ফেরারী প্রেম

ডোনার সাথে প্রথম দেখা ও পরিচয় হয়েছিল ফ্রান্সের বন্দরনগরী মার্সেই-এ এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়। পার্কিং এরিয়ায় যখন আমি আমার বেন্টলি কন্টিনেন্টাল থেকে বের হয়ে নীল ছাতাটা মাথার ওপর ধরে সুপার মার্কেটের দিকে পা বাড়ালাম তখন হঠাৎ করেই পার্ক করা একটা সানবিম অ্যালপাইন গাড়ি থেকে টেনিস বলের মত লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে আমার ছাতার নিচে ঢুকে গেল এক ডানাকাটা পরী।

দামি ডিয়ো স্যুট আর লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা কালো লম্বা চুলে “লিলি-অফ-দি ভ্যালি’র” মিষ্টি গন্ধ আমাকে টালমাটাল করে দিল। আর হাঁটার সময় তার নরম শরীরের স্পর্শ আমাকে অজান্তেই অবশ করে দিতে লাগল। মার্কেটে ঢুকে পরিচিতি সারলাম। তারপর আপন গতিতে বিশাল পৃথিবীর বুকে নিজ নিজ পথে হারিয়ে যেতে বাধ্য হলাম।

দ্বিতৃয়বার দেখা হলো ইটালির রোমের স্প্যানিশ স্টেপস এর কাছে ভিয়া কোরেজ-এর একটা অভিজাত রোমান রেস্টুরেন্টে। সেখানে অবশ্য আমরা মুখোমুখি বসে ডিনার করেছিলাম। জেনেছিলাম পরস্পরকে গভীরভাবে। তারপর হঠাৎ করেই প্রেম এসেছিল আমাকে ভাসিয়ে দিতে| তবুও ভালোবাসা অপ্রকাশিত রেখে জীবনের টানে দু’জন হাটতে হলো ভিন্ন পথে। তবে সেই থেকে আমি আর একা রইলাম না। ডোনার স্বপ্ন আমার চিরসঙ্গি হয়ে গেল।

জীবনের তাগিদে হোক কিংবা বিলাসিতায় হোক, মানুষ অবিরাম যেখানে শুধুই ছুটে চলছে সেখানে দু’জন মানুষের বারবার দেখা হওয়াটা বিচিত্র নয়। তবুও ডোনার সাথে যখন তৃতীয়বার দেখা হলো তখন কিছুটা অবাক না হয়ে পারলাম না।

জানালা দিয়ে অ্যালবুর্জ পর্বতের চূঁড়া আর দূরে একটা হালকা কালো দাগের মত ক্যাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ তীর দেখতে দেখতে যখন ইরানের আকাশ থেকে মাটিতে নামলাম; তখন রানওয়েতেই মরুভূমির প্রচণ্ড উত্তাপ আর ডোনা এক সাথে দেখা দিল।

তেহরানে গেছি হেলিকপ্টার ওড়ানোর বিশেষ একটা প্রশিক্ষণ নিতে। আর ডোনা এসেছে সেই প্রশিক্ষণের ট্রেইনার হিসেবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আরও কাছাকাছি আসার সুযোগ হলো।

ইরানের পূর্বে আফগানিস্তান, পশ্চিমে তুরস্ক। উত্তর সীমান্তে ক্যাস্পিয়ান সাগর আর দক্ষিণ সীমান্তে ইরান উপসাগর। উত্তর-পশ্চিমে আজারবাইজানের ভিতর দিয়ে রাশিয়াও যাওয়া যায়। তবে রাস্তার অবস্থা করুণ। বরং ক্যাস্পিয়ানের উত্তর তীর থেকে আস্ত্রাখান হয়ে গেলে ভলগোগ্রাণ্ডের দূরত্ব অনেক কম। এই বিশাল ইরানের বুকে বিশেষ করে ক্যাস্পিয়ান সাগরের জলে ডোনা আর আমার অনেক স্মৃতি এঁকে দিলাম প্রশিক্ষণকালীন সময়ে। কিন্তু ভালোবাসা অপ্রকাশিতই রইল।

প্রশিক্ষণের শেষদিকে একদিন একটা রাশান টুইন-ইঞ্জিন এমআই-৮ হেলিকপ্টার নিয়ে ডোনা আর আমি উড়েছিলাম ইরানের আকাশে। বাউণ্ডুলে মন ধরে রাখতে পারলাম না। হৃদয়ের সব আবেগ মিশিয়ে মরুভূমির আকাশেই ডোনাকে ডাকলাম সংসারের মায়ায়।

সাথে সাথে সে কোনো উত্তর দিল না। হরিণীর নীল চোখ দিয়ে তাকালো। অজানা উত্তেজনায় সামন্য ফাঁক হয়ে গেল তার সুন্দর ঠোঁটজোড়া। একটা ঘোরের মধ্যে যেন বিড় বিড় করলো- প্লিজ ওয়েট।

যখন আমরা ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের নির্জন মরুভূমি দাস্ত-এ-লুতের দক্ষিণ প্রান্তের জাহেদান হয়ে জ্যাবুল সীমান্তে ল্যাণ্ড করলাম তখন ডোনা হঠাৎ করেই আসছি বলে একটা কারখানার পাশের রাস্তা দিয়ে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল।

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন ডোনা এলো না তখন অপেক্ষার প্রহর চিন্তায় পরিণত হলো। এমন সময় এক ইরানি মহিলা এসে আমাকে এক টুকরো কাগজ দিয়ে দ্রুত চলে গেল।

ভাজ খুলে দেখলাম অজস্র কষ্টের দাগ আঁকা আছে সাদা পাতায় নীল কলমের আচড়ে। ডোনা লিখেছে- “প্রচণ্ড ভালোবাসি তোমাকে। আর তোমার মত ভালোবাসার পুরুষ যে কোনো মেয়ের জন্য অন্তহীন পাওয়া। কিন্তু আমার সীমাবদ্ধতা তোমাকে হারাতে বাধ্য করলো। জানি, তোমার সামনে থাকলে নিজেকে ধরে রাখা কোনোদিনই সম্ভব হবে না। আর তা যদি না পারি তবে আরেকজন প্রতারিত হবে। তাই চাকুরীটা এখানেই ছেড়ে দিয়ে তোমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলাম পৃথিবীর তমশায়। হেলিকপ্টার নিয়ে ফিরে যাও। আর মনে রেখ কেউ একজনের স্বপ্নের নায়ক ছিলে তুমি- যে হাজার প্রত্যাশায় ডুবে থেকেও শুধু প্রতারক হতে চায় না বলে তোমাকে কষ্ট দিল। যদি পারো ক্ষমা করে দিও।”

কিভাবে ফিরে এসেছিলাম জানিনা। তবে পরদিনই আবার নিয়ম ভঙ্গের দণ্ডে দণ্ডিত হবো জেনেও একটা এমআই-৮ এইচআইপি ট্র্যান্সপোট হেলিকপ্টার নিয়ে আবার চলে গেলাম জ্যাবুল শহরে। আইন-কানুনহীন বন্য পুরানো সীমান্ত শরহগুলোর মত এই জ্যাবুল শহর। অসহ্য গরম, গাছপালাহীন আরা ধূলি ধূসরিত শহরটার সমস্ত ভাজ তন্ন তন্ন করে বৃথাই খুজলাম। যদিও আগেই জানতাম এখানে তাকে খোঁজা বৃথা।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিদায়ের পর যখন নশাহর-তেহরান রাস্তার মাঝামাঝি পর্বতের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটা চায়ের দোকানে আমার ধূসর ক্যাডিলাক থামালাম তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠৎ করেই সেই সন্ধ্যার মত “লিলি-অফ-দি ভ্যালি’র” মিষ্টি গন্ধ নাকে আঘাত হেনে দিশেহারা করে দিল।

কিন্তু আমি স্পষ্ট জানি ওখানে ডোনা নেই আছে শুধু তার স্মৃতি। এখানে মরুর বাতাসের রুক্ষতা নেই বরং বহু প্রতীক্ষিত ভেজা ঠাণ্ডা বাতাস মনটাকে ভিজিয়ে দিল। আর দিগন্তে মরীচিকার মত ঝিলমিল করা ক্যাস্পিয়ান সাগরের সবজে-নীল পানি আমাকে ডোনার ধূসর একটা ছবি এঁকে দিল। আমি দেখলাম; স্পষ্ট দেখলাম- ডোনার ঠোঁটের কালো তিলে ঘামের আলপনা।

এখনো আমি প্রায়ই আকাশে উড়ি। আর যখনই পাইলটের সিটে বসি কল্পনায় ডোনা এসে হাজির হয়। জানি এটা অনেকটা প্রাণের মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। কিন্তু প্রায়ই ডোনা আমাকে পরাজিত করে।

বাউণ্ডুলে মন অন্তহীন আকাশে ডানা মেলে। দেখে পৃথিবীর বুকে কষ্টের খেলা। দেখে নিঃসঙ্গ প্রেম, ব্যস্ত রাস্তায় রাতের রাণীদের পদচারণ, দেখে তাজমহল। কিন্তু পায় না “লিলি-অফ-দি ভ্যালি’র” মিষ্টি গন্ধ মাখা সেই ডানাকাটা পরীর অস্থিত্ব- যে এসেছিল এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় নিঃসঙ্গতার ট্রেনে করে আমাকে বাউণ্ডুলে সাজাতে।

লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কেকে
আরও সংবাদ