মুসলিম নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান


ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞান চর্চায় পুরুষদের অবদান সম্পর্কে বিপুল পরিমাণে বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান চর্চায় মুসলিম নারীদের অবদান সেই তুলনায় ঐতিহাসিকদের আলোচনায় আসতে সক্ষম হয়নি।
পুরুষের পাশাপাশি মুসলিম নারীরা ধর্মতত্ত¡, কাব্য, সাহিত্য, আইন প্রভৃতি বিষয়ের মত বিজ্ঞান চর্চায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

কয়েকজনের নাম এখানে উপস্থাপন করা হলো:

আয়েশা (রা:); হাদিস বর্ণনা, ইসলামী আইন, ফিকহ, ইতিহাস, কবিতা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। আসমা বিনতে আবি বকর (রা:) ও উম্মে আবিদুল্লাহ বিন জুবায়ের; তারা উভয়েই হাদিস বর্ণনায় দক্ষ ও পারদর্শী ছিলেন।
আয়েশা বিনতে তালহা; তিনি কবিতা, সাহিত্য, জ্যোতিষশাস্ত্র ও নভোমন্ডল বিষয়ে অত্যন্ত পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সাকিনা বিনতে হোসাইন ও খানসা; তারা কাব্য ও সাহিত্যে প্রবাদতুল্য ছিলেন।
মায়মুনা বিনতে সাদ (রা:); হাদিসশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা:)ও তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। কারিমা মারজিয়া (রহ.); হাদিসের বিজ্ঞ পন্ডিত ছিলেন। ইমাম বুখারি (রহ.) তার কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন।
ফাতিমা বিনতে আব্বাস; প্রখ্যাত ইসলামী আইনবিদ। তিনি মিসর ও দামেশকের প্রভাবশালী নেত্রী ছিলেন। উখত মজনি (রহ.); তিনি ছিলেন ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর শিক্ষক। আল্লামা মারাদিয়ি (রহ.) তাঁর কাছ থেকে জাকাত বিষয়ক মাসআলা বর্ণনা করেছেন।
হুজায়মা বিনতে হায়ই (রহ:) প্রখ্যাত তাবেয়ি ও হাদিসবিদ ছিলেন। ইমাম তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ (রহ:) তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আয়েশা বিনতে আহমদ বিন কাদিম স্পেনের অধিবাসী ছিলেন। ক্যালিওগ্রাফিতে অনন্যতার পরিচয় দিয়েছেন। লুবনি (রহ:) ভাষাবিদ হওয়ার পাশাপাশি আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রে প্রাজ্ঞ ছিলেন।
ফাতিমা বিনতে আলী বিন হোসাইন বিন হামজাহ ছিলেন হাম্বলি মাজহাবের পন্ডিত। সমসাময়িক আলেমরা তার কাছ থেকে হাদিস শিখেছেন এবং প্রসিদ্ধ হাদিসগ্রন্থ দারেমি শরিফের সনদের অনুমতি নিয়েছেন। রাবিয়া কসিসাহ সুপ্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। হাসান বসরি (রহ.)ও তার কাছ থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছেন।
ফাতিমা বিনতে কায়েস শিক্ষাবিদ ও আইনজ্ঞ ছিলেন। উম্মে ফজল, উম্মে সিনান হাদিস বর্ণনাকারী ছিলেন। শিফা বিনতে আবদিল্লাহ প্রখ্যাত আইনতাত্তি¡ক ছিলেন। ওমর (রা.) তাকে ইসলামী আদালতের ‘কাজাউল হাসাবাহ’ (Accountability court) ও ‘কাজাউস সুক’ (Market administration) ইত্যাদির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। (সূত্র, তাবকাতে ইবনে সাদ : ৮/৪৫-৪৮; দালায়িলুন নবুয়্যাহ : ৫/৪১৬; ইবনে আসির : ৫/৪৫০; আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৫/৭৮)
শায়েখ আলাউদ্দিন সমরকন্দি (রহ.) ‘তুহফাতুল ফুকাহা’ নামে একটি কিতাব লিখেছেন। এটির ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন তারই ছাত্র আবু বকর ইবনে মাসউদ কাস্তানি (রহ.)। ব্যাখ্যাগ্রন্থটির নাম ‘বাদায়েউস সানায়ি’। ইসলামী ফিকহশাস্ত্রে এটি নজিরবিহীন কিতাব। এটা দেখে শিক্ষক তার ছাত্রের কাছে নিজ মেয়েকে বিয়ে দেন। মেয়েটির নাম ফাতিমা। সমকালীন রাজা-বাদশাহরা মেয়েটিকে বিবাহ করতে আগ্রহী ছিলেন। সে মেয়েটি ছিলেন মুফতি। তার স্বাক্ষরিত অসংখ্য ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে। (ফতোয়ায়ে শামি : ১/১০০)

ইবনে কায়েসের বর্ণনায় দেখা যায়, প্রায় ২২ জন নারী সাহাবি ফতোয়া ও ইসলামী আইনশাস্ত্রে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে সাতজন উম্মাহাতুল মুমিনিন বা নবীপতœী ছিলেন। ১১ শতাব্দীতে মামলুক শাসনামলে ততকালীন মুসলিম নারীরা দামেশকে পাচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১২টি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণরূপে মুসলিম নারীদের দ্বারা পরিচালিত হতো।

রাসূল (সা.) এর সমকালীন অনেক নারীই চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধে আহতদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে তারা রাসূল (সা.) এর সাথে যুদ্ধেও গমন করেছিলেন।
নুসাইবা বিনতে কাব আল-আনসারী (রা.) ছিলেন মদীনার একজন প্রখ্যাত নারী চিকিৎসক। উম্মে আম্মারা নামে অধিক খ্যাত এই নারী সাহাবী রাসূল (সা.) এর মদীনায় হিযরতের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। উহুদের যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) কে প্রতিরক্ষার জন্য তার লড়াইয়ের কারণে তিনি ইতিহাসে অধিক পরিচিত।
রুফাইদা বিনতে সাদ আল-আসলামিয়া (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.) এর সমকালীন মদীনার অপর একজন নারী চিকিৎসক। তাকে “ইসলামের প্রথম নার্স” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি মূলত তার চিকিৎসক পিতা সাদ আল-আসলামীর নিকট থেকে চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এতই বুৎপত্তি অর্জন করেন যে, রাসূল (সা.) যুদ্ধে আহত সকল সৈনিককে তার নিকট চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করতেন।
এছাড়া রাসূল (সা.) এর সমকালীন আরো কয়েকজন নারী চিকিৎসকদের মধ্যে উম্মে সিনান আল-ইসলামী (উম্মে ইমরা হিসেবে পরিচিত), উম্মে মাতায়ী আল-আসলামিয়া এবং উম্মে ওরাকা বিনতে হারিস উল্লেখযোগ্য।

ডঃ ফাতেন আব্দুর রহমান খুরশিদ, মুসলিম মহিলা বিজ্ঞানী, যিনি রাসুল (সঃ) এর এক হাদীস থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আবিষ্কার করেছেন ক্যান্সারের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ একটি ওষুধ।
ডঃ ফাতেন খুরশিদ কিং আব্দুল আযীয ইউনিভার্সিটির মেডিসিন ফ্যাকাল্টির একজন প্রফেসর, সেই সাথে কিং ফাহাদ মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের প্যান্ট সেলস অ্যান্ড টিস্যুজ ইউনিটের প্রেসিডেন্ট। তিনি ২০০১ সালে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই গ্যাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং এ তার পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এখন পর্যন্ত তার চারটি বই ও চৌদ্দটি পেপার পাবলিশ হয়েছে। একই সাথে তিনি WAMY (World Assembly of Muslim Youth)এর মহিলা বিভাগের সদস্য।

ইবনে আল-জাওযী, ইবনে আল-খতীব বাগদাদী এবং ইবনে কাসীর সহ প্রমুখ ঐতিহাসিক দশম শতাব্দীর একজন নারী গণিতবিদের প্রশংসা করেছেন। সুতাইতা আল-মাহামালি নামের এই নারী গণিতবিদ বাগদাদের এক বিদ্যোৎসাহী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার পিতা ছিলেন বাগদাদের একজন বিচারপতি ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব।
গণিতের বিভিন্ন শাখায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এছাড়া একইসাথে তিনি আরবী সাহিত্য, হাদীস এবং আইনশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ৩৭৭ হিজরী মোতাবেক ৯৮৭ ঈসায়ীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
মধ্যযুগে আন্দালুসিয়ার উমাইয়া দরবারের একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন লুবনা আল-কুরতুবিয়া। তিনি একাধারে গণিত, কাব্য, ব্যকরণ ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপর বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
তার জ্ঞানগত দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার কারণে তিনি খলীফা ৩য় আবদুর রহমান এবং তার পূত্র ২য় আল-হাকামের দরবারের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মধ্যযুগে ধনাঢ্য পরিবার থেকে আগত অনেক মুসলিম নারীই শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণায় অর্থায়ন করে ইসলামী সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নে অবদান রেখেছেন।
খলীফা হারুন আল-রশীদের স্ত্রী যুবাইদা বিনতে জাফর ছিলেন তার সমকালীন ধনাঢ্য ও ক্ষমতাশালী নারী। বাগদাদ থেকে মক্কা যাওয়ার পথে পথিকদের সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য নাহরে যুবাইদা (যুবাইদার খান) তারই তৈরি। শিক্ষার বিস্তারের জন্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নির্মাণ করেন।
মরক্কোর ফেজের অধিবাসী ফাতিমা আল-ফিহরী ছিলেন আরেকজন বিত্তশালী নারী যিনি শিক্ষা বিস্তারে তার অর্থ ব্যয় করেন। বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আল-কারাউন বিশ্ববিদ্যালয় তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন।
আলেপ্পোর আমীর আল-জহির গাজীর স্ত্রী দাইফা খাতুন আলেপ্পোতে দুইটি বিখ্যাত স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম স্কুলটির নাম মাদরাসা আল-ফেরদাউস। এটি ইসলামী ধর্মতত্ত¡ ও ইসলামী আইনের শিক্ষা প্রদানের জন্য বিখ্যাত ছিল। এছাড়া তার নির্মিত অপর স্কুলটি আইন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সংক্রান্ত জ্ঞান প্রদানের জন্য বিখ্যাত ছিল।
ওসমানীয় সুলতান সুলাইমানের স্ত্রী হুররেম সুলতানের নাম, শিক্ষা বিস্তারের জন্য যিনি ইস্তাম্বুলে প্রতিষ্ঠা করেন হাসেকি কুল্লিয়েহ কমপ্লেক্স। একটি মসজিদ, কলেজ এবং লঙ্গরখানার সমন্বয়ে গঠিত পুরো কমপ্লেক্সটি। এছাড়া এখানে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনায় গোসলখানা, হাসপাতাল এবং দুইটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থানও রয়েছে এই কমপ্লেক্সে। এই কমপ্লেক্সটি নির্মাণ ছাড়াও তিনি মক্কা ও জেরুসালেম শহরে মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে অর্থ ব্যয় করেন।

আয়েশা (রা.) ও উম্মে সালমা (রা.) ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মহানবী (সা.)-এর ফুফু সুফিয়া বিনতে আবদিল মুত্তালিব (রা.) খায়বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উম্মুল খায়ের, জুরকা বিনতে আদি, ইকরামা বিনতে আতরাশ ও উম্মে সিনান অসংখ্য যুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক কাজে সহযোগিতা করেন।
আজরা বিনতে হারিস বিন কালদা সেনাদলের নেতৃত্ব প্রদান ও আহলে বিসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। উম্মে আম্মারা (রা.) ওহুদের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর জীবন রক্ষায় প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছিলেন। মহানবী (সা.) তাকে ‘খাতুনে ওহুদ’ উপাধি দিয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সামুদ্রিক অভিযানে প্রথম শাহাদাত বরণ করেন উম্মে হারাম বিনতে মিলহান (রা.)।
উম্মে আতিয়া আনসারি (রা.) মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উমাইয়া বিনতে কায়েস কিফারিয়া খায়বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উম্মে হাকিম বিনতে হারিস রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
উম্মে আয়মন হাবশি (রা.) ওহুদ, হুনাইন, খায়বর ও মোতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উম্মে সুলাইম (রা.) খায়বর ও হুনাইনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উম্মে হারাম বিনতে মিলহান ইসলামের প্রথম নারী নৌযোদ্ধা। রাবি বিনতে মুয়াওয়াজ (রা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। নাসিবাহ বিনতে কাব আনসারিয়া ওহুদ, বনি কুরাইজা, হুদায়বিয়া, খায়বর, হুনাইন ও ইয়ামার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। (সূত্র : তাবকাতে ইবনে সাদ : ৮/৪১৫; দালায়িলুন নবুয়্যাহ : ২/৭১২)

লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ