রামাদ্বান পরবর্তী করণীয়

আল-হামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা আমাদের গুনাহ মাফ করানোর সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দান করেছিলেন পবিত্র রামাদ্বানুল মোবারক। সবাই সবার অবস্থান থেকে সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন সারা মাস ফরজ রোজা রাখার পাশাপাশি ফরজ নামাজ, তারাবীহ নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ, পবিত্র কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত, ইতিকাফ করা ও আল্লাহর রাস্তায় দান খয়রাত করতে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রামাদ্বান বিদায় হওয়ার পর থেকে আবার আমরা কিছু মানুষ গাফিল হয়ে গেছি বা যাচ্ছি। ঠিক রামাদ্বানে যেভাবে আল্লাহর গোলামী করেছি বা করার চেষ্টা করেছি সেটা কিন্তু এখন আর নেই! অথচ রামাদ্বানে যা করেছি সেটা সারা বছর না বরং সারাটা জীবন করার কথা। আর এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা নিজেই আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনুল কারীমের সূরা নহল এর ৯২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর তোমরা সে নারীর মতো হয়ো না, যে তার পাকানো সূতো শক্ত করে পাকানোর পর টুকরো টুকরো করে ফেলে”।

এখানে আল্লাহ তায়ালা একজন মহিলার কাজের উদাহরণ দিয়ে আমাদের বুঝাতে চেয়েছেন। যে মহিলা ছিল মক্কার বাসিন্দা। সেই মহিলা সূতো দিয়ে ঠিকঠাক ও মযবুত করে একটা কিছু তৈরী করতো। কিন্তু পরে সে বিনা কারণে তা ছিড়ে ফেলতো এবং টুকরো টুকরো করে দিতো। সুতরাং তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ মহিলার মতো, যারা রামাদ্বান মাসে কষ্ট করে নিজের আমল ঠিক করলেন কিন্তু রামাদ্বানের পর আবার সেই আমল নষ্ট করে দিলেন। অথচ এই আমল নিয়মিত করার কথা। এ বিষয়ে সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন- হে আবদুল্লাহ! তুমি অমুক ব্যক্তির মতো হয়ো না, সে রাত জেগে ইবাদাত করতো, পরে রাত জেগে ইবাদাত করা ছেড়ে দিয়েছে”।

নেক আমল জারি রাখা।

নেক আমল জারি থাকতে হবে মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত। মৃত্যু কার কখন আসবে কেউ বলতে পারবেনা। তাই যতক্ষণ আপনি সুস্থ আছেন এবং সময় আছে ততক্ষণ আপনাকে নেক আমল করতেই হবে। এ বিষয়ে সূরা হিজরের ৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আর ইয়াক্বীন (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদাত করো”।

এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সম্বোধন করে দুনিয়ার সকল মুমিন মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন ইয়াক্বীন আসা পর্যন্ত ইবাদত করে। এখানে “ইয়াক্বীন” দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মৃত্যু। দলীল হচ্ছে হযরত উম্মু আলা (রাঃ) এর হাদীস। সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উসমান বিন মাযউন (রাঃ) সম্পর্কে বলেছেন। যেটি বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “তার ইয়াক্বীন চলে এসেছে অর্থাৎ মৃত্যু চলে এসেছে। আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে তার জন্য কল্যাণ আশা করছি”।

কিন্তু কোন কোন ভ্রান্ত সম্প্রদায় “ইয়াক্বীন” এর দ্বারা উদ্দেশ্য গ্রহণ করে যে, যখন “ইয়াক্বীন” চলে আসবে তখন আর আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করার প্রয়োজন নেই। যার ফলে অনেকে এই “ইয়াক্বীন” এর অর্থ “খাঁটি বিশ্বাস” গ্রহণ করে ইবাদত করা ছেড়ে দিয়েছে। তাদের এই উদ্দেশ্যটি ভূল। বরং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে হবে। তাই আপনি যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ তাঁর ইবাদত করতেই হবে। আর মুমিনদের সফল হওয়ার অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করা তথা তাঁর ইবাদত করা। সূরা আল-ইমরানের ১৯১ নম্বর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও কাত হয়ে”।

বিশেষ করে নামাজের বিষয়ে সহীহ বুখারী শরীফের একটি হাদীসে এসেছে- “হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার অর্শ রোগ ছিলো। তাই আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমতে নামাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তিঁনি বললেন, দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে, তা না পারলে বসে, যদি তাও না পারো তাহলে শুয়ে”।

সুতরাং রামাদ্বান চলে গেছে তাই গাফিল হয়ে নামাজ সহ যেকোনো ইবাদত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া যাবে না। বরং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত করে যেতে হবে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত করেছেন। আর যদি এর ব্যতিক্রম হয় তাহলে মনে রাখবেন আপনি সঠিক পথে নেই। আর আমলের ক্ষেত্রে নিয়মিত আমলটাই হচ্ছে পছন্দনীয় আমল। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত মাসরূক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আয়শা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট কোন আমলটি সর্বাধিক পছন্দনীয় ছিলো? তিনি বললেন, নিয়মিত আমল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিঁনি কখন তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন? তিনি বললেন, যখন মোরগের ডাক শুনতে পেতেন”।

আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া যাবে না।

রামাদ্বানে যেভাবে আল্লাহকে স্মরণ করেছেন বিভিন্ন ইবাদত করার মাধ্যমে ঠিক তেমনি করতে হবে সর্বদা। কারণ যদি এখন তাঁর স্বরণ থেকে বিমুখ হন তাহলে নিজের পূর্বের নেক আমল নষ্ট করে ধ্বংস ডেকে আনবেন। আপনি ঈমানদার থেকে ফাসিক হয়ে যাবেন। সূরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “তোমরা তাদের মতো হইও না, যারা আল্লাহকে ভূলে গিয়েছিলো ফলে আল্লাহও তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছিলেন। আর তারাই হলো ফাসিক”।

এখানে আল্লাহ তায়ালা তাদের কথা বলেছেন যারা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত বা নির্দেশ পালন না করে ও নিষেধ বর্জন না করার মাধ্যমে তাঁর স্মরণকে বর্জন করেছে ফলে তিঁনি তাদেরকে সৎ আমলের কথা ভূলিয়ে দিয়েছেন যা আখিরাতে তাদের উপকারে আসতো। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে এমন সব মানুষের মতো হতে নিষেধ করেছেন যারা আল্লাহ তায়ালার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তারাই তাঁর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাবে, নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। যেমন সূরা মুনাফিকের ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেনো তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন না করে। যারা এমন করবে (উদাসীন হবে) তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত”।

কাযা রোজা আদায় করা।

রামাদ্বান মাসে যারা অসুস্থ, মুসাফীর বা যে সমস্ত মহিলাগন হায়েজ ও নিফাস অবস্থায় ছিলেন তারা রামাদ্বানের যে কয়টি রোজা কাযা হয়েছে সেগুলো যত সম্ভব তাড়াতাড়ি আদায় করে নেওয়া উচিত হবে। সূরা বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “তবে তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হয় কিংবা সফরে থাকে (এবং এ কারণে তাকে নির্ধারিত দিনের রোজা ছাড়তে হয়) তাহলে সে অন্য (সময়ের) দিনগুলোতে রোজা রেখে (রোজার) সংখ্যা পূরণ করবে”।

 হজ্জের জন্য প্রস্তুতি গ্ৰহণ করা।

পবিত্র শাওয়াল মাস হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ পবিত্র হজ্জের মাস। তাই যাদের উপরে হজ্জ ফরজ তারা রামাদ্বানের পরেই শাওয়াল মাসের শুরু থেকেই হজ্জের সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে নিবেন। সূরা বাকারার ১৯৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হজ্জের সময় হলো নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস। এ সময়ে কেউ যদি হজ্জ করতে মনস্থ করে তাহলে হজ্জের মধ্যে সে কোন অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ কিংবা ঝগড়া-বিবাদ করতে পারবে না। তোমরা যে ভালো কাজ করো আল্লাহ তা জানেন। সঙ্গে পাথেয় নিও, তবে তাক্বওয়াই সেরা পাথেয়। হে বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা! তোমরা আমাকে ভয় করো”।

উক্ত আয়াতের তাফসীরে সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন- হজ্জের মাস হচ্ছে, শাওয়াল, যুলক্বায়দাহ ও যুলহাজ্জাহ মাসের প্রথম দশক”।

শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখা।

রামাদ্বানের রোজার পর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা পালন করার ফজিলত স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ননা করেছেন। আর এটা প্রমান করে আমাদের আমলকে রামাদ্বানের পর ধারাবাহিক রাখতে। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ আইয়ূব আল আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- রামাদ্বান মাসের রোজা পালন করে, পরে শাওয়াল মাসে ছয়দিন রোজা পালন করা সারা বছর রোজা পালন করার মতো”।

এই ছয়টি রোজা মুস্তাহাব হিসেবে একসাথে অথবা বিরতি দিয়ে তথা একটা রেখে মাঝে একদিন দুদিন বিরতি দিয়ে মাসের ভিতরে রাখলেও হবে। তবে ফুকাহায়ে আহনাফের বেশিরভাগের মত হচ্ছে বিরতি দিয়ে রাখা মুস্তাহাব। আবার খেয়াল রাখতে হবে যাদের রামাদ্বানের রোজা কাযা হয়েছে তারা যেন সেই কাযা রোজাগুলো আগে আদায় করার চেষ্টা করেন। আর এটাই হবে উত্তম ও বুদ্ধিমানের কাজ।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের রামাদ্বানের রোজাসহ প্রতিটি নেক আমল ক্ববুল করুন। আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ