ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

ভালোবাসা, হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য সুতোর টান। এক বিচিত্র অনুভূতি। কোনো শব্দে যাকে পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায় না, কোনো সংজ্ঞায় যাকে আবদ্ধ করা যায় না। পিতা-মাতার ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তানদের ভালোবাসা, ভাই-বোনের ভালোবাসা, আত্মীয়-স্বজন, সঙ্গী-সাথী ও বন্ধুদের ভালোবাসা, সৎ মানুষদের ভালোবাসা এসবই ইসলাম নির্দেশিত। এরূপ ভালোবাসা মানুষের মানবীয় মূল্যবোধ উজ্জীবিত করে, হৃদয়কে প্রশস্ত ও প্রশান্ত করে এবং সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মাণে ত্যাগ স্বীকারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। সংঘাতময় এ পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করার জন্য এই ভালোবাসা কতই না প্রয়োজন!

উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

ভালোবাসা দিবস বা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎপত্তি নিয়ে প্রচুর মতভেদ দেখা যায়। সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মতটি প্রদান করেছেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান গবেষক, অধ্যাপক নিওল লেন্সকি। তার মতে, রোমানরা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগে প্যাগান (পৌত্তলিক) ধর্মের অনুসারী ছিল। প্যাগানরা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত লিওপারক্যালিয়া বা ফেব্রুয়ালিয়া পূজা পালন করত। এই ফেব্রুয়ালিয়া অনুষ্ঠানের নামানুসারে পরবর্তীতে মাসটির নামকরণ করা হয় ফেব্রুয়ারি। মাসটির ১৩ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত ছিল এই পূজা হতো। পূজার উদ্দেশ্য ছিল দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে পূণ্যতা, উর্বরতা ও সমৃদ্ধি লাভ করা। অনুষ্ঠানের মাঝের দিন অর্থাৎ ১৪ ছিল ফেব্রুয়ারি এই পূজোর মূল আকর্ষণ। এ দিনে পরবর্তী এক বছর আনন্দ দেওয়ার জন্য দেবীর ইচ্ছায় লটারির মাধ্যমে তরুণরা তাদের তরুণী সঙ্গিনীকে পেত। প্রথানুযায়ী বড় একটি বাক্সে তরুণীদের নাম লিখে রাখা হতো। সেখান থেকে তরুণরা একেক করে নাম ওঠাত। পরবর্তী বছর লটারি পর্যন্ত নির্বাচিত যুগল একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেত।

খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ফলে প্যাগানরা দলে দলে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হতে লাগল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে এই লিওপারক্যালিয়া পূজাকে কেন্দ্র করে। রোমানরা এই প্রথা বাদ দিতে চাইছিল না। এরই মাঝে ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা। খ্রিস্টান ধর্মযাজক স্টিভ ভ্যালেন্টাইন গ্রেফতার হন রোমান সম্রাট ক্লাডিয়াসের নানা আদেশ লঙ্ঘনের দায়ে। সম্রাটের পক্ষ থেকে বিয়েসহ সবধরনের নারী সংস্পর্শ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ যুদ্ধের জন্য তখন সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা খুব প্রয়োজন ছিল। আর অবিবাহিত সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে পারতেন। কিন্তু স্টিভ ভ্যালেন্টাইন গোপনে এসব সেনাদের বিয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন এবং বিয়ে দিয়ে দিতেন।

কারাগারে যাওয়ার পর জনগণের সহানুভূতিতে তিনি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই জনপ্রিয় মানুষটিকে দেখার জন্য প্রতিদিন অগণিত মানুষ কারাগারে যেতেন। সম্রাট ক্লাডিয়াস ২৭০ সালে জনসম্মুখে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বলা হয়ে থাকে সেই দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।

এ ঘটনার পর আস্তে আস্তে খ্রিস্টানরা রোম পরিপূর্ণভাবে জয় করে ফেলে। কিন্তু ধর্ম প্রসারের ক্ষেত্রে প্যাগান লিওপারক্যালিয়া পূজাকে কেন্দ্র করে বিপত্তি বাঁধে। খ্রিস্টান ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রনায়কেরা ধর্মপ্রচার ও রাষ্ট্রশাসনের ক্ষেত্রে কৌশলী পন্থা অবলম্বন করে। ৪৯৬ সালে পোপ গিলাসিয়াস রোমান লিওপারসালিয়া বা ফেব্রুয়ালিয়া পূজার নাম ও পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিজ ধর্মের যাজক স্টিভ ভ্যালেন্টাইনের নামে অনুষ্ঠানের নামকরণ করেন। শুরু হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবসের’ পথচলা।

কিন্তু বেহায়াপনা ও নোংরামির কারণে মধ্যযুগে গোটা ইউরোপে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপন দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসার তার ‘পার্লামেন্ট অব ফাউলস’ (১৩৮২) গ্রন্থে ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে লেখেন। এরপর উইলিয়াম শেক্সপিয়রসহ খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা এ বিষয়টিকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে নিয়ে আসেন। ফলশ্রুতিতে ১৬৬০ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস আবার দিবসটি পালনের প্রথা চালু করেন।

পরবর্তীতে শিল্প বিপ্লবের ফলে বিষয়টি বাণিজ্যিক উপকরণে পরিণত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল স্রোতে এই বাণিজ্যিক ‘ব্রান্ড’ আজ বিশ্ব অর্থনীতির বড় একটা অংশ দখলে নিয়ে নিয়েছে। ২০১০ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ দিনটি ঘিরে ১ বিলিয়নের বেশি ভ্যালেন্টাইন কার্ড বিক্রি হয়েছে।

বাংলাদেশে দিবসটি পালন শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। যায় যায় দিন পত্রিকার আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম দিবসটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে সেই লিওপারক্যালিয়া বা ফেব্রুয়ালিয়া অথবা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

দিবসের ভালোবাসাবাসি

ভালোবাসা দিবসের নামে ভালোবাসার মতো পবিত্র শব্দটাকেই আজ কলুষিত করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের সস্তা যৌন আবেগকে সুড়সুড়ি দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমাদের যুগ যুগ ধরে লালন করা সামাজিক রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে আমাদের ভদ্রতা, ভব্যতা ও শালীনতাকে। যার ফলে আজ নৈতিক অবক্ষয় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনা জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করছে। ভাঙছে পরিবার, ভাঙছে সমাজ। অথচ যারা ঈমানদারদের সমাজে এ ধরনের অশ্লীলতার বিস্তার ঘটায়, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ [সুরা নুর : ১৯]

যে সমাজে চরিত্রহীনতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে আল্লাহর কঠিন আজাব-গজব ক্রমাগত বর্ষণ হতে থাকে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন :

‘যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেহায়াপনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তারা নিজেরাই তার প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা করে, অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ তাদের মাঝে মহামারি, সংক্রামক রোগ এবং ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দেয়, যা ইতঃপূর্বে কখনোই দেখা যায়নি।’ [ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ৪০০৯]

যখন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বলতে কিছু ছিল না, তখনো পৃথিবীতে ভালোবাসার অভাব ছিল না। আজ পৃথিবীতে ভালোবাসার বড্ড অভাব। তাই দিবস পালন করে ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। আর হবেই না কেন, অপবিত্রতা নোংরামি আর শঠতার মাঝে তো আর ভালোবাসা নামক ‘ভালো’ বস্তু থাকতে পারে না। তাই আল্লাহ তায়ালা মানুষের হৃদয় থেকে ভালোবাসা উঠিয়ে নিয়েছেন।

সূত্রঃ দৈনিক অধিকার

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ

আরও সংবাদ