বাউণ্ডুলেঃ ‘প্রহর গুনে তাদের সূর্য উঠে, সূর্য ডুবে’
ভিক্টর হুগো’র লা-মিজারেবল এর নায়ক জাঁ ভালজাঁর জীবনটা আমাকে কাঁদিয়েছিল সেই প্রথম পড়ার সময়। আজ ২৬ বছর পরও জাঁ ভালজাঁ আমাকে কাঁদায়। কাঁদি তার দুঃখ ভরা জীবনের কাহিনী পড়ে। ব্যথায় নীল হই আবেগের ছলনায়। তবুও পড়ি, তবুও কাঁদি।
এই লেখাটা যাদের নিয়ে লিখব বলে ভেবেছি, তাদের পরিচিতি এই সমাজে খুব কম। আর আমার লেখাটার সূচনা কিভাবে করবো তা খুঁজে না পেয়ে এলোমেলো ভাবে জাঁ ভালজাঁকে টেনে আনলাম। সচরাচর যদিও এদের সাথে জাঁ ভালজাঁর কোনো মিল নেই, তবুও পরোক্ষভাবে অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি।
জালাল, রাশেদ, ছত্তার, উস্তার, হারিস, দানই, মিছিরেরা একই পাড়ার লোক। তাদের বসতি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের এক পাহাড়ী উপত্যকায়। তাদের মতো আরও কয়েকজন ছিল সেই পাড়ায়। তারা একসময় জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ভোরে তারা জঙ্গলে যেত, দুপুরে কাঠ নিয়ে বাড়িতে আসতো। কিছু সময় বিশ্রামের পর সেই কাঠ কাঁধে নিয়ে তিন কিলোমিটার দূরের বাজারে যেত। বিক্রি করে চাল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে স্ত্রী সন্তানদের কাছে ফিরে আসতো- ঠিক সন্ধ্যায়, পাখিদের ফেরার মতো। স্ত্রীরা চুলায় ভাত তরকারি চাপাত আর পুরুষেরা বসতো ছেলে মেয়েদের নিয়ে। বাচ্ছাদের চোখে ঘুম আসার আগ পর্যন্ত চলতো রূপকথার আসর। তারপর সবাই একসাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে, মহিলারা বাচ্ছাদের নিয়ে যেত মেঝেতে পাতানো পাঁটিতে ঘুম পাড়াতে আর পুরুষেরা সবাই বসত যেকোনো এক বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা বারান্দায়। গল্প-গোজব, হাসি-খুশি, সুখ-দুঃখ, মুখের ভাষায়, চোখের ভাষায় ফোটতো অনেক রাত পর্যন্ত। তারপর নিজ নিজ কুঁঠিরে শক্ত বিছানায় ক্লান্ত দেহটা নিতর করে রাত্রি পার। ভোরে উঠে দু’মুঠো ভাত পেঠে দিয়ে আবার জঙ্গলে; দুপুরে ফেরা, বিকেলে বাজার, সন্ধ্যায় আবার নীড়ে ফেরা, রূপকথার গল্প, বিছিন্ন আলাপ, আবার ক্লান্ত দেহ নিতর করে রাত্রি পার। এভাবেই কাঠুরিয়া পাড়ার কাঠুরিয়াদের জীবন চলতো প্রতিনিয়ত। তবুও তারা সুখী ছিল, স্বপ্ন ছিল চোখে-মুখে। কষ্ট হলেও তিন বেলা ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীদের এক মুঠো ভাত জুটতো। শীতের সময় একটা কাঁথার ব্যবস্থা হতো। ঝড় বাদলের দিনে কুঁড়ে ঘরে নিশ্চিন্তে থাকতো। তাদের অনেক আশা ছিল ভবিষ্যতে তাদের এই জীবন পরিবর্তন হবে। তারা আরও একটু উন্নতি করবে। তারা তো কঠিন পরিশ্রম করছে; তাদের তো উন্নতি হওয়ারই কথা।
কিন্তু বাস্তব হলো ভিন্ন। সেই ২৬ বছর আগের জামাল, রাশেদ, মিছিরদের মধ্যে আজ অনেকেই নেই। বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে তারা চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে। যারা চলে গেছে তারা তো গেছেই। কিন্তু যারা আজও বেঁচে আছে অশীতিপর বৃদ্ধ হয়ে; তারা কালের স্বাক্ষী হয়ে তাদের সেই ভবিষ্যতের অকালে মরণকে দেখছে ঝাপসা চোখে।
আজ এই কাঠুরিয়া পাড়া মৃত্যুপুরি হয়ে গেছে। যেই সাহসী লোকেরা তাদের ছেলে মেয়েদের উন্নতির স্বর্গ স্বপ্নে দেখেছিল, আজ সেই তারাই বারান্দায় বসে, উপোস থেকে, দেখছে বাস্তব জীবনের নরক যন্ত্রণা। নেই আজ আর কাঠ কাটা। কালের প্রবর্তনে তাদের ছেলেরা কাঠ কেটে দু’বেলার ভাতও জুটাতে পারত না। তাই তারা অন্য পেশার সন্ধানে বাড়ী ছেড়েছে। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় আজও তাদের কোন পরিবর্তন হয়নি। বৃদ্ধরা নিজেদের কাছে নিজেরাই প্রশ্ন তোলে- আমারা তো কাঠ কেটে সংসার সুখেই চালিয়েছি; কিন্তু আজ কেন এই উপবাস করা, বৃষ্টিতে ভেজা, শীতে হাড় কাঁপানো? এটা কার দোষ- আমাদের না সমাজের?
আজ যখন বৃদ্ধরা তাদের নিজ নিজ বারান্দায় বসে উদাস নয়নে আকাশ দেখে, তখন পাড়ার ষোড়শীরাও বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে আনমনা হয়। পরনে তাদের ছিন্নভিন্ন জামা। এখন তাদের আকাশে বাতাসে রঙিন স্বপ্ন উড়ানোর বয়স। কিন্তু খালি পেঠে, ছিন্নভিন্ন কাপড়ে কি আর স্বপ্ন ওড়ানো যায়। তাই তারা নীরব- নেই চাঞ্চল্য, নেই আশা, নেই স্বপ্ন; আছে শুধু হতাশা। কে আসবে তাদের রাজ্যে। এই দুর্বিহ জীবনের খেলায় তারাতো মলিন হয়ে গেছে। কিন্তু তারা যদি তিন বেলা খেতে পেত, সুন্দর দু’টি জামা পেত, তাহলে তারাও হতে পারতো ট্র’য়ের হেলেনে কিংবা অপরূপ ভেনাস। মেয়েদের এই হতাশা দেখে বৃদ্ধরা কাঁদে, কাঁদে নীরবে নিভৃতে। প্রজাপতীদের এই মলিন, নিরাশ জীবনের জন্য কে দায়ী- সমাজ না তারা; এ প্রশ্নের উত্তরের খুঁজে তাদের ব্যাকুল প্রহর আনমনেই কেটে যায়।
“দৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি, আগের মতো গোলাপ ফুল/ কথার সুরে ফুল ফোটাতাম, হয় না এখন আর সে ভুল”- নজরুলের এই গানটা মনে হলে তাদের হৃদয় আজকাল ভারি হয়ে আসে। আগের সব শুধুই বালিয়াড়ি। তাদের কথাগুলো একদিন আকাশ জুড়ে শরৎ মেঘের মতো আনাগোনা করেছে। শব্দের আঁকশিতে তাদের পেড়ে রাখা হয়নি। আজ তাদের পিপাসা নেই, নেই দুঃখ, নেই বেদনা, নেই সেই রূপকথার রাত। যৌবন বিদায় নিয়ে আজ তারা বৃদ্ধ। স্বপ্নরাও বিদায় নিয়ে গেল। এখন মৃত্যুর প্রহর গুনে সূর্য উঠে, সূর্য ডুবে। তারা চলে যেতে চায় আবেগহীন, নিঃষ্পাপ, নিঃকলঙ্ক থেকে।
এরকম কিছু দিন আছে। আর আছে এ রকম কিছু রাত। যখন বেলুন ওড়ে লাল নীল সবুজ রঙিন আকাশের মেঘ ছোঁয়ে। শ্রাবণের মেঘে কষ্টরা কবিতা লিখতো, দুঃখরা তার কাছে পড়তো এবং শিখত। সেই কাঠুরিয়াদের স্বপ্নরা উড়তো আকাশে-বাতাসে। তাই আজ বিরহের অক্ষরগুলো আকাশেই ভাসে। আজ সন্ধ্যা নেমেছে তাদের জীবনে। অতীতের দিনগুলো তাদের তাড়ায়। তাদের এই দুঃখের সময় নিভৃত নীলে কোকিল গান গায়। ক্ষুধার জ্বালায় আর ঘুম আসেনা। ঝাপসা চোখ আর স্বপ্ন দেখেনা। দু’চোখ বেয়ে শুধু জল নামে- তা কি কান্না, নাকি অন্য কিছু?
মাঝে মাঝে তাদের স্মৃতির ড্রয়ারে টান পড়ে। সে এক সাম্রাজ্য ছিল, ছিল এক যুদ্ধের সময়। সে এক বাহন ছিল হ্রেষাধ্বনি করে ওঠা- আরবের পেট্রলে যে চলতোই না। সে এক সময় ছিল। সে এক জীবন ছিল ঘুমে, শব্দে, পদ্যে, গদ্যে, আন্দোলনে, মিছিলে, মিটিংয়ে, জঙ্গলে, হিংস্র পশুর ডাকে, রক্ত মাখা আহত সময়ে। আজ তারা আর সেই সময়ের কিছুমাত্র দেখেনা। কিন্তু আমি দেখি অডেন, সুধীন দত্ত আজও সেই পঞ্চাশের দশকের মতো মিশে যায় অর্কেস্ট্রায়। এই বৃদ্ধরা ছাড়া কেউ জানে না- জীবন কী দূরন্ত প্রবল একটা তোলপাড়ের নাম!
বহু আগে কাঠুরিয়া পাড়ার এক বৃদ্ধের কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম। স্মৃতি প্রতারনা না করলে হয়তো গল্পটা ছিল এ রকম-
চলার পথে এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে এক যুবকের। মেয়েটি তখন তার বাবার সাথে দূর দেশ থেকে নিজের দেশে যাচ্ছে। মেয়েটিকে দেখেই যুবক তাকে ভালোবেসে ফেলে। তাকে পাওয়ার জন্য সে উতলা হয়। মেয়েটিরও ছেলেটিকে পছন্দ হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই মুহূর্তে বিয়েটা করা সম্ভব নয়।
মেয়েটার দেশ ছিল এখান থেকে সাত সাগরের ওপারে। বিদায়ের সময় মেয়েটি ছেলেটিকে বলে গেল- যদি তুমি সাত সাগর পার হয়ে আমাদের দেশে কোনো দিন আসতে পার- তবে তোমাকে আমি বিয়ে করবো।
কিছুদিন পর ছেলেটি সাত সাগর পার হয়ে প্রেমিকার দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। প্রথমে সে হাজির হলো প্রথম সাগরের পাড়ে। সেখানে সে দেখা পেল এক খেয়ামাঝির। সেই পারবে তাকে সাগরের ওই পাড়ে নিয়ে যেতে। খেয়ামাঝি তাকে একটা শর্ত দিল। এই দুরূহ পথের পারানির কড়ি হিসেবে তার হৃৎপিন্ডের সাত ভাগের এক ভাগ মাঝিকে দিয়ে দিতে হবে।
যুবক ভাবলো- এ আর এমন কী, এমন ভালোবাসার প্রেমিকাকে পেতে সে অনায়াসেই তা দিতে পারে। মুহূর্তে সে রাজি হয়ে গেল। সাগর পেরোবার পর মাঝিকে হৃৎপিন্ডের সাত ভাগের এক ভাগ দিয়ে সে এগিয়ে গেল দ্বিতীয় সাগরের ধারে। দ্বিতীয় মাঝির চাহিদাও একই। পারানির কড়ি হিসেবে তার হৃৎপিন্ডের অবশিষ্ট ছয় ভাগের এক ভাগ দিয়ে দিতে হবে। ছয় ভাগের এক ভাগই তো মাত্র- এ আর এমন কী। এবারেও সে রাজি হয়ে গেল। এভাবে এক এক করে হৃৎপিন্ডের ভাগ মাঝিদের দিয়ে সে যখন তার প্রেমিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো- তখন তার প্রেমিকাকে দেওয়ার মতো হৃদয় বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এটা একটা রূপক গল্প। হয়তো অতীতের কোন সম্পন্ন রূপকথার। কিন্তু কী গভীর ভাবেই না আমাদের কালের কথা বলছে। বলছে সেই বৃদ্ধ কাঠুরিয়াদের কথা। হাজারও লোভ ও বৈষমিক চাওয়া-পাওয়ার ঘাটে হৃদয়কে কেটে কেটে বিলিয়ে দিয়ে আমাদের নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কাহিনী।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান