আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন (পর্ব পাঁচ)

 

ভালোবাসা একটি গোপন বিষয়। কারো প্রতি কারো কতটুকু ভালোবাসা আছে তা পরিমাপ করা খুব কঠিন। তবে কিছু কিছু মাপকাঠি আছে যেগুলো দিয়ে অনেক সময় বুঝা যায় বা অনুমান করা যায় কতটুকু ভালোবাসা আছে। আর তার মধ্যে অন্যতম হলো একে অপরের অবস্থা ও পারস্পরিক ব্যবহারের চিহ্ন ও লক্ষণাদি দেখে বা জেনে নেয়া। কিন্ত আল্লাহ তায়ালা কাদের ভালবাসেন সে মাপকাঠি তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন। সেগুলো যদি কোন মানুষের মধ্যে থাকে তাহলে সে আল্লাহর ভালবাসায় শিক্ত হবে। তাহলে আসুন দেখি আমাদের মধ্যে সেই মাপকাঠি গুলো আছে কি না?

ষষ্ঠ মাপকাঠি

ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন।

আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে ভালোবাসেন তাদের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির মানুষ হচ্ছেন যারা সমাজে ন্যায়বিচার করেন। সূরা হুজরাতের ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন”। উক্ত আয়াতে আমরা পরিষ্কার ভাষায় পেলাম যে মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন। সমাজে কিভাবে ন্যায়বিচার করে আল্লাহর ভালোবাসার বান্দা হবেন, কে বিচার করতে পারবেন ও ন্যায়বিচারকারীদের আরো অনেক ফজিলত পবিত্র কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আমরা খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা আলোকপাত করব ইনশা আল্লাহ।

আল্লাহ হলেন শ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক।

সূরা আত-ত্বীন এর ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আল্লাহ কি বিচারকদের শ্রেষ্ঠ বিচারক নন”? এখানে আল্লাহ তায়ালা প্রশ্ন করে বলছেন তিনি কি সব বিচারকের মহাবিচারক নন? তিনি কি সকল শাসকবর্গের মধ্যে সর্বোত্তম শাসক নন? এই ন্যায় বিচারের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল প্রত্যেক অপরাধীকে তার শাস্তি ও প্রত্যেক সৎকর্মীকে তার উপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করা। বিচারকদের শ্রেষ্ঠবিচারক আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উপনীত করেছেন পরিপূর্ণ ন্যায় ও প্রজ্ঞার সাথে, তবুও কি তিনি মানুষের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদানও দেবেন না? (বাদা’ই‘উত তাফসীর)

 সু-বিচার প্রতিষ্ঠা কার আল্লাহর নির্দেশ।

সূরা হাদীদের ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদন্ড নাযিল করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে”।

বিচারের সময় প্ররোচিত না হওয়া।

সূরা মাঈদার ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “কোন কওমের শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে মসজিদে হারাম থেকে বাধা প্রদান করেছে, তোমাদেরকে যেন কখনো প্ররোচিত না করে যে, তোমরা সীমালঙ্ঘন করবে। সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর”।

আল্লাহর বিধান অনুসারে বিচার করার নির্দেশ।

সূরা মাঈদার ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আমি আপনার কাছে যথার্থই কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছি যা তার পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী ও তার প্রহরী। অতএব, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে তাদের মধ্যে বিচার করুন। আর আপনার কাছে আগত সত্য ছেড়ে তাদের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিবেন না। আর আপনি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে তাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করবেন, তাদের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং তাদের থেকে সাবধান থাকবেন যাতে আপনার কাছে আল্লাহর নাযিলকৃত কতিপয় বিধান থেকে তারা আপনাকে দূরে সরাতে না পারে”।

আল্লাহর বিধান অনুসারে বিচার না করা।

আল্লাহর বিধান অনুসারে যারা বিচার পরিচালনা করে না তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা কাফের, যাালেম ও ফাসেক বলেছেন- সূরা মাঈদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান আনুসারে বিচার করে না তারাই কাফের। যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান আনুসারে বিচার করে না তারাই যালেম”। যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান আনুসারে বিচার করে না তারাই ফাসেক”।

নারীদের শাসক বা বিচারক বানানো।

বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে- “হযরত আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি কথা দিয়ে আল্লাহ জঙ্গে জামাল (উষ্ট্রের যুদ্ধ) এর সময় আমাকে বড়ই উপকৃত করেছেন। (তা হল) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যখন এ খবর পৌছল যে, পারস্যের লোকেরা কিসরার মেয়েকে তাদের শাসক (বিচারক) নিযুক্ত করেছে, তখন তিনি বললেন, সে জাতি কখনো সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসনভার কোন স্ত্রীলোকের হাতে অর্পণ করে”।

উত্তম শাসক ও নিকৃষ্ট শাসক বা বিচারক।

সহিহ মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে- “হযরত আওফ ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের সর্বোত্তম নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ভালবাস আর তারাও তোমাদের ভালবাসে। তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, তোমরাও তাদের জন্য দোয়া কর। পক্ষান্তরে তোমাদের সর্ব নিকৃষ্ট নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর আর তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও আর তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কি তাদেরকে তরবারি দ্বারা প্রতিহত করব না? তখন তিনি বললেন, না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়িম রাখবে”।

বিচারক তিন প্রকার।

আবু দাউদ শরীফের হাদিসে এসেছে- “হযরত ইবনে বুরাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী এবং অপর দুই প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে তদনুযায়ী ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে জুলুম করে সে জাহান্নামী এবং যে বিচারক অজ্ঞতা প্রসূত ফায়সালা দেয় সেও জাহান্নামী”।

 সুবিচার করা হচ্ছে একটি সাদাকাহ।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মানুষের প্রতিটি হাতের জোড়ার জন্য তার উপর সাদাকাহ রয়েছে। সূর্য উঠে এমন প্রত্যেক দিন মানুষের মধ্যে সুবিচার করাও সাদকাহ”।

রাগাম্বিত অবস্থায় বিচার না করা।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবি বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কোন বিচারক যেন রাগাম্বিত অবস্থায় দুজনের মধ্যে বিচার না করেন”।

আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবেন।

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে দিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, সে দিন আল্লাহ তায়ালা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। (তাদের প্রথম প্রকার) ন্যায়পরায়ণ শাসক”।

নূরের মিম্বারে উপবিষ্ট থাকবেন।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ন্যায় বিচারকগণ (কিয়ামাতের দিন) আল্লাহর নিকটে নূরের মিম্বারসমূহে মহামহিম দয়াময় প্রভুর ডানপার্শ্বে উপবিষ্ট থাকবেন। তাঁর উভয় হাতই ডান হাত (অর্থাৎ- সমান মহিয়ান)। যারা তাদের শাসনকার্যে তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে এবং তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বসমূহের ব্যাপারে সুবিচার করে”।

জান্নাতে প্রবেশ করবেন।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত ইয়াদ ইবনে হিমার আল-মুজাশি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- জান্নাতিরা তিন প্রকার- (ক) ন্যায়পরায়ণ, সদকাকারী ও তাওফিকপ্রাপ্ত বাদশাহ। (খ) সকল আত্মীয় ও মুসলিমের জন্য দয়াশীল ও নরম হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি। (গ) অধিক সন্তান-সন্তুতিসম্পন্ন সৎ ও পবিত্র ব্যক্তি”।

জান্নাত হারাম করা হবে।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত হাসান বাসরী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হযরত মাকিল ইবনে ইয়াসারের কাছে তার সেবা-শুশ্রূষার জন্য আসলাম। এ সময় হযরত উবাইদুল্লাহ (রাঃ) প্রবেশ করলেন। তখন হযরত মাকিল (রাঃ) বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করে শোনাবো যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। তিনি বলেন, কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল আর তার মৃত্যু হল এই হালতে যে, সে ছিল খিয়ানাতকারী, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন”।

আমরা সবাই দোয়া করি- আল্লাহ যেন আমাদের ন্যায়বিচারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমাদের যেন মজলুম না বানান, জালিম ও না বানান। (আমিন)

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ