রহমতে আলম (সাঃ) : ইসরা ও মি’রাজ (পর্ব ছয়)


আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জান্নাতের সব কিছুই দেখিয়েছেন। যে গুলোর বর্ননা সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে এসেছে। আবার অনেক মুফাস্সীরীনে কেরাম তাদের তাফসীররের কিতাবেও বর্ননা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিভিন্ন সিরাতের কিতাব ও অনেক তারিখের কিতাবে এসবের বর্ননা পাওয়া যায়। যেগুলো থেকে আমাদের অনেক কিছুই শিখার আছে। আবার যেহেতু রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মি’রাজ স্বপ্নযোগে বহুবার হয়েছে এবং বহু ঘটনার বর্ননা তিঁনি করেছেন তাই অনেকেই স্বপ্নের ঘটনা আর স্ব-শরীরে মি‘রাজের ঘটনা গুলো এক করে দেন। সে দিকটা আমাদের আরো সতর্কতার সহিত খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে যারা ওয়াজ করেন বা বক্তব্য দেন। আবার অনেক বানোয়াট ঘটনারও বর্ননা পাওয়া যায়। যেগুলো আমাদের ঈমান আক্বিদা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তাই সে দিকটা আরো বেশি খেয়াল রাখতে হবে বক্তা এবং শ্রোতা উভয়ের।

 জিব্রাঈল (আঃ) কে আসল সূরতে দেখা।

হযরত জিব্রাইল (আঃ) রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বহুবার এসেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে। তখন তিঁনি আসতেন মানুষের সূরতে। বেশিরভাগ সময় সাহাবী হযরত দাহইয়াতুল কালবী (রাঃ) এর সূরতে আসতেন। তবে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ) কে আসল সূরতে দুইবার দেখেছেন। প্রথম বার দুনিয়ার জমিনে। আর দ্বিতীয় বার দেখেছেন সপ্তম আসমানে সিদ্রাতুল মুন্তাহার পাশেই। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা আন-নাজমে ইরশাদ হচ্ছে- “ধীশক্তিসম্পন্ন সত্তা (তথা জিব্রাঈল) তিঁনি নিজ সূরতে দেখা দিয়েছিলেন। তখন তিঁনি সর্বোচ্চ দিগন্তে। তারপর তিঁনি (তাঁর) নিকটবর্তী হলেন এবং (তাঁর দিকে) ঝুলে পড়লেন (তাঁর একেবারে কাছে চলে এলেন)। তাঁদের মধ্যে মাত্র দুই ধনুক পরিমাণ কিংবা তার চেয়েও কম দূরত্ব ছিলো। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যে ওহী পাঠাবার ছিলো (জিব্রাঈলের মাধ্যমে) তা পাঠালেন। (তখন) তিঁনি যা দেখেছিলেন (তাঁর) অন্তর তাকে মিথ্যা বলেনি। তাহলে (মি’রাজে) তিঁনি যা দেখবেন সে ব্যাপারে তোমরা কি তাঁর সাথে বিতর্ক করবে? তিঁনি তাঁকে দ্বিতীয় বার দেখেছেন। সিদ্রাতুল মুন্তাহার পাশেই। যেখানে জান্নাতুল মা’ওয়া অবস্থিত”।

এ আয়াতগুলোতে জিব্রাইল (আঃ) এর বর্ননা ও তাঁকে নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বচক্ষে আসল সূরতে দেখার কথা বলা হয়েছে। তাফসীরে সা‘দীতে এসেছে- নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ওহী নিয়ে আগমন করেছেন জিব্রাঈল (আঃ) যিনি বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে খুবই শক্তিশালী তিঁনি আল্লাহ তায়ালার আদেশ বাস্তবায়নে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ওহী যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে সক্ষম। শয়তান তাঁর থেকে কিছু ওহী ছিনিয়ে নেবে বা কিছু প্রবেশ করিয়ে দেবে তার প্রতিরোধকারী। তাফসীরে ফাতহুল কাদীরে এসেছে-
এটা হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জিব্রাঈল (আঃ) কে তাঁর আসল সূরতে দ্বিতীয় বার দেখা। আর তা ছিলো সিদ্রাতুল মুন্তাহার নিকট যা সপ্তম আসমানের উপরে। আর এটাই হলো শেষ সীমানা, এর উপরে কোন ফেরেশতা যেতে পারেন না। এখানেই রয়েছে জান্নাতুল মা’ওয়া। এ জান্নাতকে জান্নাতুল মা’ওয়া বলার কারণ হলো এখানে আদম ও হাওয়া (আঃ) বসবাস করেছিলেন। আর কেউ বলেছেন জান্নাতী আত্মাসমূহ এখানে এসে জমা হয়।

তাফসীরে ইবনে কাসীরে এসেছে- রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম বার জিব্রাঈল (আঃ) কে দেখা ছিলো রিসালাতের প্রাথমিক যুগের ঘটনা। প্রথম ওহী তথা সূরা ইক্বরার প্রথম কতগুলো আয়াত তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়। তারপর ওহী আসা বন্ধ হয়ে যায়। এতে তিঁনি খুবই চিন্তিত হয়ে যান। এমন কি কয়েকবার তিঁনির এমন হয়েছে যে, পাহাড়ের চূড়া হতে নীচে পড়ে যাবেন। কিন্তু সদা আসমানের দিক হতে তিঁনি জিব্রাঈল (আঃ) এর উক্তি শুনতে পেতেন হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি আল্লাহর প্রকৃত ও সত্য নাবী এবং আমি জিব্রাঈল। এ শব্দগুলো শুনে তাঁর দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যেতো। তিঁনি মনে প্রশান্তি লাভ করতেন। তারপর ফিরে আসতেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার তাঁর মনের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠতো এবং আল্লাহ তায়ালার ওহীর স্বাদ তাঁর স্মরণে এসে যেতো। সুতরাং পুনরায় তিঁনি বেরিয়ে পড়তেন এবং পাহাড়ের চূড়ায় চলে যেতেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত একবার আবতাহ নামক স্থানে জিব্রাঈল (আঃ) নিজের প্রকৃত সূরতে প্রকাশিত হন। তাঁর ছয়শত ডানা ছিলো। তাঁর দেহ আসমানের সমস্ত প্রান্তকে ঢেকে ফেলে। অতঃপর তিঁনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটবর্তী হন এবং মহান আল্লাহর ওহী তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এর মর্যাদা অনুভব করেন এবং আল্লাহ তায়ালার নিকট তিঁনি যে সু-মহান মর্যাদার অধিকারী তা জানতে পারেন। আর দ্বিতীয় বার দেখা মি‘রাজের রাতে সপ্তম আসমানের উপরে সিদ্রাতুল মুন্তাহার পাশেই।

সহীহ মুসলিম শরীফে বিভিন্ন সাহাবী থেকে এ বিষয়ে কয়েকটি হাদীসে এসেছে- “হযরত শাইবানী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি যির ইবনে হুবায়শকে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান ছিলো কিংবা তাঁর ও কম (সূরা আন-নাজম ৯) এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, ইবনে মাসঊদ (রাঃ) আমাকে বলেছেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ) কে দেখেছিলেন। তাঁর ছয়শত ডানা আছে”। “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় তিঁনি তাঁকে আরেকবার দেখেছিলেন (সূরা আন-নাজম ১৩) আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ) কে দেখেছিলেন”।

“হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিঁনি যা দেখেছেন তাঁর অন্তকরণ তা অস্বীকার করেনি (সূরা আন-নাজম ১১) আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন এবং এর ব্যাখা প্রসঙ্গে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ) কে দেখেছিলেন তাঁর ছয়শত ডানা আছে”। “তিনি আরো বর্ননা করেন, তিঁনি তো তাঁর প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিলেন (সূরাহ আন- নাজম ১৮)। এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন এবং এর ব্যাখা প্রসঙ্গে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ) কে তাঁর সূরতে দেখেছিলেন। তাঁর ছয়শত ডানা আছে”।

“হযরত মাসরূক (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি হযরত আয়শা (রাঃ) কে বললাম, (আপনি তো বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতিপালককে দেখেননি)। তাহলে আল্লাহর এ বাণীর জবাব কি? তাঁদের মধ্যে মাত্র দুই ধনুক পরিমাণ কিংবা তার চেয়েও কম দূরত্ব ছিলো। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যে ওহী পাঠাবার ছিলো তা পাঠালেন। (সূরা আন-নাজম ৯-১১)। তখন আয়শা (রাঃ) বললেন, উনিতো হলেন জিব্রাঈল (আঃ)। সাধারণত তিঁনি নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আসতেন মানুষের সূরতে। কিন্তু এবার এসেছিলেন তাঁর আসল সূরতে। তাঁর দেহ আকাশের সীমা ঢেকে ফেলেছিলো”।

সুতরাং আমরা বিভিন্ন তাফসীরের কিতাবের ব্যাখ্যা ও হাদীসের সারকথা পেলাম যে উপরে উল্লেখিত আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা হলো রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ) কে দ্বিতীয় বার দেখেছেন মি‘রাজের রাতে সপ্তম আসমানের উপরে সিদ্রাতুল মুন্তাহার নিকটেই। এই আয়াতের যমীরকে কেউ কেউ আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে মনে করেন আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খুব কাছে এসেছেন৷ যা চরম একটা গলত আক্বিদা৷ কারণ এটা মানলে আল্লাহর জন্য আকার, দূরত্ব, দিক সাব্যস্ত করা জরুরী হবে। তাই উক্ত আয়াত থেকে এই দলীল নেওয়ার কোন সুযোগ নেই কিংবা আয়াত দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন এমন কোন প্রমাণ ও পেশ করা যায়না। (আল্লাহ ভালো জানেন)

তিনটি বিষয় দান করা হলো।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ইসরা ও মি’রাজের সফরে অনেক কিছুই দান করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম তিনটি বিষয়ের কথা সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) তিনি বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তিনটি বিষয় দান করা হলো, এক- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। দুই- সূরা আল-বাকারার শেষ দুই আয়াত। তিন- শিরিক মুক্ত উম্মাতের মারাত্মক গুনাহ তাওবার মাধ্যমে ক্ষমার সু-সংবাদ”।

হযরত ইমাম নববী (রহঃ) মারাত্মক গুনাহ ক্ষমার ব্যাখ্যায় বলেন, এ উম্মাতের যে ব্যক্তি শিরিক মুক্ত অবস্থায় মারা যাবে, সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে না। বরং আল্লাহ তাকে যখনই হোক ক্ষমা করে দিবেন।

—— চলবে ইনশা-আল্লাহ
লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান 
আরও সংবাদ