মানুষের সর্বগ্রাসি ক্ষুধার কাছে বুড়ি নদীর অস্থিত্ব বিলীন
সংগ্রামর বাদেও বুড়ি নদী মুখা বড় বড় নৌকা চলতে দেখছি। বাপ-দাদার গেছ থাকি হুনছি ই নদী মুখা (দিয়ে) বড় বড় জাজ (জাহাজ) চলত। কিন্তু অখন অনেক জাগাত ই নদীর কোন চিহ্ন নাই। সিলেটের ওসমানীনগরের অস্থিত্বহীন বুড়ি নদী নিয়ে এভাবেই কথা গুলো বললেন স্থানীয় চাঁন মিয়া নামের বয়োবৃদ্ধ এক ব্যক্তি।
জানা যায়, প্রাচীন বালাগঞ্জের মানচিত্র ও ইতিহাসে বিলুপ্ত বুড়ি নদীর স্পষ্ট অবস্থান থাকলেও মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কাছে নদীটি আজ অস্থিত্বহীন। এক সময়কার বিশাল নদীটি খাল, ডোবা, বসতবাড়ি ও ধানী জমিতে পরিণত হয়েছে। মরে যাওয়া পুরো নদীটিকে গিলে ফেলেছে এলাকার প্রভাবশালীরা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই নদী সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। বুড়ি নদী সিলেটের পূর্বাঞ্চলীয় হাওর এলাকা থেকে তৎকালীন বালাগঞ্জ উপজেলার উত্তর পূর্ব কোনের দয়ামীরের চিন্তামনি দিয়ে প্রবেশ করে উসমানপুর, বোয়ালজুড়, তাজপুর, গোয়ালা বাজার, বুরুঙ্গা, পশ্চিম পৈলনপুর ও সাদীপুর ইউনিয়ন ছুঁয়ে বর্তমান বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলাকে বিভক্ত করে নবীগঞ্জের দিকে প্রবাহিত ছিল। তৎকালীন বালাগঞ্জ উপজেলায় এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩০ কিলোমিটার। শতাধিক বছর পূর্বে বুড়ি নদীর বুক ভেদ করে চলত জাহাজ ও সওদাগরদের নৌকা। একসময় পলিদ্বারা ভরাট এবং মানুষের কারণে নদীটির প্রসস্থতা ক্রমেই কমতে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বুড়ি নদী একটি খালে পরিণত হলেও বড় বড় নৌকা চলতে দেখা যেত বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ১৯৯০ সালেও নদীটির অস্থিত্ব ছিল এবং নৌকাও চলত। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কাছে নদীর অস্থিত একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর জায়গা দখল করে যে যার ইচ্ছে মত ব্যহার করছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ স্থানেই নদীর কোন চিহ্ন লেশ নেই। কিছু কিছু জায়গায় নদীর শেষ চিহ্ন হিসেবে ছিল ছোট খাল। তাজপুর মাছ বাজারের সাথে নদীর শেষ চিহ্ন ছোট খালটি ময়লার ভাগাড় তৈরি করে ভরাট করা হচ্ছে। বছর দু’য়েক পরে এখানেও নদীর শেষ চিহ্ন টুকু মুছে যাবে।
বুড়ি নদীই নয়। ‘রত্না’ নদীসহ অসংখ্য খালের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। সুরমা নদীর একটি শাখা উপজেলার নাজির বাজার এলাকায় রত্মা নাম ধারণ করে দয়ামীর, তাজপুর, গোয়ালাবাজার, উমরপুর হয়ে বানাইয়া হাওরে পতিত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে রত্মা নদীর তীরে অবস্থিত তৎকালিন যুগলগঞ্জ বাজারে ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক সম্মেলন হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু নদীটি আজ অস্থিত্বহীন। এছাড়া নারকিলাসহ অসংখ্য খালও অস্থিত্ব বিলীনের পথে। জল প্রবাহের পথ প্রায় বন্ধ থাকায় বর্ষায় বন্যাক্রান্ত হয়ে দূর্ভোগ এবং ফসলহানীর শিকার হচ্ছে। এলাকাবাসীর দাবি বিলীন হয়ে যাওয়া নদী ও খাল বিলের জায়গা উদ্ধার করে তা খনন করা হলে একদিকে কৃষির ফলন ভাল হবে অন্যদিকে অনাকাংখিত বন্যার হাত থেকে রক্ষা মিলবে ।
দয়ামীর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বালাগঞ্জের মাটি ও মানুষ বইয়ের লেখক আবদুল হাই মোশাহিদ বলেন, তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায় বুড়ি নদীর অনেক প্রসস্থতা ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এক সময় নদীটি খালে পরিণত হয়। আমরাও বুড়ি নদী দিয়ে নৌকা চলাচল করতে দেখেছি। কিন্তু নদীটিকে গলাটিপে হত্যা করে এর জায়গা দখল করে নেয়ায় এখন নদীটির অস্থিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
তাজপুরের চয়ন পাল বলেন, ১৯৯০ সালের পরেও আমরা এই বুড়ি খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করতে দেখেছি। কিন্তু নৌকা দুরের কথা এখন পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই। নদীর জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছে অনেক স্থাপনা।
ওসমানীনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ময়নুল হক চৌধুরী বলেন, ছোট বেলা বুড়ি নদী দিয়ে নৌকায় চলাচল করেছি কিন্তু এখন আর সেই নদীর অস্থিত্ব নেই বললে চলে। রত্মা নামে আরেকটি নদীও অস্থিত্বহীন।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বলেন, নদীর জায়গা অবৈধ ধখলের একটি তালিকা তৈরি করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। অস্থিত্ব আছে এমন নদী গুলোর অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন এবং অস্থিত্বহীন নদীর জায়গা দখল মুক্ত করতে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।