বরকতময় রামাদ্বান : যাকাত কাদের হক


রাহমাত, বারাকাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাহিনা পবিত্র মাহে রামাদ্বান হচ্ছে মুমিন মুসলমানের জন্য কম সময়ে ও কম আমলে বেশি সাওয়াব অর্জন করার একটি সুবর্ণ সুযোগ। হাদীস শরীফের ভাষ্য মতে এমাসে একটি ফরয অন্য মাসের সত্তরটি ফরযের সমান। আবার একটি নফল একটি ফরযের সমান। তাই আল্লাহ তায়ালা যাদের উপরে যাকাত ফরয করেছেন তারা অনেকেই রামাদ্বান মাসে তাদের যাকাত আদায় করে থাকেন। যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি। নিসাবে মালিক যারা আছেন তাদের উপর প্রতি বছর হিসাব করে যাকাত আদায় করা ফরয। আবার এই যাকাত সাধারণত সবাইকে দেওয়া যায় না এবং এতে সবার হকও নেই। যাকাতের মালের উপরে কাদের হক সেটা নির্ধারণ করার সুযোগ নাবী বা অন্য কারো সন্তুষ্টির উপর না রেখে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমনটি আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত যিয়াদ ইবনুল হারিস আস-সুদায়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গিয়ে তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করি। অতঃপর তিনি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করলেন। এ সময় তাঁর নিকট এক ব্যক্তি এসে বললো, আমাকে সাদাক্বাহ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, মহান আল্লাহ যাকাত বিতরণের ব্যাপারে কোনো নাবী এবং অন্য কারোর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নন। বরং তিনি এ বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিঁনি তা আট ভাগে বিভক্ত করেছেন। সুতরাং যদি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হও, তাহলে আমি তোমাকে তোমার প্রাপ্য প্রদান করবো”।

আর আল্লাহ তায়ালা সূরা তওবাহ এর ৬০ নম্বর আয়াতে বলেছেন- “নিশ্চয় সাদাক্বা হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়”। উক্ত আয়াতে কারীমায় মোট ৮ ধরণের ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়ার কথা পরিষ্কার করে বর্ণিত হয়েছে। আর তারা হলেন-

(এক) গরীব- দরিদ্র ব্যক্তি। যাদের কিছু নেই। আর তাদের যাকাত দেওয়া জায়েজ। সুনানে তিরমিজী ও আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- অবস্থাপন্ন সচ্ছল ও সুস্থ-সবল লোকের জন্য যাকাত নেওয়া বৈধ নয়। এমন সময় দুজন লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সাদাক্বার মাল চাইলো। তিঁনি তখন তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা দেহ ভালভাবে দেখে বুঝতে পারলেন যে, তারা সুস্থ ও বলবান লোক। সুতরাং তিঁনি তাদেরকে বললেন- তোমরা যদি চাও তবে আমি তোমাদেরকে দিতে পারি। তবে জেনে রেখো যে, ধনী, শক্তিশালী ও উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এতে কোন অংশ নেই”।

(দুই) মিসকীন- মিসকীনদের পরিচয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই দিয়েছেন। যা সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- প্রকৃত মিসকীন সে নয় যে মানুষের কাছে ভিক্ষার জন্য ঘুরে বেড়ায় এবং এক বা দুই লুক্বমা অথবা এক বা দুটি খেজুর পেলে ফিরে যায়। বরং প্রকৃত মিসকীন সেই ব্যক্তি, যার এতটুকু সম্পদ নেই যাতে তার প্রয়োজন মিটাতে পারে এবং অবস্থা সেরূপ বোঝা যায় না যে, তাকে দান খয়রাত করা যাবে আর সে মানুষের কাছে যাচঞা করে বেড়ায় না”। তথা অভাব থাকা সত্ত্বেও মানুষের কাছে কিছু চায় না।

(তিন) আমিল- ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য শরীয়ত নির্দিষ্ট যাকাত আদায়কারী ব্যক্তি। এটা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা নিযুক্ত হতে হবে। নিজে নিজে মনে করে নিলে হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিক্বহ)

(চার) মুয়াল্লাফাতুল ক্বুলুব- নব মুসলিমদের ইসলামের প্রতি মোহাব্বত বাড়ানোর জন্য উৎসাহমূলক যাকাত প্রদান। এ বিধানটি রহিত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে কোন ধনী নওমুসলিমকে যাকাত প্রদান জায়েজ নয়। (হিদায়া, মাআরিফুল কুরআন ও তাফসীরে মাযহারী)

(পাঁচ) রিক্বাব– দাস আযাদ করা। যদি এমন কোন দাস থাকে যাকে মুনিব নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে আযাদ করে দেওয়ার চুক্তি করেছে তাহলে তাকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ।

(ছয়) গারিমীন- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যার নিকট এ পরিমাণ সম্পদ বা টাকা আছে তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করার পর অবশিষ্ট সম্পদ বা টাকা নিসাব পরিমাণ থাকে না। তাকে যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ। অনুরূপ এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যার অন্যের কাছে টাকা পাওনা আছে কিন্তু সে তা উদ্ধার করতে পারছে না, তাকেও যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ। এমন কি ফকিরকে যাকাত দেওয়ার চেয়ে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া উত্তম। (আলমগীরী প্রথম খণ্ড)

(সাত) ফী সাবিলিল্লাহ- আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তি। এখন প্রশ্ন হলো আল্লাহর রাস্তায় কারা আছেন? ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেন এতে রয়েছেন জিহাদরত মুজাহিদরা। তাদের জিহাদের অস্ত্র ও পাথেয় ক্রয় করার জন্য যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ। হজ্বের সফরে থাকা ব্যক্তি যদি হঠাৎ অভাবগ্রস্ত হয়ে যান তাহলে তাকে দেওয়া জায়েজ। ইলমে দ্বীন অর্জনকারী দারিদ্র ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া জায়েজ। (আদ-দুররুল মুখতার, হিদায়া ও রূহুল মাআনী)

(আট) মুসাফির– সফররত ব্যক্তি। যার টাকা পয়সা আছে বাড়িতে। কিন্তু কোন সফর অবস্থায় অসহায় হয়ে গেছেন। তাকে প্রয়োজন পরিমাণ যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ। তবে উনি যাকাত নেওয়ার চেয়ে কর্যে হাসানা নেওয়া উত্তম। যদি কোন ব্যক্তি নিজের এলাকাতে কোন কারণে নিজের সম্পত্তি ও টাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে তাকেও প্রয়োজন পরিমাণ যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ আছে। আর যদি এমন হয় যে যাকাত থেকে প্রাপ্ত টাকা খরচ করার পূর্বে মুসাফির বা রিক্তহস্ত ব্যক্তি নিজের সম্পত্তি ও টাকা পেয়ে যান তাহলে যাকাতের টাকা সাদাক্বাহ করে দেওয়া উত্তম হবে।তবে ওয়াজীব নয়। (আলমগীরী প্রথম খণ্ড)

উপরোক্ত ক্যাটাগরিতে যাকাত আদায় করলেই কেবল যাকাত আদায় হবে। অন্য কাউকে যাকাত দিলে তা আদায় হবে না। ফুক্বাহায়ে কেরাম যাকাত আদায়ের জন্য একটি শর্তারোপ করেছেন এই যে, যাকাতের টাকার মালিক বানিয়ে দিতে হবে দানকৃত ব্যক্তিকে। যদি মালিক বানিয়ে দেওয়া না হয়, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। সেই হিসেবে কোন প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা বা মাসজিদের কাজে যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ নয়, যদিও তাতে গরীব মানুষ থাকে, নামায পড়ে, পড়াশোনা করে। তবে কোন এতিমখানা, মাদ্রাসা বা প্রতিষ্ঠানের গরীব ছাত্রদের দেওয়া জায়েজ হবে। (ইনায়া আলা ফাতহিল কাদীর, আল হিদায়া ও তাবয়ীনুল হাকায়েক)

এখানে একটি বিষয় আমাদের পরিষ্কার করে জেনে নেওয়া দরকার যে, এতিমখানা, মাদ্রাসা বা প্রতিষ্ঠানের যে সমস্ত গরীব ছাত্রছাত্রী আছে তাদের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি। এবং এগুলো যখন দেওয়া হয় তখন ঐ গরীব ছাত্রছাত্রীদের মালিক বানিয়ে দেওয়া হয়। আর এগুলো খরচ করা হয় তাদের কিতাব কিনা, থাকা, খাওয়া এবং ব্যবহার করার জিনিসপত্রে।

সাধারণ মূর্খ ফকির মিসকিনদের চেয়ে দ্বীনদার এবং দ্বীনী শিক্ষার্থীদের যাকাত পাওয়া অধিক হকদার কারণ এ উভয় পক্ষের ক্ষেত্রে একজন অসহায় ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়ার পাশাপাশি একজন দ্বীনদার ও একজন আত্মীয়কে সহযোগিতা করা হচ্ছে। যা শরীয়তের দৃষ্টিতে আলাদা সাওয়াবের কাজ। (শামী দ্বিতীয় খণ্ড)

উপরোক্ত খাত গুলো হচ্ছে যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্র। এখন যদি যাকাত দাতা ইচ্ছা করে সব ক্ষেত্রে দিতে তাতে আদায় হবে। অথবা যে কোন এক ক্ষেত্রে দিলেও আদায় হবে। এটা যাকাত দাতার উপর নির্ভর করে। (কুদূরী)

আল্লাহ আমাদের সবাইকে কুরআন-সুন্নাহ সঠিক ভাবে জানার, বুঝার ও সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ