করোনাক্রান্ত দিনে যুদ্ধের কথা

চারদিকে শুধুই মৃত্যুর মিছিল ! সারি সারি লাশ। গ্রেভইয়ার্ডে সাদা পলিথিন পোশাকে আবৃত গোটা কতেক দেবদূত মৃতের সৎকারে হাজির কেবল।দেখে মনে হয় ভিন্ন গ্রহের কোনো অলিক দেবদূতেরা এসে অ্চ্যুৎ মৃতদের জনমের মত আড়াল করে দিয়ে যাচ্ছে মাটির গর্ভে। এই দৃশ্য আমরা দেখিনি কোনোকালে। এই মৃত মানুষদের যেন অধিকার নাই শেষ বিদায়বেলায় স্বজনের মায়াবেষ্টনে আবৃত হবার।আপনজনেরাও ফিরে তাকাচ্ছেনা তাদের দিকে।পুত্রকন্যা,মাতাপিতা,আত্মীয় -পরিজন কেউ প্রাণহীন দেহ জড়িয়ে ধরে আহাজারি করছেনা। সবাই বুকভাঙ্গা নিরব কান্নায় বিদায় জানাচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এখন কেবলি অশনি সংকেত। এইসব মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কী অসহায় ভগ্ন এক অচেনা পৃথিবীকে দেখছি আমরা। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদেরকে একই বৃন্তে নিয়ে এসেছে আজ। যাদের সাথে হয়তো এই জীবনে আর দেখা হতোনা কোনো দিন,সেইসব হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খোঁজে পেলাম ফেসবুকের মহিমায়।সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া নিকট ও দূরের আত্মীয় কি পরিচিতদের সাথে আবার মেলবন্ধন করে দিয়েছে এই ফেসবুক। চাইলে এইসব সসিয়েল মিডিয়ার মাধ্যমে কে কি রান্না করছে ,কে কি পোশাক কিনেছে ঈদে ,জন্মদিনে ,বসন্ত উৎসবে , বা নববর্ষে,এসব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারি।এটা এক দশক আগেও কল্পনা করা যেতোনা। বিপদে আপদে , আসুখ-বিসুখে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে ফেসবুক আমাদেরকে একই মালায় গেঁথে দিয়েছে। কিন্তু এখন ফেসবুক ওপেন করতে ভয় হয়। রাজ্যির শোকগুলো ,আহাজারীগুলো যেন ফেসবুকের প্রতিটি পাতা দখল করে নিয়েছে। শেখার বিষয়েরও অভাব নাই। অন্যদিকে অপপ্রচার আর প্যানিক সৃষ্টি করছে এইসব তথ্য প্রযুক্তি।সকল মানবের এই মহা-দুর্যোগের দিনে একফোঁটা আশার আলো আমরা সকলের খুব দরকার। ঘোর অন্ধকারের ভেতর একরত্তি আলো মহাসঙ্কটের কালে জীবনকে ভালবাসতে প্রণোদনা দেয় , ভালবাসতে শেখায় হাসিকান্নার এই জগতসংসারটিকে। মিত্যু অবধারিত , কিন্তু এ যেন অন্যরকম মৃত্যু। এমন মৃত্যু আমরা কেউ চাইনা। চুপেচুপে বিদায় জানাতে হয় , কাউকে বলা যায়না , আকুল কান্না করা যায়না, কেউ যেন শুনতে না পায় এমন মৃত্যুর কথা। একই ঘরের অন্য কক্ষে স্বামীর লাশ পড়ে আছে আর অন্য রুমে স্ত্রী ও দুই সন্তান। প্রিয়জনের মৃত মুখ প্রাণভরে শেষবারের মত দেখার উপায় নাই ।,মৃত্যুদূতের শীতল ছায়া যেন ঘিরে রেখেছে পরিপাশ আমাদের । মৃত্যুর সাথে সহবাস ! কী নির্মম সত্যের লোমহর্ষক দৃশ্যগুলো ! কীকরে সহ্য করবে মানুষ এই অসহায় সংকটময় জীবন ! এই যুদ্ধের শেষ কবে , কীভাবে এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে কেউ বলতে পারছেনা।

এ কেমন অদৃশ্য শত্রুর সাথে অসম যুদ্ধের মুখোমুখি সারা জগতবাসী আজ ? মানুষ একা থাকতে পারেনা। খোঁয়াড়ে থাকার জীব মানুষ নয়। অনেক দেশেই এখন আর অবরোধবাসে থাকছেনা মানুষ। আলো চাই , খোলা আকাশের তলায় প্রকৃতি আর মানববাগানে মাখামাখি হয়ে থাকার স্বভাব মানুষের। প্রকৃতিকে বেধড়ক প্রহার করেছে মানুষ এতদিন। প্রকৃতির ব্যথা থাকতে পারে একথা ভাবেনি মানুষ কখনও। অবোধ পশুদের খোঁয়াড়ে বন্দি করে তাদের হাঁড়মাংশ চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে মানুষ কতকাল ধরে , কিন্তু আজ একটা বর্ণচোরা অণুজীব মানবজাতিকে অবলিলায় খাঁচাবন্দি করে দিয়েছে। এরকম কোনো অদৃশ্য শত্রুর দখলে বন্দি হবার কথা মানুষ ভাবেনি কোনো দিন। আমরা বিশ্বকর্মার নিজহাতে গড়া অমৃতের সন্তান। এসব গৌরবের কথা চিরকাল আমরা শুনে এসেছি , আমাদেরকে বন্দি করে কার সাধ্যি ?

আর নেয়া যাচ্ছেনা এমন পরাজয়ের জীবন। মনটা ভীষণ হাহাকার করে কখনও । বাইরে নবীন বসন্তের ঘ্রাণ বাতাসে। উপছে পড়া আলোর বন্যা , কিন্তু গা’য় মাখতে পারছিনা রোদের এই সঞ্জিবনী উষ্ণতা। ঘরের বদ্ধ পরিবেশ আর প্রাণে সয়না , প্রচন্ড মাথাব্যথায় ক্লান্ত হয়ে পড়ি যখনতখন। নিঃশব্দ ও নির্জনতার ভেতর কীকরে আমার শীরপীড়ার উপশম করি ভেবে পাইনা। ডুকরে ডুকরে মন কাঁদে যেন ফেসবুকে মুদ্রিত সেইসব ভগ্ন পরিবারের মানুষগুলোর জন্য।মনটাকে ফেরাতে পারিনা সেইসব দৃশ্য থেকে। আর আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদেরইবা ভরসা কোথায় !

সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শহর , লোকালয় , গ্রাম লকডাউন আজ।মনের উচাটন থেকে খানিক নিষ্কৃতি পাবার জন্য ইতিউতি ফোন করতে থাকি নিকটজনদের। ঢাকায় আপাদের সাথে কথা বলি মেসেঞ্জারে ! কথায় কথায় নানা ডালে পুরনো দিনের গল্পগুলো ঘুরেফিরে চলে আসে। কিছু গল্প আমার নিজের স্মৃতির পাতায় আর কিছু গল্প আপাদের স্মৃতি থেকে জাগ্রত হয়ে যায়। প্রায়ই ছোটবেলার কথাগুলো চলে আসে ! বড় আপা ও মেজো আপা সেদিন বললেন আমাদের বড়মা (আব্বার নানি) এক’শ দুই বছর বেঁচেছিলেন। আজ কত বছর পর আমি এই কথাটা জানলাম।আমি দেখিনি বড়মা’কে।বড় আপা ও মেঝো আপার আবছা কিছু ছবি আছে বড়মা’কে নিয়ে। কথাগুলো জানলাম আপাদের কাছ থেকে ! বড়মা’র তিন মেয়ে ও চার ছেলে ছিলেন। উনার জীবদ্দশায়ই অতি অল্প বয়সে তিন মেয়ে ও এক ছেলে মারা যান বড়মা’র। অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন বড়মা। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে যাওয়াতে আমার বড় আপা ও মেজো আপা ভাত খাইয়ে দিতেন বড়মা’কে।ছোট্ট খুকির মত তিনি বসে বসে আপাদের হাতে তৃপ্তিভরে খাবার খেতেন।এসব গল্প শুনে আমারও বড্ড ইচ্ছা করে বড়মায়ের মত বটবৃক্ষের বয়েসী খুকি হতে। হে প্রভু আমাকেও আমার বড়মা’র মতন প্রাচীন হতে দাও।আমি যেন আমার বড়মা’র ঘোলা চোখ দিয়ে আমার প্রিয় পৃথিবীকে তারিয়ে তারিয়ে দেখতে পারি।কিন্তু এই জবুথবু আমাকে কেউ কি নিজ হাতে মাখিয়ে মমতা দিয়ে খাইয়ে দেবে ?

কথায় কথায় স্বাধীনতার যুদ্ধের কথা এসে গেলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা আমার কিছুই তেমন স্মৃতিতে নাই। আমার কাছে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও করোনা ভাইরাসে গ্রাসিত সময়টা অনেক ভয়াবহ। স্বাধীনতা যুদ্ধে আর্মিরা আসছে শুনলে পালিয়ে যাও। ওরা চলে গেলে আবার চলে আসো বাড়িতে। কিন্তু এই ভাইরাস তো শব্দ করে আসছে না যে পালিয়ে যাবো ! করোনার সাথে যুদ্ধে ডাক্তার,নার্স, আর্মি, পুলিশ, ডাকপিয়ন, সংবাদদাতা, রাষ্ট্রনায়ক,আমীর ফকির কেউ রেহাই পাচ্ছেনা। মানবদেহ করোনার খুব দরকার বংশবিস্তারে।এই দেহ প্রজার না রাজার সেই বিচার করোনার নাই।কী মধুর সাম্যবাদী অনুজীবটি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার আব্বা ব্রাম্মণবাড়ীয়া ছিলেন। আমার মেঝো আপা একদিন রাতে আববাকে বলেন, পাকিস্তানি আর্মিরা আসছে, যুদ্ধ লাগবে নাকি আব্বা ?
একথা কে বললো ?

আমার ক্লাস মেইট ও স্যাররা আলাপ আলোচনা করছে। চারিদিকে শুধু সবাই কানাঘোষা করছে।
আব্বা বলেন, আচ্ছা দেখা যাবে।যুদ্ধ লাগলে লাগবে। তুমি তোমার লেখাপড়া মনোযোগ দিয়ে কর।
মেঝো আপা আজ বিকালে কথায় কথায়এই স্মৃতিগুলো বললেন। রাত আটটার দিকে আমদের ঘরে রাতের খাওয়া – দাওয়া সবসময়ই শেষ করা হ্তো। আমার আব্বা সবসময় টাইম মেনটেনট করতেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাত দশটা পর্যন্ত লেখাপডা করতেন আপারা। সবাই এগারোটা্র দিকে ঘুমাতে যাবেন এমন সময় থানার অফিস এলাকায় বিকট শব্দে পাগলাঘন্টি বেজে উঠলো। আব্বা মশারীর নিচে থেকে বের হয়ে সার্ট ও পেন্ট পরে চলে গেলেন থানায়। আম্মাকে বললেন, তোমরা দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।ব্রাম্মণবাড়ীয়া থানার খানিক দূরে আমাদের বাসা ছিল এবং অন্যান্য ষ্টাফদেরও বাসা ছিল। আপারা বলেছেন, কোন রুমের সাথেই ওয়াশরুম ছিল না।ওয়াসরুম ছিল বাইরের দিকে। আপারা ওয়াশরুমে যাবেন বলে বের হন। তখন দেখেন শুধু লাইট ফ্ল্যাশ করছে চারদিকে। আপারা আম্মাকে ডাকলেন , আম্মা দেখো কি কান্ড , চারিদিকে লাইটে সম্পূর্ণ শহর ঝলমল করছে। এদিকে আব্বাও পাগলাঘন্টার শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। কিছু বলেও যাননি। আম্মা ও আপারা সবাই মিলে আমাদের গরুর ঘরের দিকে গেলেন কি কান্ড হচ্ছে দেখার জন্য। ওখানে কি যেন একটা উঁচু মতন জিনিস আছে ঐটার উপরে দাঁড়ালে মোটামুটি শহরের বাজার দেখা যায়। দেখে তো অবাক সবাই। শুধু সারিসারি গাড়ির বহর , অনেকগুলো থানার দিকে আসছে । এরই মধ্যে মেইন দরজায় আওয়াজ শুনে সবাই আবার দৌঁড়ে মেইন গেটে গেলেন। আব্বা এসেই বললেন, তাড়াতাড়ি দারজা খোলো। দরজা খুলতেই আব্বা বললেন তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাও। তাড়াতাড়ি করো , এক কাপড়ে যাও, দেরী করলে আর যেতে পারবে না। আম্মা বললেন, কোথায় যাবো আমরা এত রাতে?

সব জুনিয়র অফিসারদের পরিবার যেদিকে যায় তোমরাও সেদিকে যাও। আম্মা বলেন, আর তুমি?
আমি তো থানায় আছি, আমার ডিউটি আছে।থানার চার্জে কর্তব্যরত আছি , আমি থানার বড় বাবু হিসেবে এখন থাকতেই হবে, অন্যান্য ষ্টাফও তো আছে। তোমরা তাড়াতাড়ি যাও, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্যে থাকলে দেখা হবে !
আপাদের কাছ থেকে একথাটা শুনে আমার কাছে মনে হলো,করোনার গ্রাসিত দিনগুলোর চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কম বিপদের ছিলোনা !

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 

আরও সংবাদ