উপজেলাবাসীর কাছে এক অদ্ভুত মিলনের গল্প

রাজনগর আওয়ামিলীগের দুই মুকুটহীন সম্রাট। শুধু আওয়ামিলীগের না রাজনগরের রাজনীতিরও বলতে পারেন।

স্থানীয় নির্বাচন কিংবা রাজনৈতিক গ্রুপিং দ্বন্দ্বে দুইজন অনেক সময় দুই প্রান্তে অবস্থান করলেও একাকীত্ব জীবনে যাওয়ার সময় ঠিকই একসাথে চলে গেলেন। জীবনের অবসানে কোন কর্মসূচি ছাড়াই দু’জন নিজেদের ভালোবাসার কাছেই রাজনগরবাসীকে অবাক করে দিলেন। শত শত কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষীদের রেখে তাদের এই একসাথে যাত্রাটা কেউ মেনে নিতে পারছেনা।

উপজেলাবাসীর কাছে এটা এক অদ্ভুত মিলনের গল্প। এ কেমন বন্ধুত্ব! মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দুজনেই মহান রবের ডাকে সাড়া দিলেন।

দলীয় গ্রুপিং দ্বন্দ্বে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বাঘ-সিংহ হয়েছেন প্রায়ই। দুপক্ষের সমর্থকদের তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করতো মাঝে মাঝে। ভেলাই মিয়া ছিলেন রাজনগরের বাঘ। আর আছকির খান তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান কম কথা বলা একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ।

সবকিছুর পরেও দলীয় গ্রুপিংয়ে যাইহোক না কেন হাইকমান্ড থেকে শেখ হাসিনার স্বার্থে কিংবা দলের স্বার্থে কোন কর্মসূচি কানে চলে আসলে হাতে হাত রেখে সবকিছু ভুলে এক ব্যানারেই দাঁড়িয়ে যেতেন এই দুই ব্যক্তি। আছকির-ভেলাই যেদিন এক ব্যানারে দাঁড়িয়ে গেছেন সেদিন উপজেলা আওয়ামিলীগের চিত্র বদলে যেত।

যুবক বয়সে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আছকির খান ৪৫ বছর উপজেলা আওয়ামিলীগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জীবন যৌবনের সবকিছুই ছিল দেশ মাঠি ও বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ।

অপরদিকে মিসবাহুদ্দোজা ভেলাই মিয়া। ৯০ দশক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমানের হাত ধরে উঠে আসেন আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে। রাজনগরের বিশাল ভোটব্যাংকের অধিকারী আলহাজ্ব মিসবাহুদ্দোজা ভেলাই মিয়াকে আওয়ামিলীগের অনেক প্রয়োজন। পর্যায়ক্রমে উপজেলা আওয়ামিলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৫ থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টানা ২৫ বছর নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত জাতীয় নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন সরাসরি মাঠে থেকে।

আছকির খান আর ভেলাই মিয়ার রাজনৈতিক গ্রুপিং দ্বন্দ্বের শুরুটা একটু পর্যালোচনা করছিলাম। ১৯৯২ সালে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিছবাউদ্দোজা ভেলাই মিয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে আসেন। কারণ উনার রয়েছিল বিশাল ভোট ব্যাংক। যার কারণে স্থানীয় কোন নির্বাচনে তাঁর মনোনীত একজন প্রার্থী থাকলে একই দলের বিপক্ষে প্রার্থী থাকেন একাধিকজন। এতে তৈরি হতো দলীয় গ্রুপিং।

সেই সময়ে জেলা আওয়ামীলীগের কাউন্সিলের পর থেকে তৃনমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগে চিফ হুইপ শহীদ গ্রুপ ও এমপি মহসিন গ্রুপ স্পষ্ট হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এমপি গ্রুপের রাজনগরে নেতৃত্বে ছিলেন মিছবাউদ্দোজা ভেলাই এবং সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ মহসিন আলী এমপি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আছকির খান। তখন মহসিন আলী এমপি ছিলেন।
সেখান থেকেই মূলত রাজনগর আওয়ামিলীগে আছকির খান ও ভেলাই মিয়ার রাজনৈতিক গ্রুপিং স্পষ্ট হয়। যদিও এগুলো বিগত ২০০৯ ও ২০১৪ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আরও বাড়তে থাকে। তখনকার সময়ে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছিলনা। যারফলে গ্রুপিং দ্বন্দ্ব গুলো তৃণমূলে প্রকাশ্য ছিল।

তবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে আছকির খান কেন্দ্র আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী হোন। বিদ্রোহী প্রার্থী ভেলাই মিয়া সহ আরও দুইজন হলেও গ্রুপিং দ্বন্দ্বটা তেমন চোখে পড়েনি। কারণ সেই সময়ে হঠাৎ করেই উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহাজান খানের ভোটের মাঠ ভালো হয়ে উঠেছিল। দুইবার ভেলাই মিয়া ও একবার আছকির খান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর উপজেলাবাসী নতুন মুখ শাহজাহান খানকে নির্বাচিত করে।

সেই থেকে আছকির খান ও ভেলাই মিয়ার দ্বন্দ্ব আর নজরে পড়েনি৷ ধীরে ধীরে প্রায় দুই যুগ পর ২০১৯ সালে উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু হয়। সেই সময় নিজ থেকেই হয়তো সরে গিয়েছিলেন আছকির খান। পদের জন্য প্রার্থী হয়েও কোন বড় ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখা যায়নি তাকে। গত ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনের পরে নিরবেই অনেকটা অবসরে চলে যান তিনি। দলীয় বড় ধরনের কোন কর্মসূচি ও নিজের প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাড়ি থেকে বের হতেন না।

২০১৪ সালে আছকির খান চেয়ারম্যান হওয়ার একবছর পরেই ২০১৫ সালে মহসিন আলী ইন্তেকাল করেন। এর পরের বছর থেকে প্রায়ই ভেলাই মিয়া ও আছকির খানকে একসাথে অনেক প্রোগ্রামে দেখা যেত। তখন গ্রুপিং দ্বন্দ্ব গুলো একবারেই চোখে পড়তো না। শেষ সময়ে দুজনেই একসাথে অনেক জায়গায় উপস্থিত হয়েছেন। হাস্যরসে মঞ্চ মাতিয়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক জীবনে দলীয় গ্রুপিংয়ের শেষে চিরজীবনের জন্য যাওয়ার বেলাটাও তাদের এরকম মিল হবে এটা কে ভেবেছিল?

আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে দুইজনের আদরের হাতে আমাদের বড় হওয়া। আছকির দাদা ও আমরা বলতে গেলে একই পরিবারের। যদিও বাড়ি দুইটা। ব্যক্তি জীবনে এই দুই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। ছোটবেলার খেলাধুলা থেকে শুরু করে প্রতিদিনের রুটিনে আছকির দাদার বাড়িতে আমাদের যাওয়া আসা রেগুলার ছিল। আড্ডা ফূর্তি গল্প গুজব। মাঝে মাঝে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতেন। শাসনও করতেন।

তবে, ভেলাই দাদার সাথে আব্বুর সম্পর্ক অনেক ভালো। জেলা আওয়ামিলীগের সহ-সভাপতি আকিল মামার খুব কাছের মানুষ ছিলেন ভেলাই দাদা। সেই সুবাদে আমাদের পারিবারিক ভাবে দাদার সাথে আরও সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনেকবার দাদার কাছে গিয়েছি। উনার বাড়িতে গেলে খুব কমন একটা কথা ছিল ‘চাইরটা খাইয়া যাগি’।

আমি প্রবাসে আসার সময় আপু দেশে ছিলেন। আম্মু, আপু, আব্বুকে দাওয়াত দিয়েছিলেন ভেলাই দাদা। আমারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টিকেট খুব তাড়াতাড়ি করায় আর সেইদিন যাওয়ার সুযোগ হয়নি। যদি একবারের জন্যও জানতে পারতাম আর দেশে গিয়ে উনাকে পাবো না তাইলে সেদিন শেষ সালাম টা করে আসতাম।

প্রিয় মানুষ গুলোর চলে যাওয়া বড়ই অদ্ভুত। রাজনীতির মাঠ থেকে ব্যক্তিজীবন। সব জায়গায়ই তাদের ভালোবাসা পেয়েছি। পক্ষে বিপক্ষের সংবাদের জন্য কোনদিন জবাবদিহি করতে হয়নি। বরং ভালোবাসা ছিল বেশি। ভালোবাসা দিয়েই বুঝিয়ে দিতেন এটা এভাবে ছিলনা সেভাবে ছিল। এই মানুষ গুলোর অভাব অপূরনীয়। আল্লাহ দুজনকে ক্ষমা করে দিক। নাজাত দান করুক। আমীন।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, এশিয়াবিডি২৪ডটকম

আরও সংবাদ