কেউ ফিরে আসেনি
আজকের এই দিনে সুমনের কথা খুব মনে পড়ে অদিতির। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছিল দু’জন; সেই যখন থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু তখন থেকে।
আসলে অদিতি আর সুমন দু’জনের বাবা একই হসপিটালে কাজ করতেন আর থাকতেন পাশাপাশি দুই কোয়ার্টারে।
যদিও সুমন অদিতির থেকে প্রায় মাস দেড়েকের বড় তবুও তাদেরকে সমবয়সীই বলা চলে।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল; কিন্তু সুমনের বাবা হঠাৎ করে বদলি হয়ে চলে গেলেন একেবারে তুফানগঞ্জে। কোথায় উত্তরবঙ্গ আর কোথায় দক্ষিণবঙ্গ!
অদিতির মনে পড়ে- সেদিন খুব কেঁদেছিল সে। তার মাও কম কাঁদেননি। বাড়িতে রান্না চড়েনি দু’দিন।
তারপর সময়ের পলি ঢেকে দিয়েছে সবকিছু। সবাই সবকিছু ভুলে গেল খুব তাড়াতাড়ি।
কিন্তু অদিতির মনের কোনো এক কোণে আজও সুমনের স্মৃতি রয়ে গেছে।
অদিতি যখন ভাবনার অতলে ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছিল ঠিক তখনই মোবাইলটা বেজে উঠলো। নিজেকে নিজের মাঝে ফিরিয়ে আনলো অদিতির। অহনার ফোন।
— কিরে আজ ইউনিভার্সিটি যাবি তো?
— হ্যাঁ, যাবরে। আজ কিছু পেপার জমা দিতে হবে।
— শুনেছিস আজ আমাদের ডিপার্টমেন্টে একটা হেল্থ সেমিনার হচ্ছে। আমি তার সমন্বয়কারী। তোকে কিন্তু আমি ইনভাইট করছি। ওখানে পৌঁছালেই কার্ড পেয়ে যাবি। আমি তোর কথা আলাদাভাবে বলে রেখেছি। জানিস, এই সেমিনার লিড করবেন বিশিষ্ট ডাক্তার সুরেন চন্দ্র।
নামটা শুনেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে অদিতি। সুরেন চন্দ্র?…
ডাক্তার সুরেন চন্দ্র!!! সুমনের বাবা! অদিতির মনের আকাশে শঙ্খচিল ওড়তে শুরু করে। চারিদিকে যেন বাতাসের অদ্ভুত ফিসফিস একটা কথাই বলে যায়- কিছু হবে! কিছু পাবে; অথবা কিছু হারাবে!
সেমিনার শুরুর আগেই অদিতি যথাস্থানে উপস্থিত। মনের গহিনে কে যেন নড়ে চড়ে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায় বারবার- সুমন!
এবার সে সুমনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম পেয়ে যাচ্ছে। পেয়ে যাচ্ছে শৈশবের সেই দিনগুলির ছায়া। হয়তোবা পেয়ে যাচ্ছে সুমনকে!!
এ ভাবনাটাই তাকে লজ্জারাঙা করে দিল। নিজেকে বোকা মনে হলো। সুমনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মাঝে বেশ অনেকটা বছর কেটে গেছে। সে সময়ের কিছুই জানে না অদিতি। জানে না সুমনের মনে এখনো সে আছে কিনা!
ডাক্তার সুরেন চন্দ্রের আগমন অন্যরকম একটা আবহের সৃষ্টি করলো। উপস্থিতির মাঝে যেন একটা আলোড়ন বহে গেল। এতবড় ব্যক্তিত্বকে কাছে পেয়ে সবাই যেন আত্মহারা।
কিন্তু অদিতির দৃষ্টিতে ধরা পড়লো অন্য কিছু- সুমন! দেহ কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া একটুও বদলায়নি সে। চেহারাটা ঠিক সেই আগের মতো; চুলগুলোও সেই সোনালী অতীতের স্মৃতি বহন করছে এখনো।
অদিতির পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে হারিয়ে ফিরে পায় বারবার। একসময় সে চুপিচুপি এগিয়ে যায় সুমনের দিকে।
হঠাৎ করে অহনা উড়ে এসে ঢলে পড়ে সুমনের গা’য়। তাকে সাদরে গ্রহণ করে সুমন। দু’জনের চোখের ভাষায় যেন আশারা গান গেয়ে ওঠে। এবার অদিতি নিজেই থমকে দাঁড়ায়!
অহনাই পরিচিতি পর্বের সঞ্চালক হয়ে যায়। সুমনের সাথে তার পরিচয়, প্রেম আর প্রণয়ের গল্প বলে যায়। শিগ্রীই তারা পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে পরস্পরের হচ্ছে তাও জানায়।
অদিতি যেন পাথর। অচঞ্চল দৃষ্টিতে সুমনের মাঝে নিজের অস্তিত্ব খোঁজে বেড়ায়। কিন্তু সুমন যেন অহনার মাঝে নিজেকে খোঁজতে ব্যস্ত।
অতঃপর ক্ষণকাল পরে অদিতিকে চিনতে পারে সুমন। চমকে ওঠে সে! তার চোখের ভাষায়, শরীরের ভাষায় অদিতিকে ফিরে পাওয়ার আকুল আর্তনাদ প্রকাশিত হয়।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান