‘পীর’ শব্দকে ‘না’ বলা!

দিনটি ছিল পবিত্র রামাদ্বান মাসের মাঝামাঝির কোনোও একদিন, ইফতারের সময়। আমার প্রিয়জন, বড়ভাই এমএ আলিম ভাই সহ গিয়েছি জকিগঞ্জের ফুলতলীতে।

জানি না কেন তারও আগে থেকে ফুলতলী সাহেবের (রহ.) পরিবারের সদস্যরা আমাকে খুব স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। এই ভালবাসা আমি যখন বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষা গ্রহণের জন্য পরপর দুই বছর সেখানকার ছাত্র ছিলাম, ফুলতলী সাহেবের (রহ.) জবানিতে শুনে শুনে শুদ্ধ কোরআন শিখছিলাম, তাঁকে শোনাচ্ছিলাম, তখন থেকেই টের পেয়েছি। এরপর থেকে সেখানে গেলে যা পাই, আমি বিশ্বাস করি এই নালায়েক কোনোওভাবে তার যোগ্য না, তারপরও তা পাওয়া আমার জন্য বিষ্ময়ের! কৃতজ্ঞতার। মুগ্ধতার।

রামাদ্বানের দিন। দুপুরে জোহরের নামাজের পর ফুলতলী সাহেবের সাথে দেখা মসজিদের বাইরে। কদমবুছি করার পর পরিচয় জেনে ভালমন্দ খোঁজ নিলেন। তারপর তাঁর ছোটছেলের সাথে দেখা হলে তিনি দাওয়াত দিয়েই ফেললেন, ইফতার না করে যাবেন না।

এরপর শাহান ভাইয়ের সাথেও দেখা (শাহান ভাই, ফুলতলী সাহেবের মেঝো ছেলের ঘরের মেঝো নাতি, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক)! তিনিও বললেন, ইফতার যেন করে যাই।

আমরা ভেবেছিলাম, সিলেট ফিরেই ইফতার করবো। সে জন্য বিনয়ের সাথে বলছিলাম, ইনশাআল্লাহ!

একটা কথা বলে রাখা ভাল। ফুলতলীতে রামাদ্বান মাসে সেখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীসহ প্রতিদিন দুই/আড়াই হাজার মানুষ ইফতার আগেও করতেন, এখনও করেন। প্রতিদিন এতো মানুষের ইফতারের আয়োজন থাকে।

এর ঘন্টাখানেক পর আবার দেখা শাহান ভাইয়ের সাথে। বললেন, ছোটসাব (ফুলতলী সাহেবের ছোট সাহেবজাদা) খবর পাঠিয়েছেন, সাব (ফুলতলী সাহেব) আপনাদের ইফতার করে যেতে বলেছেন। ছোটসাবের ঘরে ইফতার করবেন।

আর যাওয়া যায়? এই জায়গা আমার/আমাদের মুর্শিদের, উস্তাদের। তার নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য নেই। সিলেটে গিয়ে ইফতার করার পরিকল্পনা বাদ। ফোন করে অফিসে জানালাম, আসতে দেরি হবে।

বাদ আছর যখন আবার ছোট সাহেবের সাথে দেখা, তিনি একই কথা মনে করিয়ে দিলেন আবার!

ইফতারের ২০/২৫ মিনিট আগে আমরা গেলাম তার ঘরে। সিটিনে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর এসে ছোটসাহেব নিয়ে গেলেন বাম পাশের রুমে। খাটের উপর ফুলতলী সাহেব বসা। সালাম দিলাম। বিনয়ের সাথে বললেন, বৌক্কা (বসেন)। আলিম ভাইর মরহুম বাবা ছিলেন ফুলতলী সাহেবের খলিফা। তিনি তাঁর খোঁজ খবর নিলেন। আমার দাদাও (মরহুম বিশ্বনাথী) তাঁর আরেক খলিফা। তাঁর কথাও জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কথা বলছিলেন সংবাদপত্র নিয়ে। এসময় তিনি নিজেই বললেন, ‘এখন কেউ ‘পীর’ কইলে ভয় লাগে। চাইরদিকে যে অবস্থা। পীর ব্যবসা শুরু অইগেছে। অপব্যবহার অর। আফনারা আমার নামো পীর লাগাইন না জানি। মানষে খারাপ পায়। খারাপ থাকি হরিয়া থাকা দরকার।’

শুনে আমি বিস্মিত হলাম। যখন এখানে-ওখানে, এ, ও— নামের পেছনে-আগে বলে কয়ে পীর লাগাচ্ছে, তখন তিনি লাগাতে নিষেধ করছেন! একজন হক্কানি আলেম না হলে বলতেন? মনে আছে, নব্বই দশকের ঠিক মাঝামাঝিতে খামিছ জামাতে পড়ার সময় আমার বাম চোখে ফুল পড়ে। আস্তে আস্তে সেটি বালুকণার মত বড় হতে থাকে। একদিন তাঁর কাছে পড়া শোনাচ্ছি। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। ভীষণ যন্ত্রণাও করছিল। তিনি তা দেখতে পেয়ে কারণ জানতে চাইলেন। রোগের কথা জানালে পাশে বসতে বললেন। বসলাম। সবার পড়া শোনা শেষে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আমার কথা। পরে হাতের আঙুল চোখের উপর ঢলে ৩ টি ফু দিলেন। বললেন, না কমলে ডাক্তার দেখাতে। তখন অবাক হয়েছিলাম, তিনি চিকিৎসকের কাছে যাবার পরামর্শ দিচ্ছেন। একজন খাঁটি মানুষ না হলে সেটা বলা সম্ভব ছিল না! বলতেন না, বরং নিজেকেই জাহির করতেন। তিনি তা না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন! কিন্তু সৌভাগ্য, আমাকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়নি। বরং পরদিনই আমি আগের মত স্বাভাবিক চোখ নিয়ে আ’ম মশকে (সবাইকে নিয়ে দিনের প্রথম সবক/পাঠদান) গিয়েছি!

সেদিন ইফতারের সময় একেবারে চলে এসেছিল। তিনি খাটের উপর বসা। নিচে বিছানা চাদর বিছিয়ে ছোট সাহেবসহ আমরা ৩ জন বসলাম। ফুলতলী সাহেবের সামনে খেজুর, খিচুড়ি আর ছোলা। সিম্পল ইফতার। আমাদের সামনে নানান পদের ইফতার। মেহমানদারির কমতি নেই! তিনি ইফতারের আগে মোনাজাত করলেন।

সেদিন মাগরিবের নামজ পড়ে বিদায় নিয়ে ফুলতলী থেকে সিলেট চলে এলাম। এদিনের পর থেকে আমি আর কোন নিউজে ফুলতলী সাহেবের নামের আগে-পরে কোত্থাও ‘পীর’ শব্দ লাগাইনি। এমন কি আমার হাতে কোন খবর এলে ‘পীর’ শব্দ কেটে তারপর ছেপেছি।

এরপর থেকে তাঁর নামের সাথে ‘পীর’ তো লাগতোই না, সাথে বিশেষণগুলোও কমে গিয়েছিল! কিন্তু আল্লাহ তাঁর মর্যাদা, মহিমা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

১৫ই জানুয়ারি তাঁর ওফাতের দিন। আল্লাহ আমার উস্তাদ, আমার মুর্শিদ, আমার এই পথ প্রদর্শককে তুমি জান্নাতের উচ্চ মাকামের অধিকারী কর। তাঁকে আরও মর্যাদাবান করো। আমিন।
লেখক:সালমান ফরিদ,সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এশিয়াবিডি২৪/শেখ মোজাহিদ

আরও সংবাদ