নিশী মানবী

বসন্তের প্রথম সূর্যের সাথে উদিত হলো আরেকটা সূর্য। জীর্ণ ছোট একটা কুঁড়ে ঘরে এই সূর্যের আলো প্রতিফলিত হলো। চিৎকার করে সে তার অস্থিত্ব জানাল ধরনীকে। মায়ের মুখেও সূর্যের হাসি দেখা দিল। কিন্তু তারপরও সূর্যের মতো বাস্তব সত্য হলো- এই গর্ভধারিনী নিজেও জানে না এই নিষ্পাপ শিশুর পিতা আসলে কে! তার ভ্রাম্যমান জীবনে কতজনই তো প্রতিদিন আসে- যায়। সে নিজেও জানে না কখন, কিভাবে, কার দ্বারা এই নিষ্পাপ শিশুকে বহন করতে শুরু করেছে। তবুও পৃথিবীর সব নারীর মতো সেও নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করলো। খুশিতে আত্মহারা হলো এই ভেবে- এখন সে একজন মা।

এই নিশী মানবী শিশুটির নাম রাখল নুরজাহান। তার এই অভুক্ত জীবনে, খদ্দরের হাতের দিকে চেয়ে অতিবাহিত সময়ের মাঝেও নুরজাহানের প্রতি কোন অবহেলা দেখা যায়নি কোনদিন। তবুও নুরজাহান বিকশিত হতে পারেনি। সমাজের কাছে নুরজাহান মায়ের মতোই অবহেলিত হয়ে বড় হতে লাগল।

নুরজাহানের বয়স যখন আট; একরাতে একজন লোক এসে তার মাকে ডেকে নিয়ে গেল। নুরজাহান মাঝে মাঝে দেখে, এভাবেই তার মা যায় এবং কিছু সময় পর আবার ফিরে আসে। কিন্তু ঐ রাতের যাওয়া শুধু যাওয়াই, আর ফেরা নয়। মা আর ফিরে এলো না। শিশু নুরজাহান এরপর থেকেই হয়ে গেল এই সমাজের বড়লোকদের বাসার কাজের মেয়ে নুরী। ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হতে লাগল আর নুরীও স্থানান্তর হতে লাগল বাসায় বাসায়।

একসময় নুরীর স্থান হলো আমজাদ সাহেবের (ছদ্ম নাম) বাসায়। নুরী এখন যুবতী। এ সমাজে অসহায় যুবতীদের যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, নুরীও এর ব্যতিক্রম নয়। যৌবনবতী নুরীর উপর আশ-পাশের সবার কুদৃষ্টি। এ সমাজের ঘুনে ধরা কিছু সুযোগ সন্ধানী মানব সন্তানের কুদৃষ্টি নুরীকে আশ্রয়হীন করে তোলে। নুরী নিজেকে বড় অসহায় ভাবে। ভাবে তার এ যৌবনের পরিণতি নিয়ে। সে তো যেকোন মুহূর্তে এই শিয়াল কুকুরদের খাবার হয়ে যেতে পারে। ভাবলেই ভয়ের শির শির হাওয়া বয় তার সারা শরীর জুড়ে। তাই আশ্রয়হীন নুরীর অবুঝ মন একটা আশ্রয়ের জন্য ছ্টফট করে।

নুরীর এমন অস্থির সময়ে একদিন আমজাদ সাহেবের ছোট ছেলে শিমুল এক আশার বাণী শুনাল। সে নুরীকে চায়। নুরীর জন্য সে জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু নুরী জানে এই ভালোবাসার যবনিকা অসমাপ্ত। এ কখনো হয় না; এটা হওয়ার নয়। তার ব্যকুল মনে অস্থিরতা আরও বাড়তে লাগে। একবার চায় শিমুলকে লতার মতো জড়িয়ে ধরতে; পরক্ষণে এ অসম ভালোবাসার পরিণতির কথা ভেবে মনকে থামায়। কিন্তু শিমুল নুরীকে ছাড়া আর কিছু শুনতে রাজি নয়।

শিমুলের এ ব্যস্ততার একটা কারণও আছে। শিমুলের যৌবন এ মুহূর্তে আবেগময়। আর এই আবেগময় মনে আরও রেখাপাত করে সেদিনের একটা ঘটনা। সেদিন দুপুরে নুরী যখন কলপাড়ে গোসল করে তখন শিমুল তার রুম থেকে নুরীকে দেখতে পায় এবং অবাক চোখে জানালার কপাট একটু ফাঁক রেখে দেখতেই থাকে এই অপূর্ব দৃশ্য। নুরী যখন সম্পূর্ন ভেজা, তখন তার শরীরের প্রতিটি রেখা প্রতিরেখা স্পষ্ট ফুটে উঠে কাপড়ের ওপর দিয়ে। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া শিমুল নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। এরপর থেকেই তার দু’চোখে সবসময় নুরীর ভেজা শরীর ভাসে। সে পাগল হয়ে যায় এবং নুরীকে তার ভালোবাসার কথা বলে।

শিমুলের চলনে-বলনে নুরী একসময় পরাজিত হয়। তার অবুঝ মন একটা আশ্রয়ের খুঁজে যখন ব্যস্ত তখন শিমুলের আশ্বাস বাণী তাকে মন্ত্রণা দেয়। সে পরিণতি ভুলে যায় এবং শিমুলকে আঁকড়ে ধরে। আর আগুনের কাছে মোম গেলে যা হয় তাই হলো শিমুল ও নুরীর মাঝে। নুরীতো আশ্রয়ের আশায় সবকিছু ভুলে গেল, শিমুলের কাছে আত্মসমর্পন করলো। আর শিমুল তো শুধু নুরীর শরীরে ব্যাকুল এবং যা পাওয়ার আশায় নুরীকে এত আকুতি করলো- তা পেয়েই চম্পট।

শিমুলের এমন আচরনে নুরী তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তবুও সে শিমুলের কাছে কান্না-কাটি করে। শিমুল মনে মনে তার কর্মচিত্র আঁকে। এই তো সুযোগ, আশার বাণী শুনিয়ে যা নেওয়া যায়, যতদিন নেওয়া যায়, নিতেই থাকি। সে নুরীকে আরেক আশার বাণী শুনায় এবং তার কাজ সে আদায় করতে থাকে।

এভাবে একদিন নুরীর অন্তঃসত্ত্বার খবর সবার কাছে প্রকাশ পায়। প্রকাশ পায় শিমুলের কাণ্ড। আমজাদ সাহেব নিজের সম্মান রক্ষার্থে নুরীকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং ভারমুক্ত করেন। এরপর থেকেই নুরী যেন কেমন হয়ে যায়।

পথের নুরী পথেই চলে যায়।

কিন্তু নুরী এখন আর শিশু নয়, নুরী এখন ফুটন্ত গোলাপ। এ পৃথিবীতে নুরীর কেউ নেই। নুরী অসহায়। ধরনীতে রাত নামলে অমাবশ্যা নামে নুরীর জীবনে। রাত যাপনের একটা আশ্রয় না পেয়ে ঐ রাতেই নুরী আবার ধর্ষিত হয়। সেই থেকে শুরু!

সেই থেকেই নুরী নিশী মানবী। আজও নুরী আছে এবং অনেক ভালো আছে! নেই তার পিছু টান, নেই কোন অভিযোগ। লোকজন আসে, টাকার বিনিময়ে নুরী তাদের সাথে আদিম খেলা খেলে। এভাবেই নুরী তার মায়ের জীবনে পদার্পন করে। আর এভাবেই এ সমাজে হাজার নুরী জন্ম নেয় এবং হাজার নুরীর জন্ম দেয়। এভাবেই নুরীরা অন্ধকার রাস্তায় প্রসাদনী লেপে অপরূপ সেজে, ঝলমল খোলাসে নিজেকে মোড়ে ধরা দেয় সভ্য সমাজের সভ্য(!) কিছু মানুষের কাছে।

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ