চলে যাব বিচিত্র পৃথিবীর বিচিত্র মেয়েদের বিচিত্র ভালোবাসার বিচিত্র খেলার বিচিত্র দর্শকসারি থেকে।
সুখে থাক আরিফা- মনে মনে এই কথাটাই বললাম হয়তো। কিন্তু আরও কি যেন একটা দোল দিল মনে বুঝে উঠতে পারলাম না। চুপিসারে দাড়াতে লাগলাম। শিরশির অনুভূতি হল। প্রশিক্ষিত প্রতিটি অঙ্গ দ্রুত সাড়া দিল। অর্ধেক দাড়ানো অবস্থায় থেমে গেলাম। রাইফেলের বোল্ট পিছনে টানতেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেটের ধাতব খোল। সামনে টেলতেই ম্যাগাজিন থেকে চেম্বারে চলে এল আরেকটা গুলি। খড়াৎ-খট শব্দ হল। সাথে সাথে “কিট্”। শব্দ শুনেই সর্বশরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল। এই “কিট্” শব্দটা কিসের বুঝে নিতে একটুও কষ্ট হলো না। কাছেই কেউ পিস্তলের সেফ্টি-ক্যাচ অফ করল। অদৃশ্য ব্যক্তি চেয়েছিল বোল্ট টানার শব্দের আড়ালে সেফ্টি-ক্যাচ অফ করার শব্দ লুকাতে। কিন্তু সময়ের সামান্য ব্যবধানে একটু এদিন ওদিক হয়ে গেল।
দ্রুত শুয়ে পড়েই ঝোঁপের ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলাম। ছক একে নিয়ে মুহূর্তে ক্রল করে একটু পিছিয়ে এসে ডানে এগিয়ে গেলাম। এবার স্পষ্ট দেখলাম অদৃশ্য ব্যাক্তিকে। চুপিসারে ক্রল করে আমি প্রথমে যে ঝোঁপে ঢুকেছিলাম সে দিকে যাচ্ছে। ঘুরে তার পেছনে চলে এলাম নিঃশব্দে। মৃত্যুকে বুকে টেনে নিতে “অ্যাই” বলে ডাক দিলাম তার প্রায় দশ হাত পিছনে দাড়িয়ে। পাঁই করে ঘুরল লোকটা। দু’জনই থমকে গেলাম। চিনলাম তাকে- রিমন!
অনেকটা ঘোর লাগার মত লেগে গেল। নেমে গেল অস্ত্র পরস্পরের দিক থেকে। ভাঙ্গাচূরা রিমন আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। প্রায় ছয় কিলো দূরে তার গাড়ি ছিল। সন্ধ্যার অনেক পরে নিঃশ্চুপে সেখানে গিয়ে পৌঁছিলাম দু’জন।
তারপর ঘটনাস্থলে করা আমার প্রশ্নের উত্তর দিল রিমন ড্রাইভিং সিটে বসেই। খুব ধীরে ধীরে বলে যেতে লাগল একজন পরাজিত সৈনিকের মত। রাতের আকাশে সাদা মেঘের দৌড় ঝাপ, আর অর্ধেক চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখলাম মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে। আর ছাড়া ছাড় ভাবে বলেই গেল রিমন…
আরিফার পরিবার ব্যবসায়ি পাত্রের কাছেই পাত্রস্থ করল তাকে। পারিবারিকভাবে রিমন লোক পাঠিয়েছিল ওখানে। ওরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল- অনেক আগেই আরিফার বিয়ে ঠিক করা ছিল। আরিফার মন্তব্যও ছিল তখন অনেকটা এলোমেলো। সরাসরি না বলেনি কিন্তু আমাকে ঝুলিয়ে রেখে একদিন বধু সেজে চলে গেল বরের সাথে। নিজেকে অনেক বুঝালাম- এটা তোমার সাথে করা ব্যবহারের প্রতিফল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। নিজের অমনুষত্য জেগে উঠল। প্রতিশোধের নেশায় মাতাল হলাম। কিন্তু কেন যেন বারবার ব্যর্থ হলাম নিজেও জানি না। শেষ অবধি থেমে গেলাম।
সেদিন হঠাৎ করেই মার্কেটে আরিফার সাথে দেখা হয়ে গেল। নিজেকে থামাতে না পেরে কৈফিয়ত চেয়ে বসলাম। আরিফার অহংকারময় উত্তর- “আমি প্রতি ঘন্টায় যা পাচ্ছি ওর কাছ থেকে তা তুমি রিমন সারা জীবনেও দিতে পারতে না।”
ব্যক্তিত্ববোধে বাধল। জ্বলে উঠল সুপ্ত আগুন। পিছু নিয়ে সুযোগের সন্ধান করতে লাগলাম। যখন আড়িপেতে শুনলাম এখানে আসবে ওরা স্বামী স্ত্রী তখনি প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলাম- ওর স্বামীকে একটা বুলেট দান করব। আর বিধবা আরিফার আস্ফালন কতটা তা দেখব। কিন্তু পরবর্তীতে মত পাল্টালাম। একজনের দোষে অন্যজন নয়, বরং যে দোষী তাকেই তার শাস্তি পাওয়া উচিত।
তুমি যে ঝোঁপটায় বসে ছিলে তার প্রায় দুইশত ফুট পূবের উচু একটা ঝোঁপে ছিলাম আমি স্নাইপারের বেশে। কিন্তু আরিফার মায়াবী মুখ দেখে পারিনি রাইফেলের বুলেট ছুড়ে দিতে। এমন সময় হঠাৎ “দুপ” শব্দটা এল আমার কানে। হয়তো বাতাস যথেষ্ট সাহায্য করেছিল শব্দটা আমার কাছে পৌঁছে দিতে। ওখান থেকেই তোমাকে দেখলাম এবং চিনলাম। ভাবলাম অনেক কিছু। মনে হল তুমিও প্রতিশোধ নিতে চাইছ। আমি আরিফার মৃত্যু চাই না, তাই রাইফেল রেখে চুপিসারে দ্রুত চলে এলাম তোমাকে থামাতে।
ব্যর্থ প্রেম; ব্যর্থ জীবনের ব্যর্থ হিংসার ব্যর্থ প্রতিশোধ ব্যর্থই রইল। সারাটা রাত দুইজন ছুটে চললাম উত্তর-পশ্চিমে। কেউই জানি না কোথায় যাচ্ছি তবে দু’জনই জানি- চলে যেতে হবে বহু দূর… যেখানে আরিফার দুধে আলতা শরীরের মাতাল করা মায়াবী গন্ধ আর হরিণী চোখের মায়ময় দৃষ্টি নেই।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান

আরও সংবাদ