তৃতীয় দফায় বন্যার কবলে সিলেট
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তৃতীয় বারের মতো বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে সিলেট। তাছাড়া রাতে সিলেটে ভারী বর্ষণে নগরের বেশ কিছু এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অনেকের বাসা-বাড়ির ভেতরে পানি প্রবেশ করে। এতে দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় তাদের।
এদিকে সিলেটের তিনটি নদীর ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬ থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি জানান, পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় সিলেটে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।
ভারতের আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, সিলেটে ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতি বৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে নদ-নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার তথ্য অনুযায়ী সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা নদীর আমলশীদ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১৫ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১৩ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ৯ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। সারিগোয়াইন নদীর গোয়াইনঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ওই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। তাছাড়া সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে, লুবা নদীর লুবাছড়া, সারি নদীর সারিঘাট, ডাউকি নদীর জাফলং, ধলাই ইসলামপুর পয়েন্টে পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুরসহ বেশ কিছু এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। অনেকের রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের। তাছাড়া সিলেটে টানা বৃষ্টিতে নগরীর উপশহর, মাছিমপুর, তেরোরতনসহ বেশ কিছু এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবে বৃষ্টিপাত থামার পর অনেক জায়গা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে।
সিলেট সদর উপজেলার ৩নং খাদিম নগর ইউনিয়নের সমাজকর্মী মুক্তার হোসেন মান্না বলেন, একটানা বৃষ্টি হলে মনে ভয় থাকে এই পানি চলে এলো। তাছাড়া প্রবল ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের শঙ্কাও রয়েছে। গতকাল বিকেল থেকে আমার বাড়ির উঠোনে হাঁটুপানি। ঘরের আসবাবপত্র সরিয়ে উঁচুস্থানে তুলে রেখেছি। সকাল থেকে বৃষ্টি কমছে তাই পানি এখন ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। যদি আবারও বৃষ্টিপাত হয় তাহলে পানি বেড়ে যাবে।
নগরীর খুলিয়াটুলার বাসিন্দা মাহফুজ আহমেদ কবির বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই পানির সাথে আমাদের বসবাস। এলাকায় ড্রেন থাকলেও বৃষ্টির পানির ধারণক্ষমতা সেগুলোর নেই। সেই পানি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। পরিবারের সদস্য, ঘরের আববাপত্র নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয়। এ দুর্ভোগের যেন শেষ নেই।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দয়ারবাজার এলাকার বাসিন্দা আলামিন ভূইয়া বলেন, গতকালের তুলনায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এখন ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ করেনি। তবে এখনও নিম্নাঞ্চল এলাকা প্লাবিত। যদি উজানে বৃষ্টি না হয় তাহলে পানি দ্রুত নেমে যাবে।
গোয়াইঘাট উপজেলার বিছানাকান্দি এলাকার বাসিন্দা মো. মিজান বলেন, ঘরের ভেতর এখনও পানি ওঠেনি তবে চারিদিকে পানিতে টইটম্বুর। আরেকটু পানি বাড়লেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করবে। এ অবস্থায় আতঙ্কের মধ্যে আছি।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, পাহাড়ি ঢলে উপজেলার ১৫১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার ১৯টি ইউনিয়নের ১৯ হাজার ৭৫০টি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তিনটি আশ্রয়কেন্দ্রে ৮১জন আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া জানান, গতকাল পানি বৃদ্ধি পেলেও সকাল থেকে পানি নামছে। ফলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। নতুন করে বৃষ্টিপাত না হলে আরও উন্নতি হবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, বন্যা পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হচ্ছে। পানিবন্দিদের উদ্ধার কার্যক্রম চলমান রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্র ও পানিবন্দিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ চলমান রয়েছে। তাছাড়া বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে ডেডিকেডেট কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন ভিত্তিক ট্যাগ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে।