বরকতময় রামাদ্বান : মাসআলায়ে ইতিকাফ

রাহমাত, বারাকাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাহিনা পবিত্র মাহে রামাদ্বান মাসের ইবাদত সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত হচ্ছে রামাদ্বানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা। ইতিকাফ করা অনেক সাওয়াবের কাজ যদি সেটা বিশুদ্ধ তরীকা অনুযায়ী করা যায়। কিন্তু অনেক সময় আমাদের ভূলের কারণে তা নষ্ট হয়ে যায়। তাই আজ আমরা ইতিকাফের জরুরী কিছু মাসআলা জানার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ।

বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী নিয়ত ব্যতীত ইতিকাফ সহীহ হবে না। (হেদায়া ও কুদুরী)

রামাদ্বান মাসের শেষ দশ দিন এতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়াহ। যদি কোনো মাসজিদে একজন ইতিকাফে বসেন তাহলে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ ইতিকাফ না করে তাহলে ঐ এলাকার সকলেই সুন্নাত তরক করার জন্য দায়ী তথা গুনাহগার হবে। (বাহরুর রায়েক)

পুরুষের ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য শরয়ী মাসজিদ হওয়া জরুরি। নামাজের ঘরে ইতিকাফ সহীহ হবে না। তাই ইতিকাফে বসতে চাইলে মাসজিদেই বসতে হবে। (সূরা বাকারাহ ১২৫, ১৮৭ ও সুনানে আবু দাউদ)

অস্থায়ী নামাযের ঘরটি যেহেতু শরঈ মাসজিদ নয় তাই তাতে ইতিকাফ সহীহ হবে না। ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য শরঈ মাসজিদ হওয়া জরুরি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাদের (স্ত্রীদের) সাথে মিলিত হয়ো না”। (সূরা বাকারা ১৮৭)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, উক্ত আয়াতের আলোকে সকল ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, মাসজিদ ছাড়া অন্যস্থানে ইতিকাফ সহীহ হবে না। (তাফসীরে কুরতুবী ও আদ্দুররুল মুখতার)

ইতিকাফ একটি ইবাদত, যা বিনিময়যোগ্য নয়। তাই ইতিকাফের জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয নয়। কাউকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করালে সে ইতিকাফ সহীহ হবে না। অতএব এ জাতীয় ইতিকাফ দ্বারা এলাকাবাসী দায়িত্বমুক্ত হতে পারবে না। (হেদায়া ও রদ্দুল মুহতার)

মাসজিদে খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য আপনি বাসায় যেতে পারবেন। এ কারণে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না। তবে খাবার আনার জন্য মাসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না। অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। অবশ্য ঘটনাক্রমে খাবার প্রস্তুত না হলে সেজন্য অপেক্ষা করতে পারবেন। (বাহরুর রায়েক ও তাবয়ীনুল হাকায়েক)

ইস্তেঞ্জার জরুরুতে মাসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয। আর মাসজিদে ইস্তেঞ্জাখানা না থাকলে এজন্য বাসা-বাড়িতে যাওয়াও জায়েয। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফরত অবস্থায় ইস্তিঞ্জার প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না”। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া)

ইতিকাফরত ব্যক্তি ইস্তেঞ্জার জরুরুতে মাসজিদের বাইরে গেলে আসা যাওয়ার সময় সালাম আদান-প্রদান করতে পারবে। তদ্রূপ এসময় কারো সাথে অল্পস্বল্প কথাও বলতে পারবে। এতে ইতিকাফের ক্ষতি হবে না। সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে – “হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না”। তবে কারো সাথে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞাসার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েয হবে না। (মিরকাতুল মাফাতিহ ও ফাতাওয়া হিন্দিয়া)

পাঞ্জেগানা মাসজিদে ইতিকাফকারী জুমার নামাজ আদায় করার জন্য জামে মাসজিদে যেতে পারবে। তবে নামাজ শেষে বিলম্ব না করে ফিরে আসতে হবে। (আলমগীরী)

মাসজিদের দ্বিতীয় তলায় যদি কেউ ইতিকাফে বসেন আর উপরে যাওয়ার সিঁড়ি বাহিরের দিকে হয় তাহলে ইতিকাফকারী ব্যক্তি ঐ সিঁড়ি ব্যবহার করে নিচ তলায় এসে নামাজের কাতারে দাঁড়াতে পারবে। এক্ষেত্রে মাসজিদের বাইরের সিঁড়ি ব্যবহার করার কারণে তার ইতিকাফ নষ্ট হবে না। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ও রদ্দুল মুহতার)

বুঝেমান নাবালেগের ইতিকাফ সহীহ। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য থেকেই ইতিকাফে বসা উচিত । কেননা রামাদ্বানের শেষ দশকের ইতিকাফ অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা মোটেই ভালো নয়। (বাহরুর রায়েক ও ফাতাওয়া হিন্দিয়া)

ইতিকাফকারী যদি রাতে অথবা দিনে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সহবাস করে তাহলে ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে। কেননা দিনের মত রাতও ইতিকাফে শামিল। এমনকি চুম্বন ও স্পর্শ করার কারণে বীর্য নির্গত হলে ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে। (হেদায়া ও কুদুরী)

আযান দেওয়ার জন্য ইতিকাফকারী মুয়াযযিনের কামরায় যাওয়া জায়েয। এ কারণে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। (আলমুহীতুল বুরহানী, রদ্দুল মুহতার ও আলবাহরুর রায়েক)

ইতিকাফকারী কল্যাণমূলক ছাড়া কোন কথা বলবে না। তবে তার জন্য একবারে চুপ থাকা মাকরুহ। (হেদায়া)

ইতিকাফকারীর জন্য পূর্ণ সময় বাইরের সকল ঝামেলা থেকে মুক্ত থেকে ইবাদতে নিমগ্ন থাকা এবং আল্লাহমুখী হয়ে থাকাই কাম্য। তাই অধিক প্রয়োজন ছাড়া ইতিকাফ অবস্থায় মোবাইলের ব্যবহার না করাই শ্রেয়। তবে অন্য কোন মুসল্লী বা ইবাদতকারীকে অসুবিধা না করে মোবাইলে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলতে পারবে। (বাহরুর রায়েক ও ফাতাওয়া তাতারখানিয়া)

রামাদ্বান মাসের শেষ দশকের ইতিকাফ অবস্থায় ফরজ গোসল করা ব্যতীত সাধারণ গোসলের জন্য মাসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নয়। বের হলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (মারাকিল ফালাহ ও ফাতাওয়া হিন্দিয়া)

ইতিকাফকারী রোগীর সেবা ও জানাযার নামাজের উদ্দেশ্যে মাসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ থাকে না। তাই আপনি ইতিকাফ অবস্থায় মাসজিদের বাইরের জানাযার নামাজে শরিক হতে পারবেন না। বের হলে সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (সুনানে আবু দাউদ ও ফাতাওয়া খানিয়া)

ইতিকাফকারী সুগন্ধি ব্যবহার করা ও মাথায় তৈল লাগানো জায়েজ আছে। (আলমগীরী)

কোন পুরুষ যদি কয়েকদিন ইতিকাফ করার পর অসুস্থ হয়ে আর ইতিকাফ করতে না পারেন তাহলে একদিনের ইতিকাফ কাযা করতে হবে। আর তা সামনের রামাদ্বানেও করতে পারবে। এজন্য সে কোন একদিন সূর্যাস্তের পর থেকে পরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত মাসজিদে ইতিকাফ করবে। অবশ্য রামাদ্বানের বাইরে ইতিকাফটি কাযা করতে চাইলে দিনের বেলা নফল রোযাও রাখতে হবে। (রদ্দুল মুহতার ও আহকামে ইতিকাফ)

স্বামীর অনুমতি ছাড়া মহিলাদের ইতিকাফ জায়েজ হবে না। (আলমগীরী)

মহিলারা যে কক্ষে ইতিকাফ করতে চাচ্ছেন ঐ কক্ষকে আপাতত তার নামাজের ঘর হিসেবে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে এবং ইতিকাফের পূর্ণ সময় এ ঘরেই অবস্থান করতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ও আদ্দুররুল মুখতার)

মহিলাদের মাসিক শুরু হওয়ার কারণে ইতিকাফ ভেঙ্গে যায়। যে দিন মাসিক শুরু হয়েছে শুধু সেই একদিনের ইতিকাফ কাযা করে নেওয়া জরুরি। এই এক দিন কাযা করার নিয়ম হলো, একদিন সূর্যাস্তের আগে ইতিকাফ শুরু করতে হবে। পরবর্তী দিন রোযা থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর ইতিকাফ শেষ হবে। এভাবে একদিন রোযাসহ ইতিকাফ করলেই কাযা আদায় হয়ে যাবে। পুরো দশ দিনের ইতিকাফ কাযা করতে হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ও ফাতাওয়া রহীমিয়া)

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক জানার, বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন। ইতিকাফকারীদের ক্ববুল করুন। (আমিন)

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ