বাউণ্ডুলেঃ অসমাপ্ত বাস্তবতা

রিমঝিম বৃষ্টির অবিরাম ছন্দ। আকাশে মেঘেদের দৌড় খেলা। সূর্যের মুখ দেখা যায় না আজ বেশ কয়েকদিন। পোয়াতি প্রকৃতিকে শীতল করতে বর্ষার অক্লান্ত চেষ্টা। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রাকৃতির বিচিত্র রূপ প্রকাশিত। কর্মজীবন স্তব্ধ। ঘোলাটে প্রহর ধীরে ধীরে সন্ধ্যার দিকে প্রবাহিত। এমন সময় লাল মারুতিতে চড়ে তুমি এলে আমার ফুটপাতের ঠিকানায়! মাতাল করা পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আবেগমাখা কন্ঠে জানালে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর স্বপ্নের কথা!

কিন্তু এ অসম বাস্তবতার কথা চিন্তা করে তোমাকে কিছু বলতে পারিনি। তুমি উত্তরের অপেক্ষায় থাকবে বলে চলে গেলে আর আমি ধপাস করে বসে পড়লাম এক পাগল ভিক্ষুকের পাশে।

তোমার ভালোবাসায় হয়তো কোন খাদ নেই। তবুও আমি অক্ষম। আর অক্ষম বলেই তোমাকে একটা অসমাপ্ত বাস্তবতা লিখে আমাদের অশান্ত জীবনের শান্ত কাহিনীর মাধ্যমেই ক্ষমা চাইব।

(২)
মনটা এখন বড় অস্থির। বিশেষ করে বাজারের আগুনে সংসার জ্বলার উপক্রম। ক্ষুদার জ্বালায় অস্থির সবাই। মাফ করবে, সবাই নয়! অস্থির শুধু আমরা- যারা তোমাদের কাছে এখনো মানুষ নামের স্বীকৃতি পাইনি।

তোমরা যখন দেশের হালহকিকত ও সংবাদ বিশ্লেষণে ব্যস্ত আমরা তখন দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতর।

ক্ষুদায় ছটফট করা ছোট শিশুটির কান্নার ধাক্কায় যখন ছিটকে এসে বাজারে পড়ে একজন বাবা তখন তার দু’টো চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। আবার যখন বাজারে কোন কিছু কিনতে না পারার ব্যর্থতায় কাতরাতে কাতরাতে মাথাটা নিচু করে ফিরতে হয় তখন বিষের শিশি অথবা ফাঁসের দঁড়ি ছাড়া আর কিছু চোখের সামনে ভাসে না।

তোমরা তো এসব দেখেও দেখ না। একতলা থেকে দু’তলা এভাবে দশতলা বানিয়ে দক্ষিণের জানালা খুলে বগল বাজাও আর রঙিন স্বপ্ন দেখ- যে স্বপ্নে আমরা কোন ভিত্তি খুঁজে পাই না। জিজ্ঞেস করতে পারি- আর কতো ঠ্যালবে আমাদের; এর কি কোন প্রতিকার নেই? শুধু সান্ত্বনার বানী আর ভালোবাসার কথা শুনিয়ে আর কতো ক্ষুধার্ত রাখবে আমাদের?

সবাই তো অনুগত্য ভৃত্যের মতো সাহসের জলাঞ্জলি দিয়ে নির্বাক হেঁটে চলছে। কিন্তু আমরা যে হাঁটার ক্ষমতাটাও হারিয়েছি- সে কথাটা কি তুমি জানো? না জানলে এখন জেনে রাখ।

তোমার এ ভালোবাসা সাময়িক মোহ ছাড়া আর কিছু নয়। যদি পার আমাদের হাঁটার ক্ষমতাটা ফিরিয়ে দাও। তাহলেই এ মোহ থেকে বাহির হতে পারবে। আর যদি তা না পার তাহলে এভাবে নির্বাক চেয়ে চেয়ে আমাদের হাড্ডিসার দেহটার প্রতি আর মিথ্যে ভালোবাসার দৃষ্টি দিও না।

তোমরা নির্বাক বসে আমাদের কষ্টটা নিরবে সহ্য করো না- একটু হলেও আমাদের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করো। শুধু ভালোবাসায় আমাদের এই বহুদিনের অভুক্ত পেটটা ভরবে না। নিরাপত্তাহীনভাবে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় অস্থির পদচারণ- তোমরা হয়তো বলতে পারবে এসব কার স্বার্থে। কিন্তু আমরা এর ধারে কাছেও ভাবতে পারি না। তবুও একটা কথা বলবো, বলবো শুধু তোমাকেই; আমি রাস্তার মানুষ, রাস্তায় থেকে বটবৃক্ষের মতো কালের স্বাক্ষী হয়ে শুধু এটাই জেনেছি- হালটানা বলদের মতো আমাদের জীবটাকে আমরাই টানতে হবে।

আজ যারা বলছে এটা ভালো নয়, কাল তারাই আবার বলছে এটা ভালো! এই ভালো আর ভালো নয়- এটা আসলে কার জন্য? আমরা কি এজন্যই রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে জীবনকে খুঁজি।

তুমি কি বলতে পার- আমাদের প্রকৃত ভালোটা দেখবে আসলে কে? আমাদের এই ভালোটা দেখার মতো কাউকে পাইনি কোনদিন, মনে হয় আর পাবও না। তাই যতদিন বাঁচি এভাবেই বাঁচতে হবে, এভাবেই জীবনের ক্লান্তি ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে বারবার ‘‘জোর যার মুল্লুক তার’’ নাটকের দর্শকের ভুমিকায় অভিনয় করতে হবে।

সবকিছু একসাথে হয় না। সবকিছু একসাথে করতেও বলি না। তোমরা যারা প্রেম প্রত্যাশী তারা আবেগ রেখে বিবেক দিয়ে আমারদের দিকে নজর দাও। তোমরা হয়তো জানো না- টাকার বিনিময়ে দৈনিক শ্রম যারা বিক্রি করে, তাদের তো সাতসকাল থেকে পণ্যের মতো ফুটপাতে নিজেকে সাজিয়ে রেখে ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

জানো না হয়তো- অনেকে প্রায়ই অবিক্রিত হয়ে সকরুন চোখে ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে ক্ষুধার্ত পরিবারের কাছে ফিরতে হয় ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে। এখানে বেঁচে থাকার কি দারুণ মহড়া চলছে প্রতিনিয়ত। আর তোমরা সেই মহড়ার সফলতায় হাততালি দিয়ে দাঁত বের করে হাসো। কিন্তু যারা বিক্রি হয়, দিন শেষে তারও প্রায় সেই একই মহড়ায় অংশ নিতে হয়। দ্রব্যমূল্যের আকাশ ছোঁয়া দাম তাদের হাতে পায়ে শিকল বেঁধে দেয়।

তাই বলি তোমাদের শত কর্মব্যস্ততার মাঝে আমাদের দিকে একটু নজর দাও। করুণা নয়, দান নয়, সান্ত্বনা নয়, মিথ্যে ভালোবাসা নয়; শুধু তিন বেলার খাবরের অধিকারটায় ভাগ বসিও না- তাহলেই হবে।

প্রতিদিন কতো খুন, কতো বিশৃংখলা, কতো সড়ক দুর্ঘটনায় লাশ হওয়া সন্তান বাবার কাঁধে চড়ে পরপারে যাত্রা করে। কতো সমস্যার বন্যা বহে যায় প্রতিনিয়ত। এসবের ফাঁক গলে অনেক দূরে চোখ মেলেও তোমার মতো শান্তির পায়রা দেখি না।

বেঁচে থাকার চেষ্টায় হাসফাঁস করে উঠে মন। গাড়ির হর্ণের শব্দ আর কালো ধোঁয়ায় আমরা এলোমেলো। রোদে পোড়া মানুষের ক্লান্ত চেহারা আর মজুরের শ্রমে-ঘামে তোমাদের জীবন পূর্ণতা পায়। তারপরও আমরা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। গ্রামের সবুজ মাঠের শ্যামল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দিগন্তে চোখ মেলে দেখি- তোমাদের ইঁট পাথরের অট্টালিকা গড়ার প্রতিযোগীতা, দেখি নিরন্তর যান্ত্রিক সভ্যতার সান্নিধ্যে কাটানো রঙিন জীবনের বিলাসিতা।

এসব দেখেও থামি না, পাখির ডানায় ভর করে বিকেল দেখায় ব্যস্ত হই। দেখি- অর্থের পেছনে নিরন্তর ছুটতে ছুটতে তোমাদের নিজ শেকড় পেছনে ফেলে অবলম্বনহীন হয়ে যাওয়া।

তোমাদের ব্যথা আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ব্যথা তোমাদের কাছে হয়ে যায় প্রহসন। এরপরও স্বপ্ন দেখার পালা থামে না। ঘামে ভেজা শরীরে ঘরমুখো সওয়ারিও দিবা স্বপ্ন দেখে। না, পারব না তোমাদের মতো হতে। পারব না তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে তোমাদের মতো মিথ্যে আশার বাণী শুনিয়ে চাইনিজে অথবা রমনার বটমূলে তোমার সামনে বসে হা হা হি হি করতে। পারব না অপেক্ষায় থাকতে একটা স্নিগ্ধ সময়ের!

তোমাদের আর আমাদের দেখা এক নয়। তোমাদের অনেক কিছু বাস্তবের সাথে মিলে না। অর্থনীতির অনেক সূত্র তোমাদের জানা। কিন্তু বাজারে তো এর কোন ছায়া দেখি না। অন্য দেশের বাজার সম্পর্কে জানার ক্ষমতা আমার হয়নি, তবে আমাদের বাজার সম্পর্কে একটু ধারনা আছে। এখানে বাজার চলে বাজারের মতো! বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের ধ্যান-ধারনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে এখানে অদৃশ্য ইশারায় বাজারের চাহিদা- যোগান নির্ধারিত হয়।

তোমাদের গাড়ির জন্য আমরা অচল হয়ে পড়ি। তোমাদের পরিবারের সবার নিজ নিজ পরিধেয় বস্ত্রের সাথে ম্যাচ করে একেকজন একেক দিন লাল, নীল, সাদা, কালো গাড়ি ব্যবহার করো। আর সেই গাড়ির জ্যামে পড়ে আমাদের পনেরো মিনিটের পথ তিন ঘন্টায় পেরুতে হয়। বড় বিচিত্র!

হিসাব করে দেখলাম জীবনের অর্ধেক আয়ু রাস্তাই শেষ হয়ে যায়। এই বিশৃংখলায় তোমাদের তো কিছুই যায় আসে না। তোমরা তো তোমরাই! কিন্তু আমরা তো হুড তোলা রিক্সায় বসে অস্থির সময় পার করতে করতে বৃদ্ধ হওয়ার আগেই বৃদ্ধ হয়ে সময়ের আগেই সময়কে বিদায় দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হই।

লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ